২০২৩ সালে টলিউড এবং দর্শকদের নজর থাকতে পারে কোন পাঁচ অভিনেতার উপর? বেছে নিল আনন্দবাজার অনলাইন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অতিমারি কাটিয়ে বাংলা ছবির পরিস্থিতি ভাল না খারাপ, সে বিতর্ক চলতেই থাকবে। মন্দের ভাল ২০২২ সালে টলিউডে ভাল পারফরম্যান্সের কমতি নেই। কেউ নতুন, কেউ বা একটু পরিচিত। ২০২৩ সালে টলিউড বাজি ধরতে পারে, এমন পাঁচ তরুণ অভিনেতাকে বেছে নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ছবির ভূপতির চরিত্রে সত্যম ভট্টাচার্যকে দেখেছেন দর্শক। ছবি: সংগৃহীত।
১. সত্যম ভট্টাচার্য
কে: ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ছবির ভূপতির চরিত্রে অভিনয়ের পর তিনি আপাতত ইন্ডাস্ট্রির ‘তুরুপের তাস’। স্কুলে নৃত্যনাট্যের অভিজ্ঞতা। তবে অভিনয়ের হাতেখড়ি সরস্বতী পুজোয় পাড়ার নাটকে। পরিবারে বাবা এবং দাদা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। ২০০৯ সালে নাটকের দল ‘হিপোক্রিটস’-এ যোগ সত্যমের। এখনও গণ পরিবহণেই যাতায়াত করেন। ভালবাসেন হাঁটতে। সাত বছর সম্পর্কে রয়েছেন। বিয়ের কথা উঠলেই হেসে বলেন, ‘‘ভাবনাচিন্তা চলছে।’’
কেন: ইন্ডাস্ট্রিতে কাটিয়ে ফেলেছেন এক যুগ। ‘হেমলক সোসাইটি’ দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। তার পর ঝুলিতে ‘গুমনামী’, ‘নিরন্তর’-এর মতো ছবি। ‘ছোট’ চরিত্রের পর ‘বল্লভপুর’-এ প্রথম বার মুখ্য ভূমিকা তাঁকে আরও পরিচিতি দিয়েছে। নাটকের অভিজ্ঞতায় ভর করে এই ছবিতে দ্বৈত নয়, বরং তিন-তিনটি চরিত্রে ধরা দিয়েছেন। অভিনয় দক্ষতা পর্দায় ঢেকে দিয়েছে তাঁর তথাকথিত ‘অনায়কোচিত’ চেহারা। টলিপাড়ার প্রযোজক-পরিচালকরাও এই তরুণ অভিনেতাকে নিয়ে ভাবছেন। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র পর জীবন কতটা বদলেছে? সত্যমের উত্তর, ‘‘ভাই-বোনদের মধ্যে চিরকাল পড়াশোনায় একটু পিছনের সারিতেই ছিলাম। কোনও দিনই পরিবারের গর্বের কারণ ছিলাম না। এখন সেটা বদলেছে।’’ প্রকাশ্যে বেরোলে অল্পবিস্তর নিজস্বীর আবদারও মেটাতে হচ্ছে অভিনেতাকে। বেশ খুশি সত্যম।
আগামী: আপাতত নতুন নাটকের (‘তবে তাই’) মহড়ায় ব্যস্ত। পাশাপাশি চলছে চিত্রনাট্য বাছাইপর্ব। কিন্তু কী জানেন, ‘বল্লভপুর’-এর পরে সত্যমের কাছে ছবির প্রস্তাব আসা কমে গিয়েছে! সত্যমের কথায়, ‘‘আসলে অনেকেই হয়তো ভেবে নিচ্ছেন, আমি মুখ্য চরিত্র বা বড় পর্দা ছাড়া এখন কাজ করব না। আনন্দবাজার অনলাইনের মাধ্যমে সকলকে জানিয়ে রাখছি, আমার এমন কোনও ছুঁতমার্গ নেই। অভিনেতার কাছে চরিত্রটাই শেষ কথা।’’
আমাদের সতর্কবাণী: সব রকম কাজ করার ইচ্ছে প্রশংসনীয়। তবে চরিত্র বুঝে সম্মতি জানালেই ভাল।
সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ, সিনেমা— তিনটি মাধ্যমেই অবাধ বিচরণ শোলাঙ্কির। ছবি: সংগৃহীত।
২. শোলাঙ্কি রায়
