মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তী, পার্নো, তনুশ্রী এবং সায়ন্তিকার বন্ধুত্বের ওঠাপড়া গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নায়িকারা নাকি বন্ধু হন না। বলা হয়, মুখে হাসি থাকলেও ভিতরে ভিতরে রেষারেষি চলে। নায়িকাদের দ্বন্দ্বকে আবার একটি ইংরেজি শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়, ‘ক্যাট ফাইট’। কিন্তু টলিউডের প্রথম সারির নায়িকাদের মধ্যে কি কাজ নিয়ে রেষারেষি চোখে পড়ে? অন্তত একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চিত্রটি বোধহয় বদলে গিয়েছে। দেখে নেওয়া যাক, টলি অভিনেত্রীরা কি আজও চুলোচুলি করেন? রইল তাঁদের সম্পর্কের ভূত-ভবিষ্যৎ—
মিমি চক্রবর্তী এবং নুসরত জাহান
এই দুই নায়িকার বন্ধুত্ব দেখে ভুরু কুঁচকে যেত দর্শকদের। সত্যিই কি এত ভাল বন্ধু তাঁরা? একই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন দুই অভিনেত্রী। নাম-ডাক, জনপ্রিয়তাও একই রকমের। কেউ কারও স্পটলাইট চুরি করছে কি না, সেই নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই? না, নেই। এমনটা একাধিক বার জানিয়েছিলেন মিমি-নুসরত।
মিমি-নুসরতের বন্ধুত্বের হাইলাইটগুলি—
২০১৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়ালেন নুসরত এবং মিমি। শুধু তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রচারে যাওয়া, মঞ্চে উঠে কথা বলা, একসঙ্গে নিজেদের জন্য প্রচার করা— এক কথায় মানিকজোড় ছিলেন দুই নায়িকা। সংসদ ভবনে গিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন তাঁরা। ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন বলে বিদ্রুপের শিকারও হয়েছিলেন। চিনা অ্যাপ ‘টিকটক’-এ নাচ গান করার জন্য কটাক্ষের তির লেগেছিল দু’জনেরই। দু’জনেই একে অপরকে ‘বোনুয়া’ বলে ডাকতেন। মিমি এবং নুসরত ভুলেও প্রকাশ্যে একে অপরকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতেন না। নেটমাধ্যমে নিয়মিত তাঁদের বন্ধুত্ব প্রদর্শনও চলত। ২০২০ সালে ‘এসওএস কলকাতা’র শ্যুটের পর আলাদা আলাদা দুটি ছবির শ্যুটের জন্য দুই ‘বোনুয়া’ লন্ডনে গিয়ে পৌঁছন। কাজের ফাঁকে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন যেন তাঁরা। যে যাঁর মতো কাজ সেরে নিয়ে দেখা করে নিতেন। কখনও যুক্তরাজ্যের অনস্লো-তে এক সঙ্গে খাচ্ছেন তাঁরা, কখনও একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন। সেই সমস্ত সেলফি মিমি-নুসরতের ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। নুসরতের বিয়ের (যাকে অভিনেত্রী সহবাস বলে দাবি করেছেন) অনুষ্ঠানের সময় মিমি তাঁর সঙ্গে উড়ে গিয়েছিলেন সুদূর তুরস্কে। তাঁদের এক সঙ্গে সময় কাটানোর নানা মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছেন নেটাগরিকরা।
মিমি ও নুসরত
কিন্তু গল্পের মোড় কি ঘুরে এল?
২০১৮ সালের অগস্ট মাসে ‘ক্রিসক্রস’ ছবির প্রচারের জন্য একটি সাক্ষাৎকারে মিমি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘আমরা মিডিয়ায় এই বন্ধুত্বের বেশি প্রচার চাই না। নজর লেগে যাবে। তবে আমরা আমাদের মতোই আছি।’’ কাট টু ২০২১ সাল। চার দিকে প্রশ্ন, দুই ‘বোনুয়া’-কে একসঙ্গে দেখা যায় না কেন? এক সময়ে নেটমাধ্যম জুড়ে দুই নায়িকার বন্ধুত্বের প্রমাণ ছেয়ে গিয়েছিল। নুসরতের প্রাক্তন স্বামী নিখিল জৈনের বস্ত্রবিপণীর একটি বিভাগের উদ্বোধনে নিখিলের পোশাক পরেই সেখানে গিয়েছিলেন মিমি। তার পর থেকে আর তাঁদের নেটমাধ্যমে বা প্রকাশ্যে একসঙ্গে দেখা যায় না। তবে কি সত্যিই ‘নজর লেগে গেল’ তাঁদের সম্পর্কে? না, সন্দেহ কেবল মানুষের মনে তৈরি হয়েছে। তাঁরা এখনও ভাল বন্ধু। একে অপরের ‘বোনুয়া’। কিন্তু মিমি নেটমাধ্যমে বন্ধুত্বের প্রদর্শন করা থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। সম্প্রতি কিছু ‘হাউস পার্টি’-তে বাকিদের দেখা গেলেও মিমিকে দেখা যায় না বলেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে। যদিও যশ-নুসরত সম্পর্ক, নুসরতের গর্ভ ধারণ নিয়ে টলিউড যখন উত্তাল, তখনও মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন মিমি। করোনা টিকা নিতে গিয়েও এই এক প্রশ্নের মুখে পড়েন মিমি। কিন্তু নুসরতের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। কিন্তু নুসরতের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর এখনও অটুট রয়েছে বলেই জানা যায়। এখনও নিয়মিত অন্তঃসত্ত্বা নুসরতকে খাবার পাঠান মিমি।
