বনির লড়াইয়ে রজত কমল

এক সময়ের নামী ফুটবলার বন্দনা পাল। হঠাৎই পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বন্দনার জীবনযুদ্ধ নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র জেতে জাতীয় পুরস্কার। তিন পরিচালকের একজন ফারহা খাতুনের কথা শুনলেন বিশ্বসিন্ধু দেবন্দনা ওরফে বনি পালের সমাজে টিকে থাকার লড়াই নিয়ে এই ছবি। তখন অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিককে নিয়ে বেশ লেখালিখি হচ্ছে। একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে পিঙ্কিকেও। বনিকেও যেতে হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ০২:০৮
Share:

সম্মান: জাতীয় পুরস্কার নিচ্ছেন ফারহা। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: বন্দনা পালকে নিয়ে তথ্যচিত্র কেন?

Advertisement

উত্তর: বন্দনা ওরফে বনি পালের সমাজে টিকে থাকার লড়াই নিয়ে এই ছবি। তখন অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিককে নিয়ে বেশ লেখালিখি হচ্ছে। একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে পিঙ্কিকেও। বনিকেও যেতে হয়েছে। ওর লড়াইটাকে তুলে ধরতে চেয়েছি। নারী-পুরুষ ছাড়া অন্য কোনও লিঙ্গ পরিচয় থাকার কারণে কেউ হারিয়ে যাক ভাবতে কষ্ট হয়।

Advertisement

প্রশ্ন: কবে থেকে শুরু কাজ?

উত্তর: কাজ শুরু করেছি কলেজে পড়ার সময় থেকে। শুরুতে ভেবেছিলাম সাংবাদিক হব। তাহলে অনেক কথা বলা যাবে। পরের দিকে মনে হয় তথ্যচিত্রের মাধ্যমে আমি আমার কথা আরও ভাল করে বলতে পারব। তাই তথ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হই। বনিকে নিয়ে শ্যুটিং করেছি ২০১২ সাল থেকে। শেষ করেছি ২০১৫ সালে। বনির উপর তথ্যচিত্র করতে গিয়ে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক কিছু শিখেছি।

প্রশ্ন: বনির সঙ্গে আলাপ কেমন করে? উনি রাজি হলেন?

উত্তর: আমার সঙ্গে অতটা পরিচয় ছিল না। একদিন শতরূপা সাঁতরা ও সৌরভকান্তি দত্ত মিলে আলোচনা করি। তারপর কাজে নামা। ওদের পরিচিত ছিল। এখন বনি ভাল বন্ধু।

প্রশ্ন: বনি তো অজ্ঞাতবাস ছিলেন? কোথায় আবিষ্কার করলেন ওঁকে?

উত্তর: খোঁজাটা ছিল অদ্ভুত। প্রথমে শিলিগুড়িতে ওর সন্ধান পাই। যদিও কেউ ওর খোঁজ দিতে চাননি। একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। তিনিই কথায় কথায় বলেন। তবে বনিকে ফোন করে জানতে চান আমরা তার পরিচিত কিনা? তার পরেই তো দেখা হল। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে ওর জীবন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারি।

প্রশ্ন: কোথায় শ্যুটিং করেছিলেন?

উত্তর: শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া, গোবরডাঙা, দার্জিলিঙে শ্যুটিং হয়।

প্রশ্ন: আপনাদের তথ্যচিত্র প্রথম কোথায় দেখানো হয়?

উত্তর: অন্যান্য ছায়াছবির মতো তথ্যচিত্রের সেভাবে মুক্তি তো হয় না। প্রথম লন্ডনের ‘বিএফআই ফ্লেয়ার: এলজিবিটিকিউপ্লাস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ দেখানো হয়। তারপর থেকে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানান।

প্রশ্ন: কীরকম প্রতিক্রিয়া?