কে: পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। ‘ইচ্ছেনদী’ ও ‘গাঁটছড়া’র মতো সিরিয়াল তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে বাঙালির ড্রইংরুমে। ২০২২ সালে কেরিয়ারের নতুন মোড়ে শোলাঙ্কি রায়। এই বছরেই দু’টি ছবি করেছেন। যিশু সেনগুপ্তর সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন ‘বাবা বেবি ও’ এবং ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ (ছবিটি এখনও মুক্তি না পেলেও ২০২২ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে)। তারকা হলেও কলেজ জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ অটুট। শুটিংয়ের ব্যস্ততা না থাকলে অবসর কাটে বই পড়ে এবং ছবি এঁকে। সম্প্রতি তাঁর জীবনে এসেছে পোষ্য ‘ক্যারামেল’। মনে করেন, মা-বাবা তাঁর কাজের সবচেয়ে বড় ‘সমালোচক’।
কেন: ‘বাবা বেবি ও’ ছবিতে শোলাঙ্কির পরিণত অভিনয় দর্শক পছন্দ করেছেন। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘দুই মাধ্যমের দর্শকের থেকেই খুব ভাল প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। তাই দায়িত্ব আরও বেড়েছে।’’ ওটিটি, ছোট পর্দা এবং বড় পর্দা— তিন মাধ্যমেই কাজ করছেন। তাই ২০২৩ তাঁর কেরিয়ারে আরও সুযোগ হাজির করতে পারে। নতুন বছরে ওয়েব সিরিজে একটু বেশি মনোনিবেশ করতে চাইছেন। বললেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, দর্শক ভাল কাজ দেখেন। তাই এ বছর ছবি এবং ওয়েব সিরিজে একটু বেশি কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে।’’
আগামী: বেশ কয়েকটা ছবির অফার ছিল। চরিত্র পছন্দ না হওয়ায় রাজি হননি। শোলাঙ্কির কথায়, ‘‘আমি একটু ধীরে চলো নীতি মেনে চলি। কারণ, ১০টা ছবি করলেও যেন সেগুলো নিয়ে কথা বলতে পারি, সেটা মাথায় রেখে চলি।’’ মুক্তির অপেক্ষায় ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ ছবিটি।
আমাদের সতর্কবাণী: সিরিয়ালের কাজে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে গিয়ে ছবির প্রস্তাব নাকচ করার প্রবণতা এড়িয়ে গেলেই ভাল।
‘মোহমায়া’ সিরিজই জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মনে করেন সুহোত্র। ছবি: সংগৃহীত।
৩. সুহোত্র মুখোপাধ্যায়
কে: ২০২২ সালটা তাঁর কেরিয়ারে আক্ষরিক অর্থেই ‘সহকারী’। একাধিক গোয়েন্দার সহকারীর চরিত্রে দর্শক দেখেছেন সুহোত্র মুখোপাধ্যায়কে। তালিকায় রয়েছে ব্যোমকেশ বক্সী, একেন বাবু এবং ‘পাগলাটে’ গোয়েন্দা ‘গোরা’। হাওড়ার কদমতলার ছেলে। বিসিএ নিয়ে পড়াশোনা। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। স্কুল ও বাবার অফিসের অনুষ্ঠানে নাটকের অভিজ্ঞতা। সমাজমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে ইন্ডাস্ট্রির অডিশন নিয়ে কৌতূহল। সুহোত্রর কথায়, ‘‘প্রথাগত চাকরি কোনও দিনই পছন্দ ছিল না। অন্য কিছু করতে চাইতাম। প্রথম অডিশনে প্রশংসিত হওয়ার পর মাথায় অভিনয়ের পোকা নড়ে।’’ সময় পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। পছন্দ করেন গাড়ি চালাতে। আর হ্যাঁ, সুহোত্র কিন্তু ‘সিঙ্গল’।
