বিনোদন দুনিয়ায় পা শৈশবে। তার পর কৈশোর কাটিয়ে তারুণ্যেও পৌঁছলেন অভিনয় করতে করতেই। সময় এগনোর সঙ্গে ছোটবেলার সারল্যের সঙ্গে জড়িয়েছেন বিতর্কেও। কিন্তু হংসিকা মোটয়ানী সেই কয়েক জন শিশুশিল্পীর মধ্যে একজন, যিনি পরবর্তী কালেও সফল নায়িকা হতে পেরেছেন।
মুম্বইয়ের এক সিন্ধি পরিবারে হংসিকার জন্ম ১৯৯১ সালের ৯ অগস্ট। তাঁর বাবা প্রদীপ মোটয়ানী পেশায় ব্যবসায়ী। মা মোনা চিকিৎসক। মোনা প্রায়ই ক্লিনিকে নিয়ে যেতেন হংসিকাকে। সেই ঘটনাই অনুঘটক ছিল হংসিকার অভিনয়জীবনের।
ত্বক বিশেষজ্ঞ মোনার কাছে প্রায়ই পরামর্শের জন্য আসতেন বলিউডের নায়িকারা। ত্বক এবং রূপচর্চা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে তাঁরা মোনার দ্বারস্থ হতেন। একবার মোনার কাছে এসেছিলেন জুহি চাওলা। সে সময় মায়ের কাছেই ছিলেন হংসিকা। তাঁকে দেখে জুহি বলেছিলেন, হংসিকার উচিত টিভিতে অভিনয় করা।
হংসিকাকে টেলিভিশনে প্রথম সুযোগ দেন অরুণা ইরানি। সে সময় তিনি একটি ধারাবাহিক ‘দেশ মেঁ নিকলা হোগা চাঁদ’ পরিচালনা করছিলেন। সেই ধারাবাহিকে সুযোগ পান হংসিকা। সেটাই তাঁর প্রথম কাজ টেলিভিশনে।
এর পর বেশ কিছু ধারাবাহিকে অভিনয় করেন হংসিকা। ‘সোনপরী’, ‘শকালাকা বুম বুম’, ‘কিঁউকি সাস ভি কভি বহু থি’, ‘করিশ্মা কা করিশ্মা’-সহ বহু ধারাবাহিকে তাঁর অভিনয় মন কেড়েছিল দর্শকদের।
টেলিভিশন থেকেই সুযোগ আসে বড় পর্দায়। ২০০৩ সালে হংসিকা প্রথম ‘হাওয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন। সে বছরই তিনি সুযোগ পান ব্লকবাস্টার ছবি ‘কোই মিল গ্যয়া’-য়। এই ছবিতে অভিনয় করার সূত্রে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথমসারির শিশুশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ হংসিকার।
এর পর ‘জাগো’, ‘আবরা কা ডাবরা’, ‘হম কৌন হ্যায়’ ছবিতেও অভিনয় শিশুশিল্পী হিসাবে। যে সময়ে তার বন্ধুরা পড়াশোনা আর খেলাধুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তখনই হংসিকার জীবনে পৌঁছে গিয়েছিল তারকাজীবনের আলো। এমনও হয়েছে, নিজের স্কুলেই বিশেষ অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রণ মিলত।
হংসিকার সেলেবজীবনের পিছনে তাঁর মায়ের অবদান ছিল অনেকটাই। ২০০৪ সালে কিছুটা থমকে যায় কেরিয়ার। সে বছর সেপারেশন হয়ে যায় তাঁর বাবা-মায়ের। এর পর ৩ বছর অভিনয় থেকে দূরেই ছিলেন হংসিকা। মুম্বইয়ে মায়ের সঙ্গেই ছিলেন।
বিরতির পরে হংসিকার প্রত্যাবর্তন ২০০৭-এ। এ বার সকলকে চমকে দেওয়ার পালা। ১৬ বছরের হংসিকাকে দেখা গেল নায়িকার ভূমিকায় ৩৪ বছর বয়সি হিমেশ রেশমিয়ার বিপরীতে, ‘আপ কা সুরুর’ ছবিতে।
মাত্র ৩ বছরে হংসিকার চেহারার বিপুল পরিবর্তন চোখে পড়েছিল দর্শকদের। গুঞ্জন ওঠে, নায়িকাসুলভ চেহারা তৈরি করার জন্য হরমোনাল ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন তিনি। এ বিষয়ে তাঁকে তাঁর চিকিৎসক মা সাহায্য করেছিলেন বলে শোনা যায়।
শুধু ইঞ্জেকশনই নয়। আকর্ষণীয় ফিগার পাওয়ার জন্য তিনি বিশেষ বিশেষ অস্ত্রোপচারও করিয়েছিলেন বলে দাবি। তবে হংসিকা বা তাঁর মা মোনা এ প্রসঙ্গে কোনওদিন মুখ খোলেননি।
‘আপ কা সুরুর’-এর পাশাপাশি ২০০৭-এ নায়িকা হংসিকা বাজিমাত করলেন ‘দেশমুদুরু’ ছবিতেও। পুরী জগন্নাথ পরিচালিত এই ছবিতে তাঁর নায়ক ছিলেন অল্লু অর্জুন। বক্সঅফিসে সুপারহিট এই ছবিতে হংসিকার অভিনয় প্রশংসিত হয়।
