প্রসেনজিৎ
মোটা গোঁফ, চুলের দৈর্ঘ্যও বেশি, মাথায় হেডব্যান্ড। ছবির কারণে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের এই লুক এবং গ্ল্যামারের পাল্লা তাতে আরও ভারীই হয়েছে। বালিগঞ্জের বাড়িতে লাঞ্চের পর সোফায় আরাম করে বসলেন আড্ডা দিতে...
প্র: এই লুকে আর কত দিন?
উ: ছবি অনুযায়ী আমার লুক, বডি পালটে যায়। পরিচালকরা মজা করে বলে, ‘তোমাকে যে কেমন দেখতে, সেটাই ভুলে গেছি!’ আসলে গত সাত-আট বছরে সিনেমার ভাষাটাই পালটে গিয়েছে। প্রসেনজিৎ থাকা মানেই দর্শকের অন্য রকম প্রত্যাশা। নিজেও ভাবতে থাকি, আর কী? কোন জিনিসটা বদলাব?
প্র: ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত লাগে না?
উ: ৩৪-৩৫ বছর হয়ে গেল! নাহ, একদমই ক্লান্ত লাগে না। আমাকে বলাই হয় এনার্জি ট্যাবলেট। জুনিয়ররাও সেটে আমার এনার্জি লেভেলের সঙ্গে ম্যাচ করতে ভয় পায়। আসলে একটা জিনিসই আমি ভালবাসি, সিনেমা। এর বেশি কিছু বুঝতেও চাই না। সিনেমাকে এত ভালবাসি বলেই আমার কোনও অবসর নেই। ২৫ বছর আগেও ছুটি কাটাতে যেতে পারতাম না, আজও পারি না। কাজের মজাটা যে দিন চলে যাবে, সিনেমা ছেড়ে দেব।
প্র: তা হলে ক্লান্তি কাটান কী ভাবে?
উ: (একটু ভেবে) ১৫-২০ বছর ধরে লম্বা ছুটি নিইনি। এ বার অবশ্য দশ-বারো দিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি মস্কোয়। ও আবার শুধু ফুটবলটাই বোঝে। তাই ভাবলাম, ওকে এমন একটা জিনিস দেখিয়ে দিই, যা সারা জীবন মনে রাখবে। এ রকমও হয়েছে, কোথাও বেড়াতে গিয়েছি, তিন দিন পর অর্পিতা বলছে, ‘মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি টালিগঞ্জে আছো। তার চেয়ে তুমি ফিরে যাও।’ আজ আমি শুধু অভিনেতা বা প্রযোজক নই, একটা নতুন দায়িত্বও যোগ হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিতে কারও সঙ্গে কারও ঝামেলা হলে সবাই ধরে নেয় ‘বুম্বাদা আছে’। মহরত হোক বা বিয়ে, এক বার যেতেই হবে। এখন আমার জায়গাটা অভিভাবকের মতো। এই সম্মানটা বড় পাওয়া।
প্র: লাইমলাইট থেকে সরে যাওয়ার অর্থ কি নিখাদ অন্ধকার?
উ: ওই জোন থেকে বেরোনোর সবচেয়ে বড় কষ্ট কী জানেন? গ্ল্যামার নয়। লোকের সিটি! হলের মধ্যে উত্তেজনা... ‘এ বার তো গুরু ঢুকবে’! এই প্রলোভন ছাড়া খুব কষ্টকর, যদিও একটা সময়ের পর নতুন প্রজন্মকে ওই জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছি। আমার প্রত্যেকটা কাজের প্ল্যানিং অনেক আগে থেকে হয়। তাই নিজের ব্র্যান্ডকে ধরে রেখে ভিন্ন ধরনের কাজ করে যাচ্ছি। রিপিট করে গেলে ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী।
প্র: ‘দৃষ্টিকোণ’ আপনাকে নতুন কী দিয়েছে?
উ: এক তো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি। দ্বিতীয়, আমি-ঋতু একসঙ্গে কাজ করলে ছবির বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ হওয়া চাই। প্রেমের ছবি হলেও লোকে যেন বলে, ‘এটা এরা দু’জনই পারে!’
প্র: পিছনে ফিরে তাকালে এমন কিছু মনে পড়ে, যার জন্য অপরাধবোধ বা অনুশোচনা হয়?
