‘তিনকাহন’-এ ঋতুপর্ণা। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
বিজ্ঞাপন জগতের মানুষদের ছবি পরিচালনায় আসা নতুন কিছু নয়। মুকুল আনন্দ থেকে প্রদীপ সরকার, ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে সুজিত সরকার, অনীক দত্ত থেকে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী— বিজ্ঞাপন জগতের বহু পরিচালকই ফিল্মে এসেছেন।
সেই তালিকায় নবতম সংযোজন বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়। মুম্বইনিবাসী আদ্যোপান্ত বাঙালি এই পরিচালক তাঁর প্রথম ছবি ‘তিনকাহন’ বানিয়েই চমকে দিয়েছেন। এখন অবধি তেত্রিশটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ঘুরে ফেলেছে ছবিটি। পাঁচটি মহাদেশে হয়ে গিয়েছে প্রিমিয়ার। ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতেও সম্মানিত হয়েছে ছবিটি। এবং এখানেই রয়েছে যাকে বলে ‘বিগ নিউজ’। মুম্বই ফেস্টিভ্যালে ‘তিনকাহন’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘হাইওয়ে’র পরিচালক ইমতিয়াজ আলি। সাদাকালো ফ্রেমে গ্রামবাংলার নস্টালজিয়া এতটাই ছুঁয়ে গিয়েছে ইমতিয়াজকে যে উনি রাজি হয়ে যান এই ছবির উপস্থাপনা করতে। এই প্রথম কোনও বাংলা ছবির উপস্থাপনা করবেন ইমতিয়াজ।
বাঙালির নিজের ছবি
ছবিটা দেখার পর থেকেই ভীষণ উত্তেজিত ইমতিয়াজ। মুম্বই থেকে বললেন, ‘‘বাঙালি অনুভূতিপ্রবণ। ভিশ্যুয়াল আর্টস বাঙালির মতো করে ভাল কেউ বোঝে না। আমার কোনও ছবি দেখে বাঙালির ভাল লাগলে আমি সবচেয়ে খুশি হই। আর ‘তিনকাহন’ তো বাঙালির নিজের ছবি। ছবির গল্প বলার ধরনে সত্যজিৎ রায়ের যুগের বাংলা ছবির মেজাজটা খুঁজে পেয়েছি। ক্যামেরার কাজও অসম্ভব ভাল। অপেক্ষা করে আছি বাঙালি এই ছবিটা দেখে কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করবে।’’
বৌদ্ধায়নের চরিত্র নির্বাচনও চমকে দিয়েছে ইমতিয়াজকে। বললেন, ‘‘অনেক দিন পর আশিস বিদ্যার্থীকে বাংলা ছবিতে একদম অন্য ভাবে দেখতে পাবে বাঙালি দর্শক। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর লুক-টাও চমৎকার সেট করেছেন পরিচালক। বোঝা যায় তিনি চরিত্রের ডিটেলিং নিয়ে প্রচুর খেটেছেন,’’ বলছেন ‘যব উই মেট’ ও ‘হাইওয়ে’-র পরিচালক।
মুম্বইতে থাকলেও আদ্যোপান্ত বাঙালি
মুম্বইনিবাসী এই অ্যাড ফিল্মমেকারের জন্ম কিন্তু কলকাতায়। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে ‘বেল বাজাও’ নামে এক বিজ্ঞাপনী ছবি তৈরি করে প্রথম নজরে আসেন তিনি। তাঁর ‘বেল বাজাও’ কান-এ সিলভার লায়ন পুরস্কারও পায়। মুম্বইতে থাকলেও বৌদ্ধায়ন এক আদ্যোপান্ত বাঙালি।
‘পাতালঘর’-এর পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরীর কাছে বিজ্ঞাপনের কাজ শিখেছেন তিনি। মাথায় রেখেছিলেন মেন্টর ঋতুপর্ণ ঘোষ-কে।
বিজ্ঞাপন থেকে ছবির জগতে আসা— সেটাও কি মেন্টর ঋতুপর্ণ ঘোষকে দেখেই?
“দেখুন, বিজ্ঞাপন জগৎ থেকে ছবি করতে আসার কিছু বাড়তি সুবিধে আছে। আসলে তো বিজ্ঞাপনই ফিচার ফিল্মের আঁতুড়ঘর। বিজ্ঞাপনের ভাষা রোজই বদলায়। আর খুব কম সময়ের মধ্যে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছতে হয়। সব সময়ই নতুন টেকনিক বা উপস্থাপনার নিত্যনতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে হয়। এই অভিজ্ঞতা দিয়েই কিন্তু ‘তিনকাহন’-এর চিত্রনাট্য লিখেছিলাম আমি,” বলেন বৌদ্ধায়ন।
প্রেম-ঈর্ষা-পরকীয়া
‘তিনকাহন’ আসলে তিন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের গল্প। সময়টাও আলাদা। বিজ্ঞাপন জগতের অভিজ্ঞতায় পরিচালক ছোট ছোট শট নিয়ে জাম্পকাটের মাধ্যমে গল্প বলেছেন। কোথাও ছবিটি দীর্ঘ হয়নি। গল্পগুলো মিলে গিয়েছে একটি সূত্রে। সূত্রটি পরস্ত্রী-প্রেম। এই পরস্ত্রী-প্রেমেও আছে নতুনত্বের স্বাদ। ‘তিনকাহন’-এর প্রেম বিষণ্ণ। ভরা শ্রাবণের অকালবর্ষণ ছবি জুড়ে। এই বিষণ্ণতার হাত ধরেই বদলে যেতে থাকে ছবির দৃশ্য। যন্ত্রণা-ঈর্ষা-মৃত্যু-প্রেম আরও নিষ্ঠুর হতে থাকে। এই প্রেমের মধ্যেই ধরা পড়েছে বাঙালির বৃষ্টিভেজা সত্তর দশকের রোম্যান্স। আজকের হোয়াটসঅ্যাপ প্রজন্মের টেক স্যাভি পরকীয়ার গল্প। একশো বছরের বাঙালি জীবনে প্রেমকে ঘিরে অবসেশন যে ভাবে বদলেছে, ঠিক সেই ভাবে বদলেছে বৌদ্ধায়নের ছবির প্লট।
স্বামী ও প্রেমিক
কিন্তু থ্রিলার, ফ্যামিলি ড্রামা, গোয়েন্দা ছেড়ে হঠাৎ পরকীয়া কেন?