ক্রমে দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে হংসিকা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে অন্যদিকে বলিউডে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অধরাই থেকে যায়। সেখানে তাঁর পরিচয় আটকে থাকে শিশুশিল্পী হিসেবেই।
নায়িকার আসনে নিজেকে জনপ্রিয় করার জন্য হংসিকা বহু আশা নিয়ে অভিনয় করেছিলেন ‘মানি হ্যায় তো হানি হ্যায়’ ছবিতে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন এ বারেও অপূর্ণই থেকে যায়।
এই ছবিতে কামব্যাক করেছিলেন গোবিন্দ। কিন্তু গোবিন্দ-হংসিকা জুটি খারিজ করে দেন দর্শকরা। বয়সে ৩০ বছরের বড় গোবিন্দর সঙ্গে হংসিকাকে একেবারেই মেনে নেননি বলিউডি ছবির দর্শক।
এই ছবির পরে বলিউড নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন হংসিকা। বুঝতে পেরেছিলেন শিশুশিল্পী হিসেবে মেনে নিলেও তাঁকে নায়িকার জায়গায় দেখতে নারাজ বলিউড। অন্যদিকে দক্ষিণে কিন্তু অন্য ছবি। তামিল ও তেলুগু ছবিতে সুপারস্টার হয়ে উঠলেন তিনি। ১৮ বছর বয়সেই তাঁর পারিশ্রমিক ছাড়াল কোটির অঙ্ক।
জনপ্রিয়তার হাত ধরেই এল বিতর্ক। দক্ষিণের একাধিক নায়কের সঙ্গে হংসিকার প্রেমের সম্পর্ক নিয়েও গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল। তার মধ্যে নায়ক সিলাম্বারাসন বা সিম্বুর সঙ্গে সম্পর্কের কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ারও করেছিলেন নায়িকা। বেশ কিছু জায়গায় একসঙ্গে দেখা যেত দু’জনকে।
কিন্তু কিছু বছরের মধ্যেই ভেঙে যায় এই সম্পর্ক। ব্রেক আপ নিয়ে হংসিকা মুখ না খুললেও সিম্বুর বাবা জানান, সিম্বু চেয়েছিলেন বিয়ের পরে হংসিকা অভিনয় ছেড়ে দেবেন। কিন্তু এই শর্তে হংসিকা রাজি ছিলেন না।
এর পরও অন্য নায়কের সঙ্গে জড়িয়ে শোনা গিয়েছে হংসিকার নাম। তাঁর দাবি ছিল, যে কোনও নায়কের সঙ্গে অভিনয় করলেই তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন তৈরি হয়ে যায়।
দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা হংসিকার কাছে এ বার অফার আসে বলিউড থেকে। কিন্তু বিন্ধ্য পর্বতের ও পার থেকে হংসিকা আর আরবসাগরের তীরে ফিরতে রাজি ছিলেন না। অতীতের সমালোচনা তাঁর মনে ছিল। তিনি এ বার নাকচ করলেন বলিউডি অফার।
দক্ষিণে হংসিকা এতটাই জনপ্রিয়, অনুরাগীরা মাদুরাইয়ে তাঁর নামে মন্দিরও তৈরি করেছেন। ফলে সেই খ্যাতি ছেড়ে তিনি আর বলিউডে ফিরে আসতে চাননি।
একবার ছুটি কাটাতে তিনি গিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক। সেখানে বিকিনি ও অন্য স্বল্পবাসে তাঁর কিছু ছবি ইন্টারনেট ও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তাঁর অভিযোগ ছিল, তাঁর ফোন হ্যাক করে এই কাণ্ড করা হয়েছে।
পরে একটি অশ্লীল ভিডিয়োতেও তাঁকে দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। হংসিকার অভিযোগ ছিল, তাঁর ছবি বিকৃত করে ভিডিয়োতে ব্যবহার করা হয়েছে।
সম্প্রতি তাঁর আগামী তামিল ছবি ‘মহা’-র পোস্টার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তাঁকে দেখা যাচ্ছে সন্ন্যাসিনীর গেরুয়া পোশাক পরে ছিলিম টানতে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগ ওঠে।
তবে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে দক্ষিণে ব্যস্ততম নায়িকা হংসিকা মোতয়ানি। একসঙ্গে ৫ টি ছবির অফার থাকে তাঁর কাছে। বলিউডে ব্যর্থ হয়েও তিনি নিরাশ হননি। অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি করেছেন নিজের জায়গা।