‘ইন্দু সরকার’ ছবির একটি দৃশ্য।
ইন্দু সরকার
পরিচালনা: মধুর ভাণ্ডারকর
অভিনয়: কীর্তি কুলহারি, সুপ্রিয়া বিনোদ, অনুপম খের, নীল নীতিন মুকেশ, টোটা রায়চৌধুরী
এ-ও এক যুদ্ধ! সরকার বনাম সরকার!
লড়াইটা অসম। এবং বড়ই একপেশে। স্রেফ ‘ভাল বৌ’ হতে চাওয়া একটি মেয়ের সঙ্গে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের। যে গণতন্ত্র ২১ মাস ধরে আজ্ঞাবহ কৃতদাসের মতো দাঁড়িয়ে থাকে আত্মগর্বে অন্ধ এক প্রধানমন্ত্রীর সামনে। যে গণতন্ত্রে শাসকের রাজদণ্ড হয়ে ওঠে তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানের চুষিকাঠি।
শিবঠাকুরের আপন দেশেও যা হয় না, এ দেশে ঠিক তা-ই ঘটেছিল। ২১ মাসের সেই একুশে আইনকে সওয়া দুই ঘণ্টায় বন্দি করে ফেলা কঠিন। আর সেই চ্যালেঞ্জেই সসম্মানে উতরে গিয়েছেন পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকর। জরুরি অবস্থা নিয়ে তৈরি এই ছবিতে এমন কিছু জরুরি বার্তা তিনি দিয়েছেন, যা বর্তমান সময়ে যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক। বাস্তব ইতিহাসের সঙ্গে কাহিনির হৃদ্যতা কতটা, তা বলার জন্য বিশেষজ্ঞেরা আছেন। তবু একটা কথা বলতেই হয়। এ ছবি ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে।
অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া ইন্দুর (কীর্তি কুলহারি) সমস্যা তোতলামি। যার জন্য তাঁর আত্মবিশ্বাসেও বরাবর ভাটার টান। বইপত্র পড়া আর কবিতা লেখাই ইন্দুর জগৎ। একটা ভাল বিয়ে আর ছোট্ট এক সংসার— এর বেশি চাহিদা নেই তাঁর। কিন্তু তোতলামির কারণে ইন্দুর বিয়ে ঠিক হতে পারে না। শেষে এক দিন তার দেখা নবীন সরকারের (টোটা রায়চৌধুরী) সঙ্গে। কলকাতার বাঙালি নবীন দিল্লির একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে সরকারি অফিসার। এক মন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ।
নবীনের সঙ্গে বিয়ে হয় ইন্দুর। নবীন উচ্চাশী। তিনি উপরে উঠতে চান। টাকা, ক্ষমতা, বাড়ি, গাড়ি— সব চাই তাঁর। সে জন্য নানা ভাবে উপরওয়ালাদের খুশি রাখেন। স্ত্রী ইন্দুকে বলেন, মন্ত্রীজির জন্য কবিতা লিখে দিতে। যা তিনি নিজের নামে চালাবেন। নবীন এবং কতিপয় মন্ত্রী-আমলাদের সামনে ফুলে-ফেঁপে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা বা ‘ইমার্জেন্সি’। এবং ঠিক সেই কারণেই স্ত্রী ইন্দুকে তিনি সাফ বলে দেন, তাঁর বাড়িতে ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যাবে না।
আরও পড়ুন, মেঘনাদ বধ রহস্য: ফের ছন্দ ভাঙলেন অনীক