উত্তর: অনেকেই বনির মতো মানুষের প্রতি খারাপ আচরণ করেন। তাঁরা কী না বলেন! এই ধরনের মানুষদের হিজড়ে, ছক্কা বলে অপমান করা হয়। কিন্তু বনির প্রতিভাকে তাঁরা দেখেননি। অনেকেই তথ্যচিত্রটি দেখে কেঁদেছেন। যাঁদের এসব প্রতিদিন সহ্য করতে হয় তাঁরাও কেঁদেছেন। আমাদের ফোন করে বলেছেন। এটাই তো আমাদের তিনজনের বড় প্রাপ্তি।

প্রশ্ন: আপনারা তিনজন পরিচালক ছিলেন। কিন্তু পুরস্কার নিতে দেখা গেল শুধু আপনাকেই?

উত্তর: এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনেকেই বয়কট করেছেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি পুরস্কার তুলে দিয়েছেন। আমি যে সংস্থায় কাজ করি তাকে অসম্মান করতে চাইনি। তবে যাঁরা পুরস্কার নেননি তাঁদের সম্মান করি।

প্রশ্ন: জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার দিনটা কেমন ছিল?

উত্তর: দিনটা খুবই কষ্টের ছিল। যে দুই বন্ধুর সঙ্গে চার বছর ধরে একটা কাজ এক সঙ্গে করেছি তাদের ছেড়ে যেতে হয়েছে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি ওই সময়ে। তবে সৌরভদা, শতরূপাদি সবসময় আমাকে সমর্থন করেছে। ওরা আমাকে বুঝিয়েছে।

প্রশ্ন: সৌরভকান্তি আর শতরূপার সঙ্গে পরিচয় হল কী ভাবে?

উত্তর: সৌরভকান্তি আমার পরিচিত ছিল। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে শতরূপার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওরা আমার থেকে অনেক সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কখনও বুঝতে দেয়নি যে আমি নতুন। ওদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

প্রশ্ন: ‘বেস্ট নন ফিচার ফিল্ম অন সোশ্যাল ইস্যুস’ হিসেবে ‘বনি’ রজতকমল পুরস্কার পেয়েছে এ বছর। এ ছাড়া আর কী কী পুরস্কার পেয়েছেন?

উত্তর: আরও কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছি। তবে পুরস্কার বড় কথা নয়। কাজ করে সফল হয়েছি। বনি তার বাড়ি ফিরে পেয়েছে। নতুন করে জীবনযাপন করতে পারছে এটাই তো বড় পুরস্কার।

আরও পড়ুন: মাথা গোঁজার ঠিকানার খোঁজে বনি

প্রশ্ন: বাবা সেখ রহিমউদ্দিন। মা নাজমা বিবি। বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদা। সেখান থেকে উঠে আসার যাত্রাটা কেমন?

উত্তর: বেলদা গঙ্গাধর অ্যাকাডেমী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। বেলদা কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক। পরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়া শেষ করতে পারিনি। তখন ২০০৯ সাল। কলকাতার রূপকলা কেন্দ্রে ভর্তির জন্য আবেদন করি। পেয়ে যাই। সেখান থেকেই ডিপ্লোমা করি। মূলত বিভিন্ন ছবির এডিটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। পরে ছবি করার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ি।

প্রশ্ন: জেলার মেয়ে হয়ে এই যে লম্বা দৌড়, কতটা সম্ভব ছিল?

উত্তর: প্রতিবন্ধকতা ছিল। আমাদের ঘরের মেয়েরা পড়াশুনো করে উচ্চ শিক্ষিত হবে এই ভাবনাই ছিল না। সেই মানসিকতার বিরুদ্ধে একটা লড়াই ছিল। বাবার অতটা আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। সামান্য গুদাম ছিল। তবে অনেকের সমর্থন পেয়েছি। বন্ধু বনমালী সরকার ও শিক্ষক বিজনবাবুর, বিজন ষড়ঙ্গী। কলেজে পড়ার সময় ২০০৭-২০০৮ সাল নাগাদ নতুন বিষয় আসে কলেজে। সাংবাদিকতা নিয়ে ভর্তি হই। তখন থেকেই তথ্যচিত্র তৈরি করার স্বপ্ন। তথ্যচিত্র বিভাগ নারায়ণগড়ে লোধা-শবরদের নিয়ে তথ্যচিত্র করেছিল। তাঁদের দৈন্য ও ভিন্ন জীবনাচার দেখেছি। আমি অনুপ্রেরণা পাই। তথ্যচিত্র করার জন্য কলকাতায় আসি। তিনদিন ছিলাম।

প্রশ্ন: তারপর?

