গৌরব চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
ছোটবেলায় দাদুকে পাননি। কিন্তু ছোড়দাদুকে মঞ্চে অভিনয় করতে দেখেছেন। তবুও অভিনয় কেরিয়ারের শুরুতে সঠিক পথ দেখানোর জন্য কাউকে সে ভাবে পাননি। মহানায়কের নাতি হওয়ার পরেও সংগ্রাম চালাতে হয়েছে গৌরব চট্টোপাধ্যায়কে। শুধু ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জমি শক্ত করাই নয়, আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়েও যেতে হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে বাংলা সিরিয়ালের অন্যতম চর্চিত নায়ক। তার মাঝে বড় পর্দায়ও বেশ কিছু সিনেমা করে ফেলেছেন। কিছু দিন পরেই মুক্তি পাবে গৌরবের নতুন ছবি ‘কীর্তন’। ইন্ডাস্ট্রিতে ১৫ বছর কাটিয়ে ফেলার পরও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন মাঝেমাঝে। সিরিয়ালের পাশাপাশি সিনেমার শুটিং চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সঙ্গে আবার রয়েছে জিম, সাইকেল চালানো— নিজের দিনগুলো কী ভাবে সাজান অভিনেতা? ১৫ বছরের চড়াই-উতরাইয়ের মুহূর্তগুলো আনন্দবাজার অনলাইনের ফোন রেকর্ডারের সামনে অনর্গল বলে চললেন গৌরব।
প্রশ্ন: ২০০৫ সালে আপনার প্রথম সিনেমা ‘ভালবাসার অনেক নাম’ মুক্তি পেয়েছিল। দাদু উত্তমকুমার। বাড়ির পরিবেশের কারণেই কি এই পেশা বেছে নেওয়া?
গৌরব: না, একেবারেই না। আমার বাবা-কাকাদের মধ্যে কেউ কিন্তু এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ছোড়দাদুকে (তরুণকুমার) দেখেছি যাত্রা, নাটক, সিনেমা করতে। কিন্তু একটা ফাঁক তো হয়ে গিয়েছিল। তাই তেমন পরিবেশ পাইনি। আমি যখন দ্বাদশ শ্রেণিতে, তখন একটি ফোন পাই তরুণ মজুমদারের থেকে। তার এক বছর আগেই বাবাকে হারিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: আপনার বাবা কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
গৌরব: বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল, ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মজার বিষয় হল তেমন ভাবে কিছু করে উঠতে পারেননি। আসলে একটা বড় ছাতার তলায় ছিলেন তো। আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর্থিক সমস্যাও ছিল অনেক। সে সব সামলাতে গিয়েই বাবার জীবন কেটে যায়। পরে অবশ্য ক্যানসার ধরা পড়েছিল।
প্রশ্ন: উত্তমকুমারের নাতিকেও আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে!
গৌরব: হ্যাঁ। দুর্গাপুজোর সময় নতুন জামাকাপড় হবে কি না ভাবতে হত। এক বছর হলে তার পরের বছর কোনও জামা হত না। তবে বাবা চেষ্টা করতেন। টাকা ধার করেও আমাদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আসলে তখনকার শিল্পীদের এত ব্যবসাবুদ্ধি ছিল না। ফলে প্রচুর টাকাপয়সা থেকে যাবে, এমন ছিল না। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি আমরা। আমি জীবনের সংগ্রামটা দেখেছি।
গৌরব চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: প্রথম ছবির পর কিন্তু অনেক দিন আপনাকে দেখা যায়নি। বেশ অনেক দিন পরে ‘দুর্গা’ সিরিয়ালটি করেছিলেন। মাঝে কেন দেখা যায়নি আপনাকে?
গৌরব: ২০০৫-এ আমি তো তখন স্কুলে পড়তাম। তিন বছর পর আমার কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ চলছিল। তখন আবার ‘দুর্গা’ সিরিয়ালের প্রস্তাব পাই। তাই মাঝে বেশ কিছু বছর আমায় দেখা যায়নি। তবে সিরিয়াল আমায় অনেক কিছু দিয়েছে। সিরিয়ালের জন্য যে নিজের খরচ চালানোর ক্ষমতা হয়েছিল, সেটা ভেবেই ভাল লাগত।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসাবে নিজেকে কবে থেকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করলেন?
গৌরব: প্রথম সিরিয়াল শেষ হওয়ার পর থেকে বলতে পারেন। তবে অনেক সময় আমার মনে হয়, আমরা কাজকে বেছে নিই না। উল্টে কাজই আমাদের বেছে নেয়। আমরা অনেকে হয়তো স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেটা না হয়ে অন্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। আমি অভিনয় করার কথা সে ভাবে কখনও ভাবিনি। এটা হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: উত্তমকুমারের নাতি হিসাবে তো আপনার অনেক সমালোচনাও হয়েছে। বিশেষত আপনার লুক, শারীরিক গঠন নিয়ে। কী ভাবে নিজেকে সামলেছিলেন?
গৌরব: প্রথম কাজের পর প্রভাব তো ফেলেছিল। সেটা কাটিয়ে উঠতে কিন্তু আমায় সিরিয়ালই সাহায্য করে। প্রতি দিন আমায় দেখতে দেখতে দর্শকের ভাল লাগতে শুরু করে। তখনই উত্তমকুমারের নাতি থেকে তাঁরা আমায় চরিত্রের নামে ডাকতে শুরু করেন। এখন তো গৌরব নামেই সবাই চেনেন। তবে দাদুর ছায়া থেকে বেরোতে সাহায্য করেছিল সিরিয়াল।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে পরিবারের যোগ থাকতেও সংগ্রাম করতে হয়েছে বললেন। এত যে নেপোটিজ়মের চর্চা, সেগুলো কি তবে ভুল?
