গুলজার-শান্তনু
সন্ধে নেমেছে মু্ম্বইয়ের রাস্তায়। সাদা পোশাকের সেই মানুষটি কলম চালাচ্ছেন খাতার সাদা পাতায়।
খস খস শব্দ।
মরচে ধরা পাতা পড়ছে, নাকি তৈরি হচ্ছে কোনও ইতিহাস?
তৈরি হল ইতিহাস — গুলজার ইন কনভারসেশন উইথ টেগোর। সাতটা গানের অ্যালবাম।
৮২ বছরের এক কবি খুঁজতে থাকলেন আর এক প্রেমের কবিকে।
রবীন্দ্রনাথ দা়ড়ি নিয়ে জন্মাননি
রবীন্দ্রনাথকে আমরা এই ভুল নিয়ে পড়ি। যেন জন্ম থেকেই উনি দাড়ি নিয়ে জন্মেছেন। গুলজার বলেছিলেন, ‘‘টেগোর কো পড়়তে হুয়ে হাম ইস ভুল মে রহতে হ্যায় কি টেগোর দাড়িকে সাথ হি প্যায়দা হুয়ে থে।’’ তাই ‘গীতাঞ্জলি’র কবি নয়। হ্যান্ডসাম, রোম্যান্টিক এক কবিকে আবার করে খোঁজার জন্য জড়ো হলাম আমরা। আমি, শ্রেয়া, শান। প্রথম সুজিত সরকারের ‘ইঁহা’তে আমরা চারজনই ছিলাম। এ বার ফিরলাম রবীন্দ্রনাথ নিয়ে।
টানা পাঁচ বছর ধরে চলেছে আমাদের এই কবিতা-গানের মেহফিল। গুলজার আফশোস করতেন, আমাদের দেশ সে ভাবে রবীন্দ্রনাথকে চিনল না, হিন্দিভাষীরা তো জানে উনি ‘গীতাঞ্জলি’ লিখে নোবেল পেয়েছেন। সেই নোবেল চুরি গেছে। আর রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সঙ্গীত লিখেছেন। ব্যস ওই পর্যন্ত!
প্রায়ই যেতাম গুলজারের কাছে। উনি লেখার টেবিলে বসে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা। চারদিকে শুধু বই আর বই। মনে হত যেন মন্দিরে এসেছি। একদিন বললেন ‘‘ প্রায়ই আসো, আর চা খাও, আর চায়ের পাতা খরচা করো। এভাবে কী চলবে? কিছু তো করতে হবে’’। ওঁর হেঁয়ালির মধ্যেই আসল কথা লুকিয়ে থাকে। বুঝলাম কিছু একটা করতে চাইছেন। উনি পরে আরও পরিষ্কার করে বললেন, ‘‘গুরুদেব তো আমাদের চাকরি খেয়ে নিয়েছেন। উনি সুরও দিয়েছেন, কথাও লিখেছেন। তোমার, আমার আর কী কাজ? চলো ওঁকে নিয়ে কিছু করি।’’
রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে বাঙালি মেয়ে বিয়ে
দশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ পড়ে থমকে গিয়েছিল এক কিশোর মন। বদলে গিয়েছিল জীবনকে দেখার চোখ। আড্ডায় একদিন বললেন— “দেখিয়ে, টেগোর কিৎনে খামোশ সওয়াল করতে হ্যায় জিন্দেগি সে…”
‘খামোশ সওয়াল’! দুটো শব্দ যে পাশাপাশি যেতে পারে কোনও দিন ভেবে দেখিনি। গানের মধ্যে দিয়ে তো অনেক দেখেছি রবীন্দ্রনাথকে। এ বার গুলজারের ভাষায়, রবীন্দ্রনাথের সুরের সুতোগুলো খুলতে লাগল আমাদের সামনে। শান বলত, এত বার তো রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছি, কিন্তু কথাগুলো তো এ ভাবে ভিতরে ধাক্কা দেয়নি আগে। গুলজারই শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গান পড়ে তার পর ওঁর অন্য লেখা পড়তে। বলতেন, ‘‘উনকে গানা শুনো, উসকে বাদ ফিকশন, ড্রামা পড়ো।’’ এতটা ডেডিকেশন আজকের ক’জন বাঙালির মধ্যে আছে? সন্দেহ হয়...