উত্তর: তারপর ওই যে বললাম কলেজ শেষ করে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেই সময় কলকাতার রূপকলা কেন্দ্রের সন্ধান পাই। আবেদন করি আর সুযোগ হয়ে যায়। ডিপ্লোমা করার পর, কোর্সে মূলত সম্পাদনার কাজ শিখেছি। মুম্বইয়ে কাজ করেছি ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। পরে ফিল্ম ডিভিশন অব ইন্ডিয়ায় এডিটিংয়ের কাজে যুক্ত হয়ে কাজ করছি।

প্রশ্ন: কলকাতা থেকেই পরিচিতির গণ্ডিটা বাড়তে থাকে?

উত্তর: হ্যাঁ। পরিচয় হয়েছে মিতা চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল ঘোষ, সুচরিতা বর্ধনদের সঙ্গে। কাজ করেছি সুস্মিতা সিনহা, অদিতি রায়, ও দেবলীনার সঙ্গে।

প্রশ্ন: তথ্যচিত্র ‘এবং বেওয়ারিশ’। নন্দীগ্রামের দুই মেয়ের ভালবাসার গল্প। একজন বিবাহিত ছিল। সমাজ মেনে নেয়নি তাঁদের সম্পর্ক। দু’জনে আত্মহত্যা করেন। তাঁদের দেহ মর্গ থেকে নিতে যাননি পরিবারের সদস্যেরা। ঘটনাটি সেই সময়ে নাড়া দিয়েছিল।

উত্তর: হ্যাঁ। ওই ঘটনা নিয়েই তৈরি ‘এবং বেওয়ারিশ’। পরিচালক দেবলীনা। আমি এডিটিংয়ে যুক্ত ছিলাম। এডিটর অভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রশ্ন: এরপর ‘আই অ্যাম বনি’, ‘দ্য জাঙ্গল ম্যান-লোইয়া’ এরকম অনেক তথ্যচিত্রের পরিচালনা। পরের কাজ?

উত্তর: আরও দু’টো তথ্যচিত্রের কাজ করার ভাবনা রয়েছে। একটি হল, কলকাতায় ভিস্তিওয়ালাদের জীবন নিয়েই। ওঁরাই আগে জল পৌঁছে দিতেন বাড়িতে বাড়িতে। আজ তাঁদের কোনও কাজ নেই। এখন তাঁরা কেমন আছেন? এরকম অনেকগুলো কাজের সম্পাদনার কাজ চলছে। ফিল্ম ডিভিশনের কয়েকটা তথ্যচিত্রে সম্পাদনার কাজ চলছে।

প্রশ্ন: বনির সঙ্গে দেখা হয়?

উত্তর: না, এখন দেখা হয় না। ফোনে মাঝে মধ্যে কথা হয়। ও ভাল বন্ধু। বনি নিজেকে নিয়ে তথ্যচিত্রটা করতে না দিলে এই সাফল্য আসত না। ও ভাল থাকুক। পিঙ্কি, বন্দনার মতো মানুষগুলো ভাল থাকুক। তারাও তো মানুষ। তাদের মধ্যেও প্রতিভা আছে। আমি চাই, সেই প্রতিভাকে বিভাজন করে যেন গলা টিপে মারা না হয়।

প্রশ্ন: শুধু এডিটিং, পরিচালনা নাকি অভিনয়েও ফারহা সমান দক্ষ?

উত্তর: দক্ষ কিনা জানি না। সেটা দর্শক বলবেন। যেটা করি মন দিয়ে করার চেষ্টা করি।

প্রশ্ন: ‘আবার যদি ইচ্ছে কর’-এটাতে আপনি অভিনয় করেছেন? স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই ছবিটি কীরকম?

উত্তর: ছবিটা বেঁচে থাকার গল্প, ভালোবাসার গল্প। ছবির প্রয়োজনে মাঝে মাঝে অভিনয় করতে হয়।

প্রশ্ন: পুরস্কার পাওয়ার পরে স্কুল-কলেজের বন্ধুরা কী বলছেন?

উত্তর: ওরা খুব খুশি। তবে পুরস্কার পাওয়ার পরে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অনেক বেড়ে গিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement