স্কুলের পরে ডিপ্লোমা নিয়েছিলেন কেটারিং-এ। কিন্তু পরে তাঁর চলার পথ ঘুরে গিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্যদিকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের সেরা ডিজাইনারদের মধ্যে একজন হিসেবে। পাশাপাশি ছিলেন এলজিবিটি আন্দোলনের অন্যতম মুখ। কাজের মতোই বর্ণময় ওয়েন্ডেল রডরিক্সের জীবন।
রডরিক্সের জন্ম ১৯৬০ সালের ২৮ মে। গোয়ার এক ক্যাথলিক পরিবারে। পড়াশোনা মাহিমের সেন্ট মাইকেল হাই স্কুলে। কেটারিংয়ে তিনি স্নাতক হন। এরপর ১৯৮২ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন মাসকটের রয়্যাল ওমান পোলিস অফিসার্স ক্লাবে।
কিন্তু এই পেশায় বেশিদিন থাকলেন না। অর্থ জমিয়ে পাড়ি দিলেন প্রথমে লস অ্যাঞ্জেলস, তারপর প্যারিস। ফ্যাশন নিয়ে পড়বেন বলে। উচ্চশিক্ষার শেষে ইন্টার্নশিপে যোগ দেন লিসবনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কস্টিউম অ্যান্ড ফ্যাশন-এ। তারপর নিউ ইয়র্কের ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে।
প্যারিসে প্রশিক্ষণের সময় তাঁকে বলা হয়েছিল, মাতৃভূমিকে নিজের সৃষ্টির মধ্যে আনতে। সেই কথা আজীবন মেনে চলেছিলেন রডরিক্স। দেশে ফিরে তাঁর প্রথম কাজ ছিল গার্ডেন ভরেলি, ল্যাকমে কসমেটিক্স এবং ডি বিয়ার্স-এর মতো ব্র্যান্ডের জন্য।
নিজের লেবেল তৈরি করে কাজ শুরুর পরে সমস্যা পড়তে হয়েছে রডরিক্সকে। এমনও হয়েছে তিনি মডেলদের পোশাকের সঙ্গে মানানসই জুতো দিয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর কাজের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠেন রডরিক্স।
প্রথম ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম বস্ত্রমেলায়। প্যারিস, দুবাই-সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে প্রথমসারির ফ্যাশন শো-য়ে তাঁর সৃষ্টির সম্ভার নিয়ে অংশ নিয়েছেন রডরিক্স।
ভারতের ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিলের সদস্য রডরিক্সকে বলা হয় পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের পথিকৃৎ। গোয়ার বয়নশিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি।
গোয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক হল কুনবি শাড়ি। এর ব্যবহারের উৎস মূলত কুনবি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। রডরিক্সের হাতে নবজন্ম হয় এই শাড়ির।
আগে যে কুনবি শাড়ির দাম ছিল গডে সাতশো টাকার মতো, রডরিক্সের দৌলতে তার চাহিদা বেড়ে সর্বোচ্চ দাম পৌঁছয় প্রায় সাত হাজার টাকায়। ভারতের খাদিশিল্পকেও তিনি তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক দরবারে।
রেখা, দীপিকা পাড়ুকোন, লিজা রে, মালাইকা অরোরা-সহ বহু নায়িকা সেজেছেন রডরিক্সের পোশাকে। কেরিয়ারে শুরুতে অনুষ্কা শর্মাকে তাঁর ফ্যাশন শো-এ সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। সাহায্য করেছিলেন বলিউডে পরিচিতি পেতে। স্মরণবার্তায় পিকে-এর নায়