বাড়িঘর এবং পরিবার ছেড়ে মুম্বই এসেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। সহায় সম্বলহীন অবস্থা থেকে একটু একটু করে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। সংখ্যায় বেশি না হলেও কাজ করেছেন বড় ব্যানারের ছবিতেও। কিন্তু মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যু এসে থামিয়ে দিল ইন্দ্র কুমারের বলিউড-অভিযান।
আদতে জয়পুরের বাসিন্দা ইন্দ্র কুমার বেশ কিছু দিন কাটিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৯৫ সালে তিনি বাড়ি ছেড়ে পা রাখেন মুম্বইয়ে। তাঁর দু’চোখে তখন নায়ক হওয়ার স্বপ্ন। সুদর্শন ইন্দ্র কুমার প্রথমে কাজ করেছিলেন কিছু মিউজিক ভিডিয়োয়। কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পরিচালক মহেশ কোঠারির।
সে সময় মহেশ ‘মাসুম’ ছবি পরিচালনা করছিলেন। তিনি সুযোগ দেন ইন্দ্রকে। ১৯৯৬ সালে ‘মাসুম’-এর পাশাপাশি ইন্দ্র কুমারের ‘খিলাড়িয়োঁ কা খিলাড়ি’ ছবিটি মুক্তি পায়। নাচে পারদর্শিতার জন্য তাঁকে নেওয়া হয়েছিল ‘ঘুঙ্ঘট’ ছবিতেও। শুধুমাত্র নাচের জন্য ছবিতে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর দৃশ্য।
কেরিয়ারের শুরুতে অভিনয়ের সুযোগের পাশাপাশি এল প্রেমও। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘তিরচি টোপিওয়ালে’। ছবিতে নায়িকা ছিলেন মনিকা বেদী। ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মনিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন ইন্দ্র। তাঁদের প্রেম সে সময় ছিল চর্চিত। তবে এই সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
সলমন খানের সঙ্গে ইন্দ্র কুমারের আলাপ হয় ‘কহীঁ প্যায়ার না হো জায়’ এবং ‘তুম কো না ভুল পায়েঙ্গে’ ছবির সময়। দু’জনের বন্ধুত্ব খুব দ্রুত গাঢ় হয়। কারণ দু’জনেই শরীরচর্চায় আগ্রহী ছিলেন। ইন্দ্র কুমারের শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহ দেখে ভাল লেগেছিল সলমনের। জিম থেকে পার্টি, সর্বত্র একসঙ্গে দেখা যেত তাঁদের।
আজিজ মির্জার ছবি ‘এক থা দিল এক থি ধড়কন’-এ অভিনয় করেছিলেন ইন্দ্র। এই ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন ঈশা কোপিকর। পর্দার বাইরেও তৈরি হল ইন্দ্র-ঈশা সম্পর্ক। লিভ ইন করতে শুরু করলেন তাঁরা। পরে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে গেলেও শোনা যায় ইন্দ্র নাকি ঈশাকে কোনও দিন ভুলতে পারেননি।
২০০২ সালে পার্থ ঘোষের ‘মসীহা’ ছবির শ্যুটিংয়ে একটি অ্যাকশন দৃশ্য করার সময়ে আহত হন ইন্দ্র। বেশ কয়েক মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। অভিযোগ, তাঁর দুঃসময়ে পাশে ছিলেন না ঈশা। সে সময় থেকেই তাঁদের সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। বরং, সেই কঠিন সময়ে ইন্দ্রের পাশে ছিলেন তাঁর ম্যানেজার রাজু কারিয়া।
শুধু প্রেম নয়। দুর্ঘটনা তাঁর জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল কেরিয়ারের অনেক সুযোগও। সে সময় ছোট পর্দায় ‘কিঁউকি সাস ভি বহু থি’ ধারাবাহিকে অভিনয় করছিলেন ইন্দ্র। অমর উপাধ্যায় ছেড়ে দেওয়ার পরে স্মৃতি ইরানির বিপরীতে ইন্দ্রকেই নেওয়া হয়েছিল মিহির বিরানির চরিত্রে। কিন্তু দুর্ঘটনার ফলে তিনি বাদ পড়েন। এর পর মিহিরে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রনিত রায়।
সুস্থ হয়ে ওঠার পরে অভিনয়ে ফিরতে সমস্যা হয়েছিল ইন্দ্রর। ছবি এবং ধারাবাহিক দু’টি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সে সময় তিনি ঠিক করেন ব্যক্তিগত জীবনে থিতু হবেন। ২০০৩ সালে বিয়ে করেন ম্যানেজার রাজু কারিয়ার মেয়ে সোনালকে।
কিন্তু মাত্র ৫ মাসের মধ্যে তাঁদের বিয়ে ভেঙে যায়। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যান অন্তঃসত্ত্বা সোনাল। তাঁর অভিযোগ, ইন্দ্র কুমার সে সময় হতাশায় ভুগছিলেন। সে সময় তিনি মাদক নিতেন বলেও অভিযোগ। তা ছাড়া ঈশা কোপিকরের সঙ্গে তখনও তাঁর সম্পর্ক ছিল বলে সোনালের দাবি।