কেন: ইন্ডাস্ট্রিতে আগমন ২০১৫ সালে। ছোট পর্দার জন্য তৈরি সেই ছবির নাম ‘অন্য বসন্ত’। তবে বিশ্বাস করেন কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়েছিল ওয়েব সিরিজ ‘মোহমায়া’। বিগত কয়েক বছরে ওয়েব সিরিজে অভিনয় করলেও ২০২২ সালে বড় পর্দায় পা রেখেছেন। কমিক চরিত্র থেকে শুরু করে সিরিয়াস চরিত্র— দর্শকের তরফে পেয়েছেন ভাল নম্বর। মহিলা অনুরাগীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাই আগামী দিনে পরিচালকরা সুহোত্রর উপর বাজি ধরতেই পারেন। ২০২২ নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কাজের দিক থেকে এখনও পর্যন্ত আমার কাছে সবচেয়ে সফল বছর। কিন্তু সেটা নিয়ে বেশি ভাবতে চাই না। ২০২৩-এ এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই।’’
আগামী: মুক্তি পাবে একেনবাবুর নতুন ছবি। শুরু হবে ‘গোরা’র দ্বিতীয় সিজনের কাজ। আরও একটি সিরিজে তিনি মুখ্য চরিত্রে (এখনও নাম চূড়ান্ত হয়নি)। এ ছাড়াও একাধিক প্রজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা চলছে।
আমাদের সতর্কবাণী: ‘গোয়েন্দার সহকারী’ ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সনাতনী বা আধুনিকা— দুই ধরনের চরিত্রেই মানানসই মধুরিমা। ছবি: সংগৃহীত।
৪. মধুরিমা বসাক
কে: ‘এক্স= প্রেম’ ছবির অদিতি। ২০২২ সালে নজর কেড়েছেন দর্শকের। নবদ্বীপের মেয়ে। ইচ্ছে ছিল মডেলিংকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করার। কিন্তু কলেজে ছাত্রাবস্থায় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় গিয়ে ভুল ভাঙে। মধুরিমার কথায়, ‘‘ওখানে গিয়ে প্রতিযোগীদের দেখে বুঝলাম, না খেয়ে আমি থাকতে পারব না!’’ অগত্যা মডেলিং কে ‘টা টা’ করে ‘ওয়েলকাম’ করলেন অভিনয়কে। শুরুটা রবি ওঝা প্রোডাকশনের ‘রইল ফেরার নিমন্ত্রণ’ সিরিয়াল দিয়ে। তার পর কয়েক বছর বিভিন্ন ধারাবাহিকে ক্যামিয়ো চরিত্রের পর কেরিয়ারে গতি আনে ‘রাঙা মাথায় চিরুনি’ সিরিয়াল। কিন্তু মধুরিমার বিশ্বাস, ‘বিগত দু’বছরে ‘শ্রীময়ী’ বা ‘মোহর’-এর মতো সিরিয়ালের জন্যই আরও বেশি করে দর্শকের নজরে এসেছি।’’ বাবা-মা ছাড়াও তাঁর জীবন আলো করে রেখেছে দুই পোষ্য ‘মোজো’ এবং ‘মোয়ানা’। গসিপ বিশেষ একটা পছন্দ নয়। প্রেম করছেন? লাজুক কন্যের উত্তর, ‘‘মাঝামাঝি কোনও একটা জায়গায় রয়েছি। কারণ, সিঙ্গল বললে অনেকে প্রেম নিবেদন করে বসবেন। আবার সম্পর্কে আছি বললে গসিপ বাড়বে।’’