মনে আছে, এক সন্ধেয় বাড়িতে বসে আছেন। যেতেই বললেন, “আজ যা পেয়েছি, এত দিন ধরে এত লেখা পড়েছি অন্য কারও ‘নাজাম’য়ে (লেখায়) আমি এই অনুভব খুঁজে পাইনি! কী আশ্চর্য। টেগোর কী সুন্দর বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘‘জাহাঁ জাহাঁ জিন্দেগি কা দমন উসকে গুঞ্জায়িশ সে জাদা খিঁচা ওয়াহাঁ ওয়াহাঁ উসকি শাঁস ছুট গয়ি”। ফুল শুকিয়ে গেল কেন? কারণ প্রেমের চঞ্চলতায় আমি তাঁকে গলার মালা করে আঁকড়ে ধরেছি…তাই সে মূর্ছা গেল।
নদী শুকিয়ে গেল কেন? তাকেও জোর করে আমার কাছে আটকে রাখতে চেয়েছি। তাই় শুকিয়ে গেল।
গুলজার পড়ালেন নতুন পাঠ। যা চাইছি তাকে হাতের মুঠোয় বন্দি না করে যদি খোলা আকাশে মেলে ধরি…তবেই তাকে নিজের করে পাওয়া হল!
গুলজারের প্রিয় আলুসেদ্ধ ভাত, সরষের তেল
মাসে অন্তত দু’বার ওর পালি হিলসের ‘বসকিয়ানা’তে পৌঁছে যেতাম। যত কাজই থাকুক, আমরা তিন জনে পাঁচ বছর ধরে মাসে অন্তত দু’বার ওঁর বাড়িতে যেতাম। উনি বলতেন, রবীন্দ্রনাথ অনেকের মধ্যে, অনেক কিছুর মধ্যে কাজ করতেন, সৃষ্টি করতেন। আমরাও যখন তাঁকে নিয়ে চর্চা করব কেউ একা একা আলাদা কাজ করব না। জমজমাট আড্ডা, খানাপিনার মধ্যে দিয়েই হইহই করে গানবাজনা করব।
খানাপিনায় গুলজারের প্রিয় আলুসেদ্ধ ভাত। সরষের তেল থাকবেই। শ্রেয়া নানান রকম মাছ নিয়ে হাজির হতো।
ওই সময়গুলো যেন রূপকথার মতো ছিল। দেখতাম, এক জন কবি তাঁর আগের প্রজন্মের কবিকে কী ভাবে বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচছেন। এত বার ওঁর বাড়ি গেছি কিন্তু কোনও দিন রবীন্দ্রনাথের বই ছাড়া ওঁকে দেখিনি। রবীন্দ্রনাথ পড়বেন বলে বাংলা শিখেছিলেন। হেসে বলেছিলেন, ‘‘শুধু কি তাই? বিয়েও তো করেছি বাঙালিকে।’’ তবে এটাও বলতেন, ‘‘আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত
শব্দটা উচ্চারণ নিয়ে জয়া (বচ্চন) এখনও ঠাট্টা করে।” শুনে হেসে উঠতাম আমরা।
গুলজারের কবিতা-গানে, ইন্টারলিউডে রবীন্দ্রসঙ্গীত
একদিন আমি ওঁর বাড়িতে হাজির। ওঁর টেবিলের উল্টো দিকে দুটো চেয়ার থাকে। আমি একটা চেয়ারে বসে আরেকটাতে গিটার রাখতেই উনি চেয়ার থেকে গিটারটা তুলে নিতে বললেন। আমি ভাবলাম কেউ বোধহয় আসবে। ওঁকে জি়জ্ঞেস করতেই বললেন ‘‘গিটার সরাও, চেয়ারে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। শুনছেন আমরা কী করছি।’’
এভাবেই ভাবতে শিখিয়েছিলেন গুলজার। তার পর থেকে গান তৈরির সময় ভাবতাম রবীন্দ্রনাথ থাকলে কী করতেন, কী ভাবে কবিতায় সুর দিতেন। রবি ঠাকুরের ধাঁচটাই মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। আসলে গুলজার ও রকম কথা বলে আমার চারদিকে একটা বাউন্ডারি তুলে দিলেন। যাতে রবীন্দ্রনাথের বাইরে গিয়ে আমি কিছু না করি। এতে ভালই হয়েছিল। নয়তো রবীন্দ্রনাথের কথায় আমি সুর দেব, এটা তো একটা ‘কিলার আইডিয়া’।
আমি সাহস পেলাম। হাত বাড়ালাম পাশ্চাত্য সঙ্গীতের টিউনগুলোয়। ‘ঘুমতা হুঁ’-র গানে আমি জুড়ে দিলাম সেই ছন্দ। পুরনো কথায় লাগল নতুন সুরের ছোঁয়া।
রবীন্দ্রনাথের সুরের ওপর কিছু করতে চাইনি আমি। আমরা সকলে মিলে ঠিক করলাম গুলজারের লেখায় গান তৈরি হবে। আর গানের ইন্টারলিউড, প্রিলিউড-য়ে রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার হবে। শানের গান ‘ম্যায় ঘুমতা হুঁ’ গানের সঙ্গে যেমন ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ কোরাসে গাওয়ানো হল।
