ছোট্ট স্টুডিয়ো ছিল বাবার। তিনি কোনও দিন চাননি ছেলে ছবি তোলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোনও কাজ করুক। বাবার কথাতেই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। কিন্তু জীবন তাঁর জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। পরবর্তী কয়েক দশকে তাঁকে দর্শকরা চিনলেন ‘শকুনিমামা’ হিসেবে। তাঁর অভিনয়ের মতোই বর্ণময় গুফি পেন্টালের জীবন।
তাঁর জন্ম ১৯৪৪ সালের ৪ অক্টোবর, দিল্লিতে। জন্মগত নাম ছিল সর্বজিৎ পেন্টাল। তাঁদের পরিবার অবশ্য আদতে লাহৌরের। পরে লাহৌর থেকে এসে দিল্লিতে থাকতে শুরু করেছিল এই মধ্যবিত্ত শিখ পরিবার।
ছোট থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ গুফির। তাঁকে চুম্বকের মতো টানত বাবার স্টুডিয়োর ডার্ক রুম। ভাই কানওয়ারজিতের সঙ্গে মিলে তিনি ‘শ্যাডো প্লে’-এর আয়োজন করতেন। আলো-আঁধারিতে হাতের কারসাজিতে দুই ভাই পর্দায় বা দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলতেন ছায়া-ছবি।
কিন্তু বায়োস্কোপ থেকে মন সরিয়ে বাবার কথামতো ইঞ্জিনিয়ারই হলেন গুফি। চাকরি নিলেন টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লোকোমোটিভ-এ। কর্মস্থল হল জামশেদপুর।
তার আগে ইন্দো-চিন যুদ্ধের সময় নাম লিখিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতেও। এক সাক্ষাৎকারে গুফি জানিয়েছিলেন, সেনাবাহিনীতে থাকার সময়ে অবসর সময়ে তাঁরা ‘রামলীলা’-র আয়োজন করতেন। তিনি সেখানে সীতা সাজতেন। তখনও জানতেন না পৌরাণিক পর্ব কী ভাবে তাঁর জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে।
গুফির ভাই কিন্তু বরাবরই নিজের স্বপ্নের সঙ্গে ছিলেন। পরিবারের কথা মেনে অন্য কোনও শাখায় নয়। তিনি পড়াশোনা করেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। ১৯৬৯ সালে মুম্বইয়ে (তখন বম্বে) বদলি হয়ে আসেন গুফি। এর পর তিনি ভাইয়ের সাহায্যে বিনোদন দুনিয়ায় পা রাখেন।
প্রথমে মডেলিং, তার পর সহকারী পরিচালনার পর্ব পেরিয়ে সুযোগ আসে টেলিভিশন এবং সিনেমায় ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয়ের। অভিনেতা হিসেবে তাঁকে প্রথম সুযোগ দেন বাসু চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘দিল্লগী’ ছবিতে।
১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী জুটির সুপারহিট ছবি ‘দিল্লগী’-তে গুফির চরিত্রের নাম ছিল গণেশ। তার পর গুটিকয়েক ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে দেখা গিয়েছে এই অভিনেতাকে।
তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য হল ‘দেশ পরদেশ’, ‘সুহাগ’ এবং ‘সম্রাট অ্যান্ড কোং’। বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে কয়েকটি মাত্র ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। বড় পর্দার তুলনায় তিনি অনেক বেশি উজ্জ্বল টেলিভিশনে।
তবে ছোট পর্দায় তিনি সুযোগ পেয়েছেন অনেক পরে। প্রথম অভিনয় ১৯৮৬ সালে দূরদর্শনের বি আর চোপড়ার ‘বাহাদুর শাহ জাফর’ সিরিয়ালে। তবে আইকনিক পরিচয় পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ২ বছর।
১৯৮৮ সালে দূরদর্শনে প্রথম সম্প্রচারিত হল ‘মহাভারত’। বি আর চোপড়ার এই ধারাবাহিকে গুফি পেন্টাল অভিনয় করেন শকুনির চরিত্রে। ক্রমে পৌরাণিক এবং মহাকাব্যিক এই চরিত্রই হয়ে ওঠে তাঁর পরিচয়।
গান্ধার রাজকুমার শকুনির ভূমিকায় তাঁর অনবদ্য অভিনয় এখনও দর্শকদের চোখে ভাসে। সার্থক চরিত্রাভিনেতার মতো তাঁর নামও চাপা পড়ে গিয়েছিল অভিনীত চরিত্রের আড়ালে।
এর পর দূরদর্শনের ‘কানুন’, ‘সওদা’, ‘আকবর বীরবল’, ‘দ্য ম্যাজিক মেক আপ বক্স’, ‘মহারানা প্রতাপ’, ‘শনি’, ‘কর্ণ সঙ্গিনী’, ‘রাধাকৃষ্ণ’-সহ বেশ কিছু ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
মহাভারতের শকুনি চরিত্রের জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি সবসময়ই তাঁর সঙ্গী। ফলে কেরিয়ারে যে যে ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি।
ব্যক্তিগত পরিসরে গুফি অনেক দিনই একা হয়ে গিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী রেখা ১৯৯৩ সালে চলে গিয়েছেন আচমকা, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তাঁদের ছেলে হ্যারি পেন্টালও এক জন অভিনেতা। গুফির ভাই কানোয়ারজিৎ বলিউডের জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা। তিনি বেশি পরিচিত ‘পেন্টাল’নামে।
২০০৮ সালে গুফি পেন্টাল পরিচালনা করেন ‘শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’ ছবিটি। ছবিটিতে শ্রী চৈতন্যের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সাহেব চট্টোপাধ্যায়। পরে এক সাক্ষাৎকারে সাহেব জানান পরিচালক গুফি পেন্টালের সঙ্গে কাজ করার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।
সাহেব বলেন, পর্দার শকুনি চরিত্রের সঙ্গে ব্যক্তি গুফি পেন্টালের কোনও মিলই নেই। পরিচালক হিসেবে তিনি খুবই ঠান্ডা মাথার। প্রবল বৈষ্ণব ভাবের আবেগপ্রবণ দৃশ্য শ্যুট করার পর পরিচালকের চেয়ারে বসে সবার সামনেই কেঁদে ফেলতেন তিনি।
২০১০ সালে মুম্বইয়ে অভিনয় শেখার এক সংস্থার অন্যতম প্রধান হিসেবে যোগ দেন গুফি পেন্টাল। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক অভিনেতা পঙ্কজ ধীর, যিনি ‘মহাভারত’-এ কর্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অনুরাগীরা মজা করে বলেন, শকুনি-কর্ণ সংযোগ এত বছর পরে পর্দার বাইরেও সজীব!