আজকাল মানুষ চিঠি লিখতে ভুলে গেছে। একটু সময় পেলেই বুক মাই শো, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা টুইটার-য়ে গিয়ে দু’-এক লাইন লিখে চলে যায়। সেই অর্থে আমাকে পুরোনোপন্থী বলতে পারেন। তবু ভাবলাম, আপনাকে একটা চিঠি লিখি।
আশা করি ভাল আছেন। শুক্রবার হল-য়ে আপনাকে দেখার পর আমি ভাল নেই।
তার অনেকগুলো কারণ। আপনার কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা ছিল আকাশ ছোঁয়া। গত বছর থেকে বসে ছিলাম আপনার এই ছবি দেখব বলে।
প্রথম যখন কাগজে পড়ি আলিয়া ভট্ট ও শাহরুখ খান একসঙ্গে একটা অন্য রকম ছবি করছেন, এবং তার পরিচালক গৌরী শিন্ডে, তখনই প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। গৌরীর ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রথমেই বলে দিই, প্রায় কুড়ি বছর হল আমি শাহরুখের ডাই-হার্ড ফ্যান। এই মানুষটাই তো আমায় হাত ধরে বলিউডের সঙ্গে আলাপ করালেন, এবং মেগা স্টার হওয়ার আগে, ‘রাজু বন গ্যয়া জেন্টলম্যান’ ও ‘কভি হাঁ কভি না’ দেখেই তো বুঝেছিলাম এক অন্য ধরনের হিরো আসতে চলেছে।
খুব যে ভুল ছিলাম না, তার প্রমাণ তো দিয়েছিলেন শাহরুখ নিজেই। কর্ণ জোহরের হাত ধরে জন্ম নিলেন এক নতুন শাহরুখ, যাঁকে পর্দায় দেখে স্ক্রিন থেকে চোখ সরানো যায় না। এক ঝলক দেখলে মনে হয়, তাঁর চেয়ে হট ও রোম্যান্টিক আর কেউ হতে পারেন না।
এই কর্ণ ও শাহরুখের জুটিটাই আমাদের শাহরুখ-ফ্যান বানিয়েছিল। কিন্তু স্টারডমের মধ্য থেকে সেই ‘অভিনেতা’ শাহরুখকেও যেন কোথায় হারিয়ে ফেললাম আমরা।
যদিও মাঝেমধ্যে তাঁকে খুঁজে পেয়েছি এ-দিক ও-দিক। কিন্তু সেই ‘চক দে ইন্ডিয়া’র কবীর খান কিংবা ‘ফ্যান’য়ের গৌরব চান্নাকে তো আর রোজ দেখা যায় না!
সুতরাং যখন জানা গেল এত দিন পর আবার একসঙ্গে দেখা যাবে শাহরুখ ও প্রযোজক কর্ণকে, তখন উত্তেজনা চাপতে পারিনি। আর পরিচালকের নাম যখন গৌরী শিন্ডে তখন মনে হয়েছিল জিন্দেগি তুমি সত্যিই সুন্দর!
কিন্তু দু’ ঘণ্টা তিরিশ মিনিট ধরে ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল শাহরুখ-কর্ণ জুটির কামব্যাকের মঞ্চটা বোধহয় অন্যভাবে হলে ভাল হতো।
বারবার মনে হচ্ছিল যে জুটির কাছ থেকে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘কভি খুশি কভি গম’ পেয়েছি সেই জুটির রি-ইউনিয়ন কী করে ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ হতে পারে?
হল-য়ে ঢোকার আগে ছবির পোস্টারে শাহরুখ আলিয়ার ছবি দেখে ভাবছিলাম যে, অনেক দিন পর কিঙ্গ খানকে এত সুন্দর দেখতে লাগছে পর্দায়। চাপ দাড়ি, ছেঁড়া জিনস...এত হ্যান্ডসাম যেন তাঁকে কোনও দিন লাগেনি। সঙ্গে আবার এই সময়ের অন্যতম পাওয়ারফুল অভিনেত্রী আলিয়া ভট্ট।
কিন্তু দর্শনধারী যে সব সময় গুণবিচারী হয় না, সেটাই আরেক বার বোঝাল এই ‘...জিন্দেগি’। পর্দায় নিজের প্রিয় অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও ছবি দেখে মন ভরল কই?
এবং সত্যি কথাটা লিখেই ফেলি। এই ছবিতে শাহরুখের চেয়েও আমার বেশি ভাল লেগেছে আলিয়াকে।
মাত্র তেইশ বছর বয়স, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে যেন নিজেকে অন্যভাবে গড়ছেন আলিয়া। না হলে কে আর ভেবেছিল শাহরুখের মতো সুপারস্টারকেও ছাপিয়ে যাবেন মহেশ ভট্ট কন্যা? কয়েকটি দৃশ্যে শাহরুখকেও মিডিওকার লেগেছে আলিয়ার সামনে।
যে ছবির গল্প কেরিয়ার-সচেতন এক ইয়ং সিনেমাটোগ্রাফারকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ হাজির হয় মন খারাপ। তার ওপর যোগ হয় সমাজ নামের বস্তুটি, যেখানে ‘সিঙ্গল’ মহিলা মানেই বাড়ির কাকিমার কপালে ভাঁজ কিংবা মামার কৌতূহল, ‘তুমি লেসবিয়ান নও তো?’