যা চাই তা ভুল করে চাই
যা পাই তা চাই না
ফাগুন কী রাত দখিন কী হাওয়া/চলতি হ্যায় রাহা নেহি মিলতি…
জো চাহা থা উয়ো ভুল হুয়ি/জো পায়া হ্যায়/ উয়ো চাহা নেহি…ম্যায় ঘুমতা হুঁ/ ম্যায় ঘুমতা হুঁ…
যা চাই তা ভুল করে চাই/ যা পাই তা চাই না…
তৈরি হল অরিজিনাল সাউন্ড ট্র্যাক। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রিমিক্স করে গিমিক তৈরি করার মতো হাস্যকর কাজ করিনি। আড্ডা থেকেই তৈরি হল ‘কনভারসেশন উইথ টেগোর’। আগে এ রকম কাজ করিনি। গুলজার একটা করে কবিতা বাছতেন। সেটার হবহু হিন্দি তর্জমা করতেন। তার পর সেটা আমার কাছে আসত। আমি সুরের কাঠামো দিয়ে ওঁকে ফেরত দিতাম। তার পর সেই সুর আর শব্দ নিয়ে গুলজার গানে প্রাণ সঞ্চার করতেন। এত ছবির গান করেছি, অ্যালবাম করেছি, কিন্তু এ রকম ভাবে জীবনে কোনও দিন কাজ করিনি। অবাক লাগত, ওই বয়সে, ওঁর মতো এক জন মানুষ একটা লেখা দু’বার করে লিখছেন!
গুলজার বলছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের অনুভব বজায় রেখে ওঁর কবিতা হবহু হিন্দিতে নিয়ে আসা খুব শক্ত।’’ সে কারণে বার বার শব্দ জুড়েছেন, আবার কেটেছেন।
একটা গানে প্রথমে লেখা হল — ‘‘জ্যায়সি হো ওয়সেহি চলে আও…’’ এই গানে প্রেমের অপেক্ষা। আমি খাম্বাজে সুর ঢেলে সাজালাম। গুলজার সেই সুর পেয়ে শব্দ বদলালেন। লিখলেন, ‘‘ জ্যায়সি হো ওয়সেহি আ যাও/ শিঙ্গার কো রেহনে দো…ঘুংরু গির জায়ে পায়েল সে তো ভি কোই বাত নেহি …’’
এখানে ইন্টারলিউডে এল ‘শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া...’ এ ভাবেই আমাদের আবেগ জড়ো হল ‘শৃঙ্গার কো রেহেনো দো’ গানে। গানটা রেকর্ড করার পর শ্রেয়া বলেছিল, এত দিনে সারা জীবনের জন্য রেখে যাওয়ার মতো একটা কাজ করলাম।
শ্রেয়া আর শান-এর কথা ভেবেই রোম্যান্টিক ডুয়েট তৈরি করেছিলাম আমরা। গুলজার বলেছিলেন, আজকের গান থেকে পুরনো গানে চলে যাব। আবার নতুন সুরে ফিরে আসব। এই যাতায়াতের রাস্তায় হঠাৎ এক দিন গান, কবিতা তৈরি হতে হতে ওঁর ইচ্ছেতেই — রবীন্দ্রনাথের কথা গেয়ে উঠলাম। দেখতাম গুলজারও গুনগুন করে গাইছেন, ‘দিয়েছিল ঝঙ্কার তাই ছিঁড়ে গেল তার...’
তৈরি হল ‘বুজ গ্যয়া থা কিউ দিয়া...’, পূর্বায়নের সেতার আর দীপক বরকার পারকাশন-য়ে
মিলে গেল রাগসঙ্গীত আর বাংলার মেঠো সুর।
লোকগান, ম্যান্ডোলিন আর সেতার
সাত মাত্রার ছন্দ রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দের ছিল। হয়তো নরম করে কিছু ছুঁয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই ছন্দটাই মনোরম— আমিও সাত মাত্রার ছন্দ গানে ব্যবহার করলাম। এ ভাবেই পাশ্চাত্য সুরের কোরাস কখনও বাংলার লোকগান, কখনও বাঁশি আর ম্যান্ডোলিন ব্যবহার করে গুলজার, আজকের প্রজন্মের কাছে রোম্যান্টিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এলেন।
আচমকাই উপলব্ধি করলাম, ৮২ বছরের এক যুবা খুঁজে চলেছেন আর এক চিরযুবা রবিকবি-কে! এই খুঁজতে চাওয়ার স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখলাম খুব সামনে থেকে। দেখালেন গুলজার।
সালাম গুলজার সাহিব!