অপর্ণা যখন পরিচালকের ভূমিকায়। নিজস্ব চিত্র।
রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়, এরপর ‘ঘরে বাইরে আজ’। এটা কি বলা যায় যে পরম্পরার সূত্র গাঁথা রইল?
রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায়, দু’জনকেই আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। আমাদের রক্তস্রোতে তাঁরা মিশে আছেন।তাঁদের জন্য প্রগাঢ় ভালবাসা আর শ্রদ্ধাও আছে আমাদের, তাই আমার মনে হয় তাঁদের নিয়ে সমালোচনার অধিকারও আমাদের আছে। এখানে যদিও সমালোচনার কোনও বিষয় নেই।ছবি তৈরি করতে গিয়ে একটাই শুধু মনে হয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে আর মানিককাকার ‘ঘরে বাইরে’—দু’ক্ষেত্রেই সন্দীপের প্রতি ঠিক বিচার হয়নি। বড্ড একপেশে বিচার হয়েছে। হতে পারে সন্দীপ সুযোগসন্ধানী। কিন্তু তার সবটাই খারাপ নয়। এটা আগে বলিনি কখনও।কিন্তু ছবিটা বানাতে গিয়ে এই অনুভব হল! সে একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সুন্দর দেখতে।ক্ষুরধার বুদ্ধি তার!
এই গুণগুলো কি রবীন্দ্রনাথে নেই?
আছে। সুন্দর দেখতে। বুদ্ধি। এগুলো আছে। তাহলেও আমার মনে হয়েছে, সে অতিরিক্ত পরিমাণে স্বার্থান্বেষী। সুবিধাবাদী। আমার এখানে তা নয়।এরকম করে দেখাইনি আমি। তার সত্যিকারের সমাজসেবার মধ্যে রাজনৈতিক মনোভাব নিহিত আছে। সে বলে,আমাদের দেশের মানুষকে যদি আমরা তাদের সমস্ত দুর্বলতা, সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে গ্রহণ করতে না পারি তাহলে শাসন করব কী করে? তখন নিখিলেশ তাকে বলে, তুই কি গোরা হতে চাইছিস? গোরার প্রসঙ্গ এ ভাবেই আমার ছবিতে আসে। সন্দীপের মধ্যে সৎ-অসতের মিশেল আছে। নিখিলেশের চেয়েও সে অনেক জটিল।
আপনার বিমলা দলিত মেয়ে। সেটা কি সচেতনভাবে করা?
হ্যাঁ, সচেতন ভাবেই। আমার বিমলা বিধবা হল কি হল না সেটা এখানে বড় কথা নয়। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যখন বিমলা বদলে গেল...সাদা থান পরে দেখা দিল তখন প্রশ্ন উঠেছিল বিমলাকে কি সত্যজিৎ সন্দীপের সঙ্গে প্রেমের জন্য শাস্তি দিলেন? এ প্রশ্ন আমার ছিল না। আর আজ তিনি নেই। থাকলে প্রশ্ন করতাম গিয়ে।এখন আমার সেই বিচার করার অধিকারও নেই। আমি বিমলাকে বদলেছি।তবে শেষটা বলব না। আমার ছবিতে বিমলা নিষ্ক্রিয় নয়।
আরও পড়ুন-অনলাইনে ফাঁস সেই পাকিস্তানি গায়িকার অন্তরঙ্গ ছবি ও নুড ভিডিয়ো!
শুনেছিলাম আপনার বিমলা করার কথা ছিল?
১৯৭৬-এ আমি আর মানিককাকা দিল্লিতে।তখন বলেছিলেন তোকে আমি বিমলাটা করাব। আমি তো খুব খুশি। তারপর বেশ কিছু সময় গেল।পরে একবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও মানিককাকা, তুমি কি করবে ‘ঘরে বাইরে’? বললেন,‘তুই বুড়ি বিধবা পিসিমার মতো চুল কেটেছিস। বিমলা কী করে হবে? তারও কিছুদিন পর আমি ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছি, মানে কঙ্কণার আসার সময়। ওকে আবার বললাম সে কথা। তখন উনি বলেছিলেন, এখন ‘ঘরে বাইরে’ করায় কিছু সমস্যা আছে। আমায় বললেন,‘তুই এখন বাচ্চা-টাচ্চা করে নে... ঠিক এইরকম ভাবে। তারপর উনি ‘ঘরে বাইরে’ করেছিলেন। আমায় নেননি। কেন? সেটা কখনও জিজ্ঞেস করিনি। অভিমান হয়েছিল।
পরিচালকের নিখুঁত চোখ
কিন্তু আপনি এই প্লটটাই কেন নিলেন?