এ দিকে, পুরনো দিল্লির তুর্কমান গেটের পাশে বস্তি উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন সঞ্জয় গাঁধী (নীল নীতিন মুকেশ)। সেখানে গড়ে তোলা হবে এক বিলাসবহুল হোটেল। এক দিন পুলিশ গিয়ে বুলডোজার নিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় সেই অসংখ্য ঝুপড়ি। প্রতিরোধের মুখে গুলি চলে। বহু মানুষের প্রাণ যায়। সেই তুর্কমান গেটের সামনেই ইন্দু খুঁজে পান বাবা-মা হারানো দুই শিশুকে। তাঁদের নিয়ে আসেন বাড়িতে। এ দিকে, নবীন তাদের দেখেই রাগে অগ্নিশর্মা। তুর্কমান গেটের কথা শুনতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন তিনি। কারণ, তাঁর দফতরই সরাসরি যুক্ত ওই ঘটনায়। স্ত্রীকে বলেন, তাঁর ঘরে ওই দুই শিশুর ঠাঁই হবে না। ইন্দু খুঁজতে বেরোন তাদের মা-বাবাকে। কিন্তু পান না। এবং সেই সূত্রেই ধীরে ধীরে তাঁর সামনে ফুটে ওঠে ইমার্জেন্সির আসল ছবি। যেখানে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ লুটেরার মতো ঢুকে পড়ে মানুষের শোয়ার ঘরেও।
ছবির প্রথম দিকে দেখা যায়, এক সংবাদপত্রের দফতরে হানা দিয়েছে পুলিশ। একটি লেখায় চোখ বুলিয়ে তারা হুমকি দেয়, এই ধরনের দেশবিরোধী কোটেশন ছাপা যাবে না। সাংবাদিক তখন আমতা আমতা করে বলেন, ‘‘এটা তো গাঁধীজির কথা।’’ শ্লেষাত্মক হেসে পুলিশ অফিসারের জবাব, ‘‘এ দেশে এখন গাঁধীর অর্থ বদলে গিয়েছে।’’ আর তাই স্রেফ প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলে, এই পরিচয়েই সরকারের ‘ডি ফ্যাক্টো’ প্রধান তখন সঞ্জয় গাঁধী (এ ছবিতে ‘চিফ’)। মন্ত্রী থেকে আমলা— সবাই থরহরি কম্প তাঁর দাপটে। কাউকেই মুখের উপরে অপমান করতে আটকায় না তাঁর। এ ছবিতে অবশ্য কুশীলবদের মুখে তিনি শুধুই ‘চিফ’। মা বা ছেলে— কারও নামই উচ্চারিত হয়নি। তো সেই ‘চিফ’ হুকুম করেছেন জনসংখ্যা কমাতে ধরে ধরে পুরুষদের নির্বীজকরণ করতে হবে। রীতিমতো ‘টার্গেট’ বেঁধে দিয়েছেন তিনি। সেইমতো গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে পনেরোর কিশোর থেকে সত্তরের বৃদ্ধ— নির্বিচারে তুলে আনা হয় লোকজনকে, নির্বীজ করার জন্য।
চার দিকে এত কাণ্ড ঘটলেও মুখে কুলুপ সবার। সংবাদমাধ্যমের উপরেও ঝুলছে খাঁড়া। এ দিকে, শিশু দু’টিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ইন্দু। আশ্রয় নেন ইমার্জেন্সিতে ছেলেকে হারানো এক সমাজসেবীর বাড়িতে। এর মধ্যেই ইন্দুর কাছে চলে আসে নবীনের পাঠানো বিবাহ-বিচ্ছেদের চিঠি। তিনি সইও করে দেন তাতে। আর তার পরেই পুলিশ এসে জোর করে তুলে নিয়ে যায় শিশু দু’টিকে।
আরও পড়ুন, পপকর্ন চিবোতে চিবোতে দেখলেও এই ছবির জাত নষ্ট হয় না
শুরু হয় ইন্দুর নতুন লড়াই। যে সংগ্রাম তাঁকে নিয়ে গিয়ে ফেলে এক নতুন জগতে। যেখানে তিনি দেখতে পান ইমার্জেন্সির আসল রূপটা ঠিক কেমন। ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন ইন্দু সরকার।
এ ছবির অন্যতম সেরা প্রাপ্তি অবশ্যই কীর্তি কুলহারি। ইন্দু সরকারের ভূমিকায় তিনি বহু দিন মনে থাকবেন। তাঁর স্বামীর ভূমিকায় টোটা রায়চৌধুরী অভিনয়ও দাগ কেটে যায়। হিন্দি ছবিতে আশা করা যায়, টোটাকে এ বার আরও বেশি করে দেখা যাবে। এ ছবির সব থেকে বড় চমক বোধহয় নীল নীতিন মুকেশ। তাঁর মেক-আপ থেকে বাচনভঙ্গি— সবটাই ভীষণ অভিনব। বাস্তবের সঞ্জয় গাঁধীর সঙ্গে কতটা মিল, তা অবশ্য তর্কের বিষয়।