মাছ যে বাঙালিকে নানানভাবে পরিপুষ্ট করেই চলেছে, তাতে আর নতুন কথা কী! তা বলে মাছের সাহায্যে রূপচর্চা? রূপকথায় কিন্তু পাওয়া যায় এমন এক জাদু মাছের কথা, যাকে মনে মনে ডেকে ‘মাছের দয়ায়, আমার ইচ্ছায়’ বললেই মিলত অনন্ত রূপ-যৌবনের সুরাহা। সেটুকুকে গালগল্প বলে দূরে সরিয়ে রাখলেও এই শহর কিন্তু এখন পেলব কোমল ত্বকের জন্য হেসেখেলে দ্বারস্থ হচ্ছে মাছেরই। সব মাছের নয় অবশ্য; শুধুই গারা রুফা নামের রঙ-বেরঙের মাছের। মুহূর্তে সব শ্রম অপনোদনের জন্য আর পায়ের যত্নের জন্য এহেন ফিশ ফুট স্পা-ই এখন শহরবালাদের পেডিকিওরের প্রথম ফ্যাশনেবল পছন্দ।
তা, গারা রুফা মাছ কীভাবে পায়ের যত্ন নেয়? ব্যাপারটা বেশ মজার, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। একটা জলভর্তি অ্যাকুয়ারিয়ামে ছাড়া থাকে এক ঝাঁক রঙিন গারা রুফা; পরিশ্রমের মধ্যে পা দু’খানি তাতে ডুবিয়ে দিলেই হল। বাকিটুকু এরপর ওই রূপকথার গল্পের মতোই ‘মাছের দয়ায়’ হবে; গারা রুফা তার ছোট ছোট ঠোঁঠে করে ঠুকরে নেবে পায়ের ধুলো, শুকনো মৃত ত্বক। তাতে পা দু’খানি যেমন কোমল পেলব হবে, তেমনই শরীর হবে ঝরঝরে, সবশেষে মুখেও দেখা দেবে স্মিত হাসি। এটাই ফিশ ফুট স্পা-এর মোদ্দা কথা।
ভাবতে অবাক লাগলেও এই ফিশ ফুট স্পা কিন্তু আধুনিক সময়ের আজব কোনও কুদরতি নয়। কলকাতায় এহেন মাছের সাহায্যে পদচর্চা খুব বেশি দিনের ব্যাপার না-হলেও বিশ্ব কিন্তু এই পদ্ধতির সঙ্গে অনেক দিনই পরিচিত। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্ব এবং তার তুরস্ক-ইরান-ইরাক এইসব দেশে গারা রুফার সাহায্যে পদচর্চা রীতিমতো স্বীকৃত এবং ঐতিহ্যবাহী প্রথা। সেখানকার মানুষজন বরাবরই ত্বকের নানান রোগ, যেমন একজিমা বা সোরিওসিস থেকে নিষ্কৃতির জন্য দ্বারস্থ হয় গারা রুফার। সমীক্ষা বলছে, মোটামুটি ১৮০০ সাল থেকে আস্তে আস্তে সারা বিশ্ব বুঝতে শুরু করে গারা রুফার মাহাত্ম্য। তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরোয়া চৌহদ্দি ছেড়ে গারা রুফা ঠাঁই পায় পায়ে পায়ে।
কলকাতায় ইদানিং ফিশ ফুট স্পা বেশ জনপ্রিয় হলেও খুব বেশি ডেরা অবশ্য এর জন্য সারা শহর চষলেও মিলবে না। কলকাতা এবং গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়ার এক অংশেই আপাতত সীমাবদ্ধ হয়েছে ফিশ ফুট স্পার প্রচলন। সেই তালিকায় রয়েছে সল্ট লেক-এর ‘ফিশ অ্যান্ড টো’, রয়েছে সল্ট লেক আর হাওড়ার অবনী রিভার সাইড মলের ‘স্পাকুয়া’! শহরে এত কম ফিশ ফুট স্পা-র একটা বড় কারণ হতে পারে, পেডিকিওর নিয়ে মানুষের একটা অবহেলার মনোভাব- পায়ের যত্ন না করলেও চলে এমন একটা ব্যাপার-স্যাপার আর কী! তারই সঙ্গে এহেন স্পা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছু কিছু ভুল ধারণাও আছে; মাছের কামড়ে পা ক্ষতবিক্ষত হতে পারে- রয়েছে এমন মনোভাবও!
ফিশ ফুট স্পা নিয়ে এরকম শঙ্কা ঝেড়ে ফেলাই ভাল; কেন না গারা রুফার মতো বন্ধুভাবাপন্ন মাছ খুব কমই হয়। গারা রুফা কামড়ায় বটে; তবে তাতে কোনও কষ্ট নেই- এক সুড়সুড়ি ছাড়া! অবশ্য সেই সুড়সুড়িও খুব বেশিক্ষণ কষ্ট দেয় না; আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে যায় পা। আরেকটা দিক থেকে আপত্তি আসতে পারে গারা রুফা দিয়ে পদচর্চার ক্ষেত্রে- সেটা নিতান্তই মানবিক দিক। ক্রমাগত পায়ের নোংরা খাইয়ে গেলে মাছগুলোর কোনও ক্ষতি হয় না তো? এদিক থেকেও পশুদের ওপর কোনও অত্যাচারের অভিযোগ আসে না, কেন না গারা রুফা খুব তাড়াতাড়ি হজম করে ফেলে যা কিছু!
এর পর বাকি থাকে একটাই প্রশ্ন- পা দু’খানিকে কোমল পেলব করে তুলতে ঠিক কতটা সময় নেয় গারা রুফার দলবল? বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ- ১৫ মিনিট থেকে বড়জোর আধ ঘন্টা যথেষ্ট গারা রুফাদের হাতে পা ছেড়ে দেওয়ার জন্য; আর ত্বকের অসুখের জন্য লাগতে পারে সপ্তাহে একবার করে ছ’টা কি আটটা সিটিং। তাতেই কেল্লা ফতে হবে। আর খরচ? ২০০ টাকা থেকে শুরু হচ্ছে এমন মজার ফিশ ফুট স্পা-র খরচ; মোটের ওপর পকেটসই বাজেট বললে ভুল কিছু হয় না।
তাহলে কি এবার ‘মাছের দয়ায়, নিজের ইচ্ছায়’ পদপল্লব পেলব করার দিকে এগোনো যায়? এখনও কিছু দ্বিধা থাকলে একবার মাজিদ মাজিদি-র ‘চিলড্রেন অফ হেভেন’ ছবিটার শেষ দৃশ্যটার কথা মনে করিয়ে দেওয়া যাক। জীবনযাপনের সব দিক থেকে হোঁচট খেতে খেতে আলি আর জারা ছোট্ট দুই ভাই-বোন শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে এসে পা ডুবিয়ে বসে থাকে উঠোনের পুরনো চৌবাচ্চাটায়; পায়ের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়ায় গারা রুফার ঝাঁক। আস্তে আস্তে ধুয়ে যায় তখন দিনযাপনের গ্লানি; মুখে ফুটে ওঠে অনাবিল হাসির আলো। এরকম হাসির জন্যই না-হয় ঢুঁ মারা যাক শহরের ফিশ ফুট স্পা-য়!