বাঁ দিক থেকে আদি বোসের চরিত্রে ঋত্বিক, অর্ক ভট্টাচার্যর ভূমিকায় আবীর ও খোকার চরিত্রে অনির্বাণ।
দুষ্টের দমন শেষে ভাল আর সত্যের জয়, এই ছক অনেক দিন আগে ভেঙে বেরিয়ে এসেছে সিনেমার ভাষা। বরং রঙিন সব দুষ্টুলোকেরাই সেলিব্রেটেড হচ্ছে চলচ্চিত্রে। নায়কের হিরোগিরির চেয়ে দর্শককে বেশি আকর্ষণ করে একজন ভিলেন কী করে দুষ্টচক্রের জাল বিস্তার করছে। শেডস বেশি, চ্যালেঞ্জও। তাই শুধু দর্শকই নন, অভিনেতারাও নিজেদের ওই ছাঁচে ফেলতে আগ্রহী থাকেন। জোকার, হ্যানিবল লেক্টরের আবেদন বিশ্বজনীন। একই কারণে ভয়াবহতায় বিহ্বল করে গব্বর সিং, ল্যাংড়া ত্যাগী হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। হিরো-ভিলেনের ছক ভেঙে টলিউডও বেরিয়ে এসেছে।
হালফিলের বাংলা ছবিতে ‘খোকা’র মতো সেলিব্রেটেড খলচরিত্র কমই এসেছে। ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ মুক্তির আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের চরিত্রটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে অভিনেতাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘‘প্রথম ছবি ‘আরশিনগর’এই করেছিলাম এক নেশাসক্ত লুম্পেনের চরিত্র। ধনঞ্জয়ের মতো চরিত্রও করেছি। ‘দুর্গা সহায়’, ‘উমা’, ‘এক যে ছিল রাজা’... সব ছবিই তাই।’’ তবে কোনও চরিত্রকেই ‘নেগেটিভ’ হিসেবে দেখেননি অনির্বাণ। ‘‘একটা পজ়িটিভ ফ্ল্যাট চরিত্রের চেয়ে, যে চরিত্রের মধ্যে পরত বেশি, অভিনেতা হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো বেশি উত্তেজিত করে। আসলে কারও খল বা অন্ধকার দিকটা মানুষ দেখতে ভালবাসে। নেগেটিভিটির প্রতি মানুষের ইনক্লিনেশনই এই চরিত্রগুলোকে বিখ্যাত করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভাল গান শেয়ার করলে যত মানুষ শুনবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বলবেন ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’র বিকৃতি নিয়ে।’’ বললেন অনির্বাণ। শুধু অনির্বাণই নন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট বরাবরই করে এসেছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ‘২২শে শ্রাবণ’-এর প্রসেনজিতের চরিত্র প্রবীর রায়চৌধুরী যার প্রমাণ।
বাংলা ছবিতে আবীর চট্টোপাধ্যায়ের ‘গুডবয়’ ইমেজ চিরকালই। তা ভেঙে সম্প্রতি ‘অসুর’, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘ফ্ল্যাট নং ৬০৯’-এর মতো ছবিতে নেগেটিভ শেডের চরিত্র তিনি করেছেন। তারও আগে ‘রাজকাহিনী’, ‘কানামাছি’। শুরুর দিকে ‘বহ্নিশিখা’ ধারাবাহিকেও নেগেটিভ রোলে ছিলেন। এখন তিনি ছোটদের ‘সোনাদা’। যে খুদে ভক্তরা ‘বর্ণপরিচয়’-এর পরে রীতিমতো অভিযোগ জানিয়েছিল আবীরের কাছে। অভিনেতার কথায়, ‘‘এখন অন্য ধরনের চরিত্রের প্রস্তাব পেলে বেশ উত্তেজিত লাগে। ধূসর চরিত্র বলে যেমন মন খুঁতখুঁত করে, তেমনই ভিলেনের এমন কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য থাকে, যা মানুষ ভালবাসবেনই। সে অর্থে এ ধরনের চরিত্র করা ততটা কঠিন নয়। তবে কিছু জিনিস বড় পর্দায় করতে আমি স্বচ্ছন্দ নই।’’
অনির্বাণের কথায় উঠে এসেছিল জোকারের প্রসঙ্গ, ‘‘জোকারের জাস্টিফিকেশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অথচ জোকার সারা পৃথিবীতে বিশাল হিট। মানুষের যে সুপ্ত হননেচ্ছা, তাকেই আইডেন্টিফাই করে এই চরিত্রগুলো। ভিলেনদের এই রেজ, ক্ষমতা, ভয়াবহতা, হিংস্রতা মানুষকে কানেক্ট করতে পারে। একজন নিপাট ভালমানুষের চেয়ে অনেক বেশি করে।’’ ‘ভিঞ্চিদা’র শুরুতেই ঋদ্ধি সেন অভিনীত চরিত্রের নিজের বাবাকে মারার রক্তাক্ত দৃশ্যটি ভাইরাল হয়েছিল। ঋদ্ধির বড় বয়সের চরিত্রটি (আদি বোস) করেছিলেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। অভিনেতার পান্তু হালদারও (এবার শবর) মনে রাখার মতো নেগেটিভ চরিত্র।
‘চতুষ্কোণ’ এবং ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর শেষে চমকে দেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, তাঁর চরিত্রের অন্ধকার দিকটি আগেভাগে আঁচ করতে পারেন না দর্শক। ‘রাজকাহিনী’তেও ইমেজ ভেঙে চমকে দিয়েছিলেন যিশু সেনগুপ্ত।
কাজেই ইমেজের তোয়াক্কা না করে নায়করা অবলীলায় করছেন অ্যান্টি হিরোর রোল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেমন ময়ূরবাহনকে অমর করে দিয়েছিলেন ‘ঝিন্দের বন্দী’তে, তেমনই হীরক রাজাকে করেছিলেন উৎপল দত্ত। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। আবীর, ঋত্বিক, অনির্বাণের মতো নায়করা খলচরিত্রে বার বার মন জয় করেছেন দর্শকের। কখনও কখনও যা ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁদের নায়কোচিত চরিত্রকেও।