কিছু কিছু ছবি করার ভাবনা আমার স্বপ্নেও এসেছে। গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারির মৃত্যু আমায় খুব অসহায় করে দিয়েছিল।নাড়া খেয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম হয়নি সে রাতে যে দিন গৌরী লঙ্কেশ হত্যা হয়। স্বপ্ন দেখলাম, একজন নতুন ফিল্মমেকার, সে সত্যজিৎ রায়ের ছবির ভক্ত ।সে প্রথম ছবি বানাচ্ছে ‘ঘরে বাইরে’, কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে। মনে হল এই পরিচালক কে? এ তো আমি! আমি ধরতক্তা মার পেরেক ছবি করতে পারি না। বছরে চারটে ছবি করব! এরকম হয় না আমার। বরং আমার প্রত্যেকটা ছবিতে নিজেকে মনে হয়, আমি নতুন পরিচালক।
প্রথমে কি চিত্রনাট্য অন্যরকম ভেবেছিলেন?
প্রথমে ফিল্ম উইদিন ফিল্ম, এরকমটা ভেবেছিলাম। কোকোও বলল, শ্রীকান্তও বলল, আপনি আজকের প্রেক্ষিতে সোজা গল্পটা বলুন।
দেখে নিন অপর্ণার সঙ্গে আড্ডার ভিডিয়ো
সে গল্প কেমন হল?
নিখিলেশ এবং সন্দীপের ছোটবেলা থেকে শুরু গল্প। ত্রিকোণ প্রেমের ওপর রাজনীতি কেমন করে প্রভাব ফেলছেসেটা দেখিয়েছি।
চরিত্র নির্বাচনে রদবদল হয়েছে?
যাকে প্রথমে নিখিলেশ ভেবেছিলাম তাকে ওই ছোটবেলায় দেখলাম মানাবে না। তাই অনির্বাণ।অনির্বাণ বলেছিল, আমি কী করে করব?ওর অভিনয় ক্ষমতার ওপর আমার গভীর আস্থা ছিল। কল্যাণ ওকে পাইপ খাওয়া শেখাল। ও সঙ্গে সঙ্গে পাইপ কিনল। পাইপ ধরা, ক্লিন করা সবটা শিখে ফেলল। মেদিনীপুরের ছেলে যে ভাবে ইংরেজি বলল আমি অবাক হয়ে গেছি।
সন্দীপের ভূমিকায় যিশু
আর সন্দীপ?
যিশু তো পঞ্চাশ শতাংশ তৈরি।সন্দীপের ওই ফ্ল্যামবয়েন্স ওর মধ্যেই আছে। ও নিজেও খুব খুশি এই চরিত্র করে। আমার মনে আছে, এক সময় ‘আরশিনগর’-এ যখন যিশুকে নিয়েছিলাম তখন প্রবল আপত্তি উঠেছিল।তারপর কোথায় চলে গেল ও। এখন আবার সবাই বলল যিশুকেই নাও।
তুহিনা কেন?
ওকে আমার এত সুন্দর লাগে না! সৃজিত বলেছিল ওর কথা। ওই কোঁকড়া চুল, কালো রং, হিলহিলে ফিগার।ওরকম হাইট! ও প্রচুর খেটেছে। ওকে তো বলতাম, তোর জ’ লাইনটা বার করে আনলেই আর কিছু লাগে না।
এই ছবিতে যৌনতার জায়গা...
সত্যজিৎ রায় ১৯০৪-এর প্রেক্ষাপটে চুম্বনের দৃশ্য দেখিয়েছিলেন। তখন ওটাই সম্ভব ছিল। আর ২০১৯-এরগল্প প্রেম আর যৌনতা ছাড়া অবিশ্বাস্য।
প্রসঙ্গ বদলাই। বদলের এই ইন্ডাস্ট্রিতে অপর্ণা সেন কেমন করে আছেন?
(একটু ভেবে)বদলের ক্ষেত্রে মনে হয়, দর্শকের রুচি নিম্ন হয়েছে।তবে সকলের নয়। টেলিভিশনের ধারাবাহিক তার জন্য দায়ী।রোজ ভাজাভুজি দিলে আপনি রোজ ভাজাই খাবেন। পুষ্টিকর খাবার খাবেন কেন? আমার মনে হয় একটা ডেলি সোপ আমিও করি।দেখি না... আমি করব না। কারণ, যা করতে বলা হবে আমি করব না। আর এই টিআরপি-র বিষয়টাও আমি বুঝি না। আমি কাউকে চিনি না যার বাড়িতে বাক্স দেওয়া আছে। মধ্যবিত্ত বাড়িতে কেমন সব গয়না পরে শুতে যাচ্ছে! কি জানি! আগে ‘রজনি’,‘নুক্কর’,‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’-ও হয়েছে তো।তবে এটাও ঠিক, এই ধারাবাহিকের মাধ্যমেই প্রচুর মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আর বাংলা ইন্ডাস্ট্রি?