উ: ভাল করে ভাবলে হাজার ঘটনা মনে পড়বে। অনেকে বলেন, আমি প্রচুর মানুষের ক্ষতি করেছি। অনেককে দাঁড়াতে দিইনি। তবে সজ্ঞানে এমন কিছু করিনি, যাতে কারও আর্থিক ক্ষতি হয়। এটাই আমার শক্তি। অন্যায় করলে, সবচেয়ে আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই তা বলতে পারব। ভুল আমি করেছি, যা না করলেও পারতাম। অল্প বয়সের ইগো কাজ করেছে তখন। কিন্তু কারও ক্ষতি করিনি। তাই আপস করিনি।
প্র: পথ চলতে গিয়ে আপনিও নিশ্চয়ই বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তার থেকে পাওয়া কোনও শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যেতে চান?
উ: কেউ খুব অপমান করলে স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, প্রতিশোধ নেওয়ার। স্ট্রাগল পিরিয়ডে আমাকে যাঁরা লাঞ্ছনা করেছেন, পরে তাঁরাই আমাকে বলেছেন, ‘তুই রাজি হলে প্রযোজক ছবিটা করবে।’ আমি পাঁচ মিনিট সময় নিইনি ‘হ্যাঁ’ বলতে। প্রতিশোধ নেওয়া মানে ক্ষতি করা নয়। বিবেককেও নাড়িয়ে দেওয়া।
প্র: পরিবার কি আপনাকে তাঁদের প্রয়োজনে পেয়েছে?
উ: একেবারেই না। আমার চেয়ে খারাপ স্বামী, খারাপ বাবা পৃথিবীতে হতে পারে না। তার পরেও যারা আমার সঙ্গে রয়েছে, এটা তাদের কৃতিত্ব। তারাও বুঝে গিয়েছে, এই মানুষটা সকাল থেকে রাত অবধি কাজ আর ইন্ডাস্ট্রির বাইরে কিছু ভাবে না। আবার আমি এটাও জানি, মিশুকের এখন চোদ্দো বছর বয়স। এই চোদ্দো বছরে অর্পিতা ওর জন্য একটা রুমালও কেনেনি। সবই আমার কেনা। শো অফ করতে পারি না আমি। মিশুক হস্টেল থেকে এলে ওর সঙ্গে আমার ছুটি কাটানো হয় না। কিন্তু দায়িত্ব আমিও পালন করি। ওর সঙ্গে শপিং করতে যাই। মিশুকের কিছু প্রয়োজন হলে আমাকেই বলে। এই চারতলা বাড়িটার কোথায় কী আছে অর্পিতা জানে না। ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ওটা কোথায় আছে গো?’ তা হলে বলুন, আমি সংসারী নই?
প্র: উত্তমকুমারের অভিনীত চরিত্রে আপনাকে বারবারই দেখা গিয়েছে!
উ: আসলে মানুষটা বটগাছের মতো! ক্রমশ পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে প্রস্তাবগুলো এসেছে। আমরা ওই ছবিগুলো কেন ছোঁব না? সৌমিত্রজেঠুকে বলেছিলাম, আমাকে যদি কেউ ‘কোনি’ অফার করে, তোমার মতো করব না। কিন্তু ফাটিয়ে দেব! এই ধরনের বিষয়গুলো তো নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছতে হবে। মানুষ অযথা বিতর্ক তৈরি করে। তারা তো জানে না, উত্তমজেঠুর পুরো পরিবার আমার ভীষণ আপন। আমার বাড়ির লক্ষ্মীপুজো সেরে অর্পিতা ওই বাড়িতেই ছোটে।
প্র: এত কাজ, দায়িত্ব... রাতে ঘুমোতে পারেন আপনি?
উ: (কিছুক্ষণ ভেবে) সত্যি কথা বলব? দশ-বারো বছর আগে আমি দিনে দু’ঘণ্টা ঘুমোতাম। এটা একটা লম্বা ফেজ গিয়েছে। তখন শুটিং করতাম আঠেরো ঘণ্টা। এখন চাপ আছে, কিন্তু দেখানোর কিছু নেই। তাই ছ’ঘণ্টা ঘুমোই। রাতে ফিরে দু’-আড়াই ঘণ্টা জিম করি। সাড়ে এগারোটা নাগাদ একটা সিনেমা দেখবই। তার পর ঘুম। এখন আমার চাপ সম্মানটা ধরে রাখার। একটা সময় ছিল, যখন ভাবতাম দৌড়ে পৌঁছতে পারব তো? সেটা আর নেই। নিজেকে চাপমুক্ত রাখাটাও শেখা দরকার। বড় বাড়ি, গাড়ি সকলেই চায়, কিন্তু তার জন্য এমন কিছু কোরো না, যার জন্য কেরিয়ারে আপস করতে হয়। ফাইনালি একটা জিনিসই কাজ করে। সিনেমা।