স্কুলের পাট চুকেছিল দুর্ঘটনায় বাবার অকালমৃত্যুতে। কয়েক বছর পরে কাজ শুরু কলকাতা পুলিশে। পেয়েছিলেন বাবার চাকরিটাই। কিন্তু কনস্টেবল বলে কি গান করতে নেই! পুলিশকর্মী আর গান, এই দুই বিপরীত মেরুর কাজকেই এক বিন্দুতে মিলিয়েছিলেন প্রশান্ত তামাং।
দার্জিলিংয়ে প্রশান্তের জন্ম ১৯৮৩-র ৪ জানুয়ারি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরে কলকাতা পুলিশের অর্কেস্ট্রায় গান করতেন সেন্ট রবার্ট স্কুলের এই প্রাক্তন ছাত্র। বাড়িতে মা, ঠাকুমা আর বোনের পাশাপাশি তাঁর গানের গুণমুগ্ধ ছিলেন কলকাতা পুলিশের তাবড় কর্তারাও।
২০০৭ সালে ইন্ডিয়ান আইডলের তৃতীয় সিজনে অডিশন দিয়ে মনোনীত হন প্রশান্ত। এ বার তো লম্বা ছুটির প্রয়োজন। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন উচ্চপদস্থ কর্তারা তাঁর জন্য বিশেষ ছুটির ব্যবস্থা করে দেন।
ইন্ডিয়ান আইডলের তৃতীয় মরসুমে প্রশান্ত সেরা বাছাই হয়েছিলেন অমিত পালের সঙ্গে। কিন্তু দর্শকদের ভোটে শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পান প্রশান্ত-ই। তিনি অমিতের থেকে প্রায় ১০ গুণ ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
দার্জিলিং-সহ গোটা কলকাতা, সিকিম এবং ভারতের বাইরে নেপালেও তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন প্রশান্ত। দর্শকদের ভোট তাঁকে প্রতিযোগিতায় অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিল। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী নেপালিরা সর্বতো ভাবে তাঁর জন্য এসএমএস-ভোটিং করেছিলেন।
‘পাহাড়ের গৌরব’ প্রশান্ত যাতে প্রতিযোগিতায় কোনও ভাবে পিছিয়ে না পড়ে, তার জন্য রাজনৈতিক স্তরেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কঠোর পরিশ্রমী প্রশান্তের সঙ্গীতের কোনও প্রথাগত তালিম ছিল না। তার পরেও ইন্ডিয়ান আইডলে মনোনীত হওয়ায় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আপামর দর্শক। কলকাতা পুলিশের তরফে প্রতিযোগিতায় আগাগোড়া বিপুল সমর্থন পেয়েছিলেন প্রশান্ত।
প্রশান্তকে ঘিরেই এক বার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন একটি এফ এম-এর জকি জোনাথন ব্র্যাডি। দিল্লির রেডিয়ো স্টেশনে বসে তিনি বলেন, এ বার দোকান মালিকদের নতুন নিরাপত্তাকর্মী খুঁজতে হবে। কারণ গোর্খা জনজাতির মানুষ চলে গিয়েছেন গান গাইতে!
প্রশান্ত তামাংয়ের নাম না নিলেও রেডিয়ো সঞ্চালকের এই মন্তব্যে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়। তীব্র প্রতিবাদের চাপে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট চ্যানেলকে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে হয়।
ইন্ডিয়ান আইডল হওয়ার পরে রাতারাতি বদলে যায় প্রশান্তর জীবন। বিপুল অঙ্কের পুরস্কার অর্থের পাশাপাশি পান নতুন গাড়ি। নিতান্ত সাধারণ জীবনের সঙ্গী হয় যশ আর খ্যাতি।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে প্রকাশিত হয় প্রশান্তর প্রথম গানের অ্যালবাম। ‘ধন্যবাদ’ নামে ওই অ্যালবাম ছিল হিন্দি ও নেপালি গানের সংকলন।
তাঁর দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘নমস্তে’ প্রকাশিত হয় ২০০৮-এ। এর পাশাপাশি শুরু করেছিলেন সিনেমায় প্লেব্যাক-ও। নেপালি ছবি ‘হিম্মত টু’ তে প্রথম প্লেব্যাক করেন প্রশান্ত। তাঁর সঙ্গে ওই ছবিতে আর এক নেপথ্যগায়ক ছিলেন ইন্ডিয়ান আইডল-এর আর এক প্রতিযোগী চারু সেমওয়াল।
গানের পাশাপাশি শুরু হয় ছবিতে অভিনয়ের কেরিয়ারও। ২০১০ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি ‘গোর্খা পল্টন’। ২০১০ থেকে ২০১৬ অবধি ছ’টি নেপালি ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রশান্ত। তার মধ্যে ‘গোর্খা পল্টন’-এর পাশাপাশি গান করেছেন ‘আঙ্গালো ইয়ো মায়া কো’ ছবিতেও। তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মধ্যে সুপারহিট হয় ‘পরদেশি’।
তবে বছরে একটার বেশি ছবি করতেন না প্রশান্ত। ২০১৬-য় মুক্তি পেয়েছে তাঁর শেষ ছবি। সে বছরই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর শেষ অ্যালবাম-ও। এর পর বিনোদনের জগত থেকে হারিয়েই যায় এই প্রতিভা।
প্রশান্তের স্ত্রী মার্থা অ্যালি পেশায় বিমানসেবিকা। ২০১১ সালে নাগাল্যান্ডে মার্থাকে বিয়ে করেন প্রশান্ত।