দেখুন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কথা ছেড়ে দিলাম।এখন হি ইজ দ্য বেস্ট! খুব কষ্ট করে ছবি করছেন এখন। উনি সিনেমার কবি। ওর কথা ছেড়েই দিলাম। ‘উড়োজাহাজ’দেখার খুব ইচ্ছে আছে আমার। এখনও দেখা হয়নি। তবে এখানকার দর্শক ওর ছবি কম দেখলেও বিদেশে উনি দর্শক পেয়ে গিয়েছেন। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নগরকীর্তন’,‘সিনেমাওয়ালা’খুব ভাল লেগেছে। আদিত্য বিক্রম ভাল কাজ করে। প্রতীমের ‘মাছের ঝোল’,‘সাহেব বিবি গোলাম’ভাল লেগেছিল। নতুন পরিচালকেরাও এসেছে এখন। তবে ‘নগরকীর্তন’চলায় মনে হয়েছে, মানুষ ভাল কিছু খোঁজে,দেখে।
তুহিনাকে স্ক্রিপ্ট বোঝাচ্ছেন অপর্ণা
আপনি যখন কোনও কথা বলেন মানুষ শোনে?
নাহ্। এখন আর শোনে না। সমাজ রাজনৈতিক ভাবে এত ভাগে বিভক্ত যে আজকাল ‘লিবারল’কথাটা গালাগালির স্তরে চলে গিয়েছে। লিবারল বললেই ‘স্যুডো লিবারল’,ইন্টেলেকচুয়াল বললেই ‘স্যুডো ইন্টেলেকচুয়াল’, আমাকে এরকম তকমা দেয় অনেকে! অথচ আমি নিজেকে এরকম বলিইনি কোনও দিন! আমি তো কলেজ শেষ করিনি। হ্যাঁ, পড়াশোনা ভালবাসি, তাই প্রচুর পড়ি।
আপনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংযত হতে বলেন, আবার বিজেপি সরকারের নির্দিষ্ট কোনও নীতির সোজাসুজি বিরোধিতা করেন...
দেখুন, আমার রাজনীতি ইসু বেসড! মাই পার্টি রং, মাই পার্টি রাইট— এই নীতি আমি একেবারেই মানি না! আমার কোনও পার্টির ওপর ভরসা নেই। সমস্ত পার্টি ভোট ব্যাঙ্ক পলিটিক্স করে। আমি মানুষে বিশ্বাস করি। ভরসা করি।সেরকম ভিশনারি কেউ...
এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন?
আপ দিল্লিতে ভাল কাজ করেছে।যোগেন্দ্র যাদবকে আমার ভাল লাগে।স্বরাজ বলে ওঁর পার্টি আছে। রবীশ কুমার পার্টি করলে আমি তো এক্ষুনি যোগ দেব।কাদের দিকে তাকিয়ে থাকব? কে আছেন? এমনকি, জ্যোতিবাবুর সময় মরিচঝাঁপি হয়েছে। সবাই এখন নেহরুকে দোষ দেয়। কাশ্মীরের কথা তোলে। আমার বাবা কিন্তু বলতেন, নেহরু যখন ভারতবর্ষ পেলেন ১৯৪৭-এ, তখন একটা ছুচও পাওয়া যেত না যা ভারতে তৈরি। অথচ ১৯৬৭-তে একটা জিনিসও পাওয়া যেত না যা ভারতে তৈরি হয় না।কুড়ি বছরে নেহরু ভারতকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন করে তুললেন। অথচ পাকিস্তান সে ভাবে দাঁড়াতে পারল না। এই একজন আর মনমোহন সিংহ নব্বইয়ের দশকে ইকনমিটা খুলে দিলেন। এই দুই মানুষ ভারতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দায়ী। অভিজিৎ বিনায়ক-ও তো প্রশংসা করে গেলেন মনমোহন সিংহের।
আরও পড়ুন-নুড ভিডিয়ো লিকের পর বড়সড় সিদ্ধান্ত ঘোষণা সেই বিতর্কিত পাক গায়িকার
এখন সকলের ভয় করে?
হ্যাঁ। কেউ কিছু বলবে না। ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হচ্ছে। আমরা চিঠিতে প্রতিবাদ করলাম। সংবিধান মেনে। কোথাও ইন্টেলেকচুয়াল কথা লেখা ছিলনা কিন্তু। একশো তেত্রিশ কোটির দেশে ৪৮ জন লোক এপ্রিলে চিঠি লিখল, তার জের চলল অক্টোবর অবধি। কেস হল! কেন? রেইন অব টেরর দিয়ে সব ঠান্ডা করে রাখা হচ্ছে!
আপনি কি এর মধ্যেও আশাবাদী?
হ্যাঁ। ওই যে বললাম মানুষের ওপর বিশ্বাস! আর প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন সব কা বিশ্বাস... আমি সেই সব বিশ্বাসের আশায় বসে আছি।