‘‘কোনও প্ল্যান করে এই ছবির চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। হঠাৎই একদিন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘স্বামী ও প্রেমিক’ গল্পটি পড়ে মনে হয়েছিল এটা নিয়ে ছবি করব। কিন্তু চলচ্চিত্রের জন্য গল্পটা বড্ড ছোট ছিল। প্রয়োজন ছিল আরও একটি গল্পের,’’ বললেন বৌদ্ধায়ন। পরস্ত্রী, প্রেম সম্পর্কিত বাংলা সাহিত্যের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি পেয়ে যান বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘বর্ষায়’ গল্পটি।
এটিই ‘তিনকাহন’-এর প্রথম গল্প। দ্বিতীয়টি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘স্বামী ও প্রেমিক’। এবং তৃতীয় গল্প ‘টেলিফোন’ বৌদ্ধায়ন নিজেই লিখে ফেলেন। হলিউডি থ্রি অ্যাক্ট স্ক্রিন প্লে-র আদলে তৈরি হয় প্রেমের তিনকাহন। তিনি যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর কথা মাথায় রেখেই চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছিলেন, সেটাও কথায় কথায় বলেন পরিচালক। ‘‘ঋতুদি না করলে হয়তো গল্পটাই বদলে ফেলতে হত,’’ স্পষ্ট বলেন বৌদ্ধায়ন।
বৌদ্ধায়নের সঙ্গে কাজ করতে পেরে খুশি ঋতুপর্ণা। বললেন, ‘‘বিজ্ঞাপন জগৎ থেকে আসায় ছবির ফ্রেমিং থেকে গল্প বলার প্যাটার্ন— সব ক্ষেত্রেই বৌদ্ধায়নের প্যাশন আমায় খুব টেনেছিল। চিত্রনাট্য শুনে না বলতে পারিনি। এই পরকীয়া গড়পড়তা পরকীয়া নয়। একটা থ্রিলিং ট্যুইস্ট আছে এই গল্পে।
সেটা এখন বলছি না।’’ এ ছবিতে সুমন মুখোপাধ্যায় বিংশ শতকের ইংরেজি জানা এক শিক্ষিত বাঙালি কবি। অন্য দিকে অদ্ভুত এক স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী।
‘পথের পাঁচালী’ র রেফারেন্স
আশৈশব সত্যজিৎ-অনুরাগী বৌদ্ধায়ন। ছবির প্রথম গল্পের রেফারেন্সই ছিল ‘পথের পাঁচালী’। এই কারণেই ছবির প্রথম গল্পে লাইভ মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে। পার্বতী বাউল নিজে অভিনয় করে গান গেয়েছেন। সঙ্গীত পরিচালনায় অর্ণব চক্রবর্তী। ছবিটির সম্পাদনায় অর্ঘ্যকমল মিত্র।
আপাদমস্তক বাঙালি এই ছবি দেশ-বিদেশ ঘুরে কলকাতায় মুক্তি পাচ্ছে সেপ্টেম্বর নাগাদ। কিন্তু এত দেরি কেন? ‘‘ওটাই তো আসল ডেস্টিনেশন। ওখানেই ছবিটির শেষ,’’ হেসে বললেন বৌদ্ধায়ন। প্রবাসী বাঙালিদের জন্য মুম্বইতে খুলেছেন ‘ছুটির পাঠশালা’। বাংলা ভাষা শেখানোর এক অভিনব স্কুল। নতুন পরিচালক হিসেবে সংশয় ছিল তাঁর ছবি কেউ দেখতে যাবে কিনা। ইমতিয়াজের সমর্থন ভরসা দিয়েছে তাঁকে। বললেন, ‘‘ইমতিয়াজের হাত দিয়ে যদি ছবিটা দর্শকের কাছে পৌঁছয়, তা হলে পরিধিটাও বাড়বে,’’ আত্মবিশ্বাসী শোনায় বৌদ্ধায়নকে।
আনাচে কানাচে
ফোয়ারার উড়ান: ফাইটার প্লেনের সামনে ঋদ্ধি। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।