ইন্দ্র এবং সোনালের একমাত্র মেয়ের নাম খুশি। কিন্তু ইন্দ্র তাঁকে কোনও দিন দেখেনইনি। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে ইন্দ্র আরও বেশি করে সুরা এবং মাদকে ডুবে যান। সে সময় তাঁকে কেরিয়ারে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিলেন সলমন খান।
সোহেল খানের ছবি ‘আরিয়ান’-এ অভিনয় করেছিলেন ইন্দ্র। কিন্তু ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। এর পর আরও বেশি করে নেশায় ডুবে যান ইন্দ্র। সে সময় তাঁর জীবনে ফিরে আসেন ঈশা। ২০০৭ সালে এক হোলি পার্টিতে দেখা হয় দু’জনের। ঈশার জন্যই আবার নতুন করে অভিনয়ে ফিরে আসায় উদ্যোগী হন ইন্দ্র।
সে সময়েও তাঁর পাশে ছিলেন সলমন খান। ‘ওয়ান্টেড’-এ সলমনের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইন্দ্র। সে সময় মনে হয়েছিল, তিনি আবার নতুন করে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু ভক্তদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। ২০০৯ সালে আবার একা হয়ে গেলেন ইন্দ্র। তাঁকে ছেড়ে প্রেমিকা ঈশা বিয়ে করে নেন রেস্তরাঁ ব্যবসায়ী টিমি নারাং-কে। কিছু দিন পর ইন্দ্রও বিয়ে করেন কমলজিৎ কউর নামে এক উঠতি মডেলকে। তবে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ২ মাস।
তার পরেও প্রেম বা বিয়ের উপর থেকে আস্থা হারাননি ইন্দ্র। ২০১৩ সালে তিনি বিয়ে করেন পল্লবী নামের এক তরুণীকে। ইন্দ্রর মনে হয়েছিল পল্লবীই তাঁর ছন্নছাড়া জীবনের হাল ধরতে পারবেন। বিয়ের এক বছর পরে জন্ম হয় তাঁদের মেয়ের। কিন্তু সন্তানের জন্মের সুসংবাদের মধ্যেই ফের আঘাত। ২০১৪ সালে ইন্দ্রর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন এক উঠতি অভিনেত্রী।
তরুণীর অভিযোগ ছিল, ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার নামে তাঁকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন ইন্দ্র কুমার। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় ইন্দ্রকে। জীবনের সেই কঠিন সময়ে ইন্দ্রর পাশে ছিলেন তাঁর স্ত্রী পল্লবী। তিনি দাবি করেন, ওই তরুণী স্বেচ্ছায় ইন্দ্র কুমারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। তাই, ওই ঘটনায় ইন্দ্রর মতো ওই তরুণীও সমান দায়ী।
ইন্দ্রর অভিযোগ ছিল, তাঁকে যে সময় গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে সময়ে বাড়িতে মেয়ে অসুস্থ ছিল। বাড়িওয়ালা তাঁদের বার করে দিয়েছিলেন। এক বন্ধুর গ্যারাজে মালপত্র রেখে সপরিবার থাকতেন অন্য এক বন্ধুর বাড়িতে। আইনি লড়াইয়ের খরচ যোগাড় করতে গাড়ি বিক্রি করে দেন তিনি। কারণ তাঁর হাতে সে সময় কোনও কাজ ছিল না।
দেড় মাস জেলে থাকার পরে জামিন পান ইন্দ্র। সেই দুঃসময় তাঁর পাশে ইন্ডাস্ট্রির কেউ ছিলেন না বলে অভিযোগ। শুধু সাহায্য করেছিলেন অভিনেত্রী ডলি বিন্দ্রা। এ কথা জানিয়েছিলেন ইন্দ্র নিজেই। জেল থেকে মুক্তির পরে তিনি আবার চেষ্টা করেছিলেন জীবনের ছন্দে ফিরে আসার। কিন্তু পারেননি। কোথাও না কোথাও অতীত তাঁর পিছু ছাড়েনি।
২০১৭ সালের ২৮ জুলাই মাত্র ৪৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ইন্দ্র। তার পরে নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি ভিডিয়ো। যেখানে এক হাতে সুরার গ্লাস নিয়ে বলছেন, তিনি আত্মহত্যা করতে চান। এর পরই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি অভিনেতার মৃত্যু কি হৃদরোগেই হয়েছে?
বিতর্ক থামাতে পল্লবী জানান, ওই ভিডিয়ো ইন্দ্র কুমারের একটি ছবির দৃশ্য। যা কোনও ভাবে প্রযোজনা সংস্থার গাফিলতিতে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবির নাম ‘ফাটি পড়ি হ্যায় ইয়ার’। এই ছবির শ্যুটিংই শেষ দিকে করছিলেন ইন্দ্র কুমার। তাঁর মৃত্যুর ২ বছর পরে মুক্তি পায় ছবিটি।
কেরিয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবন, দু’দিকেই বার বার ধ্বস্ত হয়েছেন ইন্দ্র কুমার। তবে জীবনের ওঠাপড়ায় তাঁর পাশে ছিলেন তৃতীয় স্ত্রী পল্লবী। দর্শকরা মনে করেন, জীবনে যত বারই এগনোর চেষ্টা করেছেন, অতীত এসে ইন্দ্র কুমারের সামনে দাঁড়িয়েছে।