টলিউডের গুলাব গ্যাং
দুই ‘বোনুয়া’-র সম্পর্ক অভিনব হলেও তাঁদের সঙ্গে আরও দু’জনের হৃদ্যতা ছিল জোরদার। তনুশ্রী চক্রবর্তী এবং সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকেই তাঁদের বলিউডের নারীকেন্দ্রিক ছবির আদলে ‘গুলাব গ্যাং’ বলে ডাকতেন। সেই গ্যাংয়ের বাকি দু’জনের রং আগেই গোলাপি থেকে সবুজ হয়েছে। মিমি এবং নুসরত আগে থেকেই তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি। সায়ন্তিকাও বিধানসভা নির্বাচনে ঘাষফুলের শিবিরেই যোগ দান করলেন। তবে গ্যাংয়ের চতুর্থ সদস্য তনুশ্রী গেরুয়া শিবিরে গিয়েছিলেন। এখন সেই গ্যাং-ও আর নেই, পরস্পরের সঙ্গে নাকি আর কথাও হয় না। খোদ সায়ন্তিকাই বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ। প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও ব্যক্তিগত কারণ ছিল। কারও ব্যস্ততা, কেউ সময় দিতে পারেনি, কারও সঙ্গে কারও মনোমালিন্য হয়েছে...। কী কী কারণে আমাদের সম্পর্ক ভেঙেছে, তা নিয়ে যদি আমরা সকলে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলি, তা হলেও কি পরিস্থিতি বদলাবে? সমস্যার সমাধান আমাদের কাছেই থাকে। সেটা অন্য কেউ বলে দিতে পারে না।’’
দুই অভিনেত্রীর সঙ্গে হবু মা গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নুসরত জাহান, তনুশ্রী চক্রবর্তী এবং শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়
সেই ‘গুলাব গ্যাং’-এর মধ্যে সায়ন্তিকাকে আর দেখা যায় না। এমনকি মিমিকেও দেখা যায় না। যায় কেবল নুসরত ও তনুশ্রীকে। সঙ্গে শ্রাবন্তী যোগ দিয়ে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’-এর রূপ নিয়েছেন তাঁরা। একাধিক ‘হাউস পার্টি’-র ছবি ফাঁস হয়ে গিয়েছে। ‘ইয়াস’ আসার আগের রাতের পার্টিতে ধরা পড়েছিল তাঁদের নতুন বন্ধুত্বের খবর। ঘরোয়া আড্ডায় একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল টলিউডের তিন নায়িকাকে। সঙ্গে ছিলেন নুসরত এবং তনুশ্রীর প্রেমিক যথাক্রমে যশ দাশগুপ্ত এবং রাজকুমার গুপ্ত। আনন্দবাজার অনলাইন সেই আড্ডার ছবি প্রকাশ করার পরেই ইনস্টাগ্রাম থেকে তা মুছে ফেলেছিলেন রাজকুমার। গত জুন মাসে নুসরতের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে শ্রাবন্তী এবং তনুশ্রীর সঙ্গে আড্ডায় মেতেছিলেন নায়িকা। সেই আড্ডার ছবি প্রথম প্রকাশ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। যেখান থেকে নুসরতের ‘বেবি বাম্প’-এর ছবিও প্রকাশ্যে আসে। তার পরে জুলাই মাসের শুরুর দিকে তনুশ্রী চক্রবর্তী তাঁর দুই বান্ধবীর সঙ্গে একটি নিজস্বী দিয়েছিলেন।
পার্নো এবং মিমি
মিমি চক্রবর্তী এবং পার্নো মিত্র
বিধানসভা নির্বাচনের আগেই ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপি সদস্য পার্নো মিত্রের গোয়া ভ্রমণে সঙ্গী হয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ মিমি চক্রবর্তী। পার্নো-মিমির এই আকস্মিক বন্ধুতায় রাজনৈতিক বোঝাপড়ার গন্ধ পেয়েছিলেন অনেকেই। ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছিল, যশরাজ মুখাটের একটি ভাইরাল গানের সঙ্গে নাচ করছেন পার্নো এবং মিমি। সঙ্গে ছিলেন টলিউডের রূপটান শিল্পী সন্দীপ ঘোষাল এবং আরও এক বান্ধবী। রাজনীতি কখনও তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
২০২১ সালের বন্ধুত্ব দিবসে ফের মিমি আর নুসরতের সুসম্পর্কের প্রমাণ পেল নেটাগরিকরা। মিমি নিজের বন্ধুদের ছবির অ্যালবাম পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রামে। সকলকে বন্ধুত্ব দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি। সেই পোস্টের তলায় নুসরত লিখেছেন, ‘শুভ বন্ধুত্ব দিবস বোনুয়া’। সেই মন্তব্য ইতিমধ্যে নেটাগরিকদের নজর কেড়েছে।
রাজনীতি বা পেশাগত প্রতিযোগিতার ময়দানে নিজেদের স্বার্থে সম্পর্ক তৈরি করেননি টলি নায়িকারা। ঝড়, বাদলা, যা-ই আসুক, তাঁদের বন্ধুত্বই সব সময়ে প্রাধান্য পেয়েছে।