গৌরব: দিনের শেষে মান বিচার করা হয়, আপনি কতটা ব্যবসা দিতে পারছেন তার নিরিখে। প্রযোজক মা-বাবা, দাদু-ঠাম্মার নামের জন্য কিন্তু নেবে না। দিদির জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমার বাবা। তখন আমি স্কুলে পড়তাম। অনেকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। দু-একটা কাজ করেছিল আমার দিদি। কিন্তু সব সময় যোগাযোগ দিয়ে হয় না। আমার বাবা অবশ্য অনেক দিন ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূরেও ছিলেন। তাই তেমন যোগাযোগও ছিল না। আমিও কিন্তু তেমন সাহায্য পাইনি।
গৌরব-দেবলীনা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনি সিনেমাতে অভিনয় করছেন। আবার সিরিয়ালও চলছে। দুই ধরনের অভিনয় একই সময়ে করেন কী ভাবে?
গৌরব: আমি একটা সেতু তৈরি করে রাখার চেষ্টা করি। প্রথমত সিরিয়ালে অনেক সময় অবাস্তব জিনিস দেখানো হয়, যা আমি কখনও করি না। এক দিকে আমি যেমন অভিমন্যুর ‘কীর্তন’ সিনেমায় অভিনয় করেছি, অন্য দিকে তখন আমি ‘গাঁটছড়া’ সিরিয়ালেও অভিনয় চালিয়ে গিয়েছি। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে অভিনয় করাই তো অভিনেতাদের কাজ।
প্রশ্ন: আপনি কি কোথাও অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন?
গৌরব: না, আমি তেমন ভাবে শিখিনি। তবে নাটক করেছি। দাদু যেখানে যাত্রা করতেন সেখানে যাত্রা করেছি।
প্রশ্ন: সিরিয়ালে তো ১৪ ঘণ্টা ডিউটি। তার পর কী ভাবে সময় বার করলেন সিনেমার জন্য?
গৌরব: অভিমন্যু (মুখোপাধ্যায়) আমায় খুব পছন্দ করে। শেষ মুহূর্তে বললে আমি ‘না’ করে দিই। কারণ, তারিখ বার করা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু ও বেছে বেছে অন্য সব ডেট ঠিক করে পাঠায়। তখন আমি আর ‘না’ করতে পারি না। খুব ভাল মানুষ ও। আমার মনে হয়, অভিমন্যু ইন্ডাস্ট্রির আন্ডাররেটেড পরিচালক।
প্রশ্ন: আপনার মতে ওভাররেটেড পরিচালক কে এই ইন্ডাস্ট্রিতে?
গৌরব: ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন তেমন অনেকে। তবে নাম বলা তো যাবে না। হ্যাঁ, অনেকের ছবি দেখেই আমার মনে হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার কেরিয়ার গতি নিয়েছে ধীরে ধীরে। কখনও মনে হয় যে, সিরিয়ালে অভিনয় না করলে হয়তো অনেক আগে বড় পর্দায় সফল হতে পারতেন?
গৌরব: সব কিছুর সময় আছে। প্রথম ছবি হিট করেনি। আস্তে আস্তে এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে দাঁড় করিয়েছি। আমার তো মনে হয়, এখনও আমার সময় হয়নি। আরও পাঁচ বছর পরে আসবে। সব সময় প্রার্থনা করি সকালে উঠে যেন আমায় ভাবতে না হয় যে, আজ কী কাজ করব। প্রতি দিন যেন ব্যস্ত থাকতে পারি।
প্রশ্ন: ব্যর্থতাকে কী ভাবে সামলান? তা ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্কে ব্যর্থতা হোক কিংবা পেশাদার জীবনে।
গৌরব: কোনও কারণে সম্পর্কে ব্যর্থ হলে সেই কাজটা পরবর্তী কালে না করার চেষ্টা করি। তবে পেশাদার জীবনের ব্যর্থতা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই না।
প্রশ্ন: আপনি কি সত্যিই গম্ভীর, বেশি কথা বলেন না?
গৌরব: আমি চুপচাপ থাকতেই ভালবাসি। লোক দেখলেই ভয় লাগে, এই কথা বলতে হবে। আর তাই তেমন ভাবে নিজের প্রচারও করতে পারি না।
প্রশ্ন: শেষ কয়েক বছরে আপনি অনেক বেশি শরীরচর্চায় মন দিয়েছেন। নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার কথা কবে মনে হল?
গৌরব: আমি হস্টেলে বড় হয়েছি। ফলে রুটিন মেনে চলা এমনিতেই অভ্যাস। আর মানুষের জীবনের এক একটা সময় আসে। আমারও তেমনই। ৩০ বছর বয়স হওয়ার পর মনে হয়েছিল, আমায় হয়তো আর কেউ হিরো হিসাবে নেবে না। নিজেকে ধরে রাখতে হবে। তখনই এ সব শুরু করি। ধীরে ধীরে ভালবাসা তৈরি হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন?
গৌরব: হ্যাঁ, কিছুটা নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। আমার একটা কথা খালি মনে হয়, আমি যদি কখনও কোনও কাজে ব্যর্থ হই, সেটা যেন আমার নিজের কোনও অক্ষমতার জন্য না হয়।
প্রশ্ন: আপনার শ্বশুরমশাই তো দেবাশিস কুমার। রাজনৈতিক দলের নেতাও। বিয়ের আগে চাপ হয়েছিল?
গৌরব: বিয়ের আগে শ্বশুরমশাই হিসাবে ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই। তবে মিশে দেখলাম মানুষটা খুব মিষ্টি এবং ভাল। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে এমন একটি ভাল পরিবার পেয়েছি।