তবে এ সবের মাঝেও আলিয়া অর্থাৎ কায়রা-র বয়ফ্রেন্ডের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একজন হোটেল মালিক তো একজন হ্যান্ডসাম পরিচালক। এবং নিজের পেশা সামলে কায়রা চায় রঘুবেন্দ্রর (কুনাল কপূর)য়ের সঙ্গে সেটল করতে, নিউইয়র্কে ফিল্ম শ্যুট করতে।
এই ছটফটে, ফুল অব এনার্জি-র আলিয়াকে আমার দারুণ লেগেছে। যে মেয়ে অনায়াসে অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কের কথা নিজের বয়ফ্রেন্ডকে জানাতে পারে, দুনিয়ার নিয়মগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঁচতে পারে, সেই মেয়েকে তো কুর্নিশ করতেই হয়।
তবে গল্পের খাতিরে, কায়রা-র সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙে রঘুবেন্দ্রর। মুম্বইয়ে থাকা কায়রা ফিরে যায় গোয়ার বাড়িতে। এবং এখানেই হাজির হন আমার প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ।
ডক্টর জাহাঙ্গির খান। মনোবিদ।
যাকে দেখে হল-য়ে সিটি। পাশে বসা তরুণীর উত্তেজিত চিৎকার। সেই ডক্টর জাহাঙ্গির খান আমাকে চূড়ান্ত হতাশ করেছেন। চকচকে ঘরে বসে রোগীর সঙ্গে কথা বলছেন মনোবিদ — এই দৃশ্য হলিউডে দেখা গেলেও আমাদের দেশে দেখা যায় না। এবং সেই কারণে বোধহয় একজন ডক্টরের সঙ্গে শাহরুখকে মেলাতে পারবেন না সাধারণ দর্শক। ছবি খারাপ লাগার এটাও একটা বিরাট কারণ।
গোটা ছবি জুড়ে মনোবিদ শুধু কথা বলে গেলেন। এবং তাতেই একজন মানসিক বিষাদগ্রস্ত রোগী সুস্থ জীবনে ফিরল। এটাই বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি। প্রথম থেকেই, মনের বিষয়গুলোকে এত সহজ করে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে ডক্টর খানের চরিত্রটি।
এবং বোধহয় সে কারণে শাহরুখ আলিয়াকে কবাডি খেলতে দেখে মনে হচ্ছিল এ সব বাস্তবে হয় নাকি!
আর যে ছবির বিষয়ই মন, সেখানে এত সাজানো গোছানো সংলাপ কেন? সব কিছু এত মেপে মেপে দেখানোর চেষ্টাই বা কেন?
আমি শাহরুখ ও গৌরী শিন্ডের কাছে কৃতজ্ঞ আলিয়ার চরিত্রটাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। কিন্তু ছবিতে কয়েকটা স্মার্ট পাঞ্চলাইন থাকলে কি খুব ক্ষতি হতো?
‘ইংলিশ ভিংলিশ’-য়ে যে স্মার্টনেসটা দেখেছিলাম সেটা এখানে পেলাম না যে!
সিনেমা দেখতে দেখতেই লেখাটা তৈরি করছিলাম ফোনে। নিজের অজান্তে আলিয়ার জায়গায় জেনিফার লরেন্সের নাম লিখে ফেলেছি। এবং এখন মনে হচ্ছে খুব ভুল লিখিনি। এই অল্প বয়সে যেভাবে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ভাঙছেন, তাতে আলিয়া আমার কাছে ভারতীয় জেনিফার।
আর গৌরী শিন্ডে, আপনার ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু ‘ডিয়ার জিন্দেগি’-র গল্প এত দীর্ঘ কেন?
ছোট করে একটা মিষ্টি কবিতাও তো লেখা যেত।
ভাল শুরু করেও কিছু ছবি তার দরদ হারিয়ে ফেলে। ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ তেমনই এক উদাহরণ। আজ বারবার মনে হচ্ছে, প্রিয় ঋতুপর্ণ ঘোষ, ডায়ালগ ভিত্তিক ছবির আসল মাস্টার রয়ে গেলেন সেই আপনিই।
এরকম একটা বিষয় আপনার হাতে পড়লে সত্যিই সিনেমা হয়ে বেরিয়ে আসত।
আর শাহরুখ, আপনি যা নন জোর করে তা করতে যাওয়ার দরকার কী ছিল!