কেন: অসম্ভব ফোটোজেনিক। সনাতনী বা আধুনিকা— দু’রকম চরিত্রেই তাঁকে মানিয়ে যায়। এক সময়, সিরিয়ালে সংলাপ পেতেও তাঁকে রীতিমতো লড়াই করতে হত। মধুরিমার গলায় আক্ষেপ, ‘‘হয়তো তখন সত্যিই অভিনয়টা পারতাম না! তবে শেখার কোনও কমতি ছিল না।’’ সিরিয়াল থেকে পাওয়া পরিচিতি পূর্ণতা পেয়েছে কেরিয়ারের প্রথম ছবিতে। সঙ্গে ছিল পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘গাইডেন্স’। ইতিমধ্যেই তিনটি ছবির প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু ‘না’ বলেছেন চরিত্র পছন্দ হয়নি বলে। মধুরিমার কথায়, ‘‘ছবি করতেই হবে, এমন কোনও লক্ষ্য আমার নেই। ছবিটা আমার জীবনে বা কেরিয়ারে কোনও প্রাপ্তি যোগ করছে কি না, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’
আগামী: নতুন সিরিয়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাশাপাশি কিছু ছবি নিয়েও একপ্রস্ত কথা এগিয়েছে।
আমাদের সতর্কবাণী: সঠিক পরামর্শ প্রয়োজন। সেটা না-পেলে কেরিয়ারের গ্রাফ আটকে যেতে পারে।
সংবাদমাধ্যমের সঞ্চালক থেকে অভিনেতা অনিন্দ্যর যাত্রা পথ একটু অন্য রকম। ছবি: সংগৃহীত।
৫. অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
কে: ২০২২ সালের আবিষ্কার। ‘এক্স= প্রেম’ ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। অভিনয় করেছেন ‘খোলাম কুচি’, ‘হস্টেল ডেজ়’-এর মতো ওয়েব সিরিজ়েও। স্কুলজীবনের শেষে পরিবারের পাশে দাঁড়াতেই কাজ শুরু। সংবাদমাধ্যমে সঞ্চালকের ভূমিকায় কাজ করতে করতেই নাটকের সঙ্গে পরিচয়। উত্তর কলকাতায় ছেলেবেলা কাটানো অনিন্দ্য বললেন, ‘‘২০১৯ সালে চিন্তাভাবনা করে অভিনয় করব বলেই চাকরি ছাড়ি। সিদ্ধান্তটা যে সঠিক ছিল, সেটা ভেবে ভাল লাগে।’’ ২০২২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলা ধারাভাষ্যকারের দায়িত্বও সামলেছেন। ওহ্, হ্যাঁ, তরুণীদের জন্য একটা জরুরি তথ্য— অনিন্দ্য বিবাহিত।
কেন ভবিষ্যতের মুখ: টলিপাড়ার তরুণ তুর্কি। মহিলা অনুরাগীদের সংখ্যা অগণিত। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের, ‘‘কাল আমার বাড়ি আয়, স্ক্রিপ্ট শোনাব’’— কথাগুলি এখনও মনে রেখেছেন। বললেন, ‘‘২০২২ আমার কাছে সফল। কারণ আমার প্রত্যেকটা কাজ দর্শকের পছন্দ হয়েছে। আশা করছি, ২০২৩ আরও ভাল কাটবে।’’ অভিনয় সাবলীল। বহুমুখী প্রতিভা। কাজের মাধ্যমে নিজস্ব অনুরাগী বৃত্ত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কেরিয়ারের শুরুতেই সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ। ফলে নতুন প্রস্তাবের কমতি নেই।
আগামী: সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অতি উত্তম’ মুক্তির অপেক্ষায়। এ ছাড়াও রয়েছে ইন্দ্রাশিস আচার্য পরিচালিত ‘নীহারিকা’।ফেব্রুয়ারিতে নতুন ছবির শুটিং শুরু করবেন। আরও নতুন কিছু প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা চলছে।
আমাদের সতর্কবাণী: কাজ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সংখ্যার চেয়ে মানের দিকে নজর দিলে আরও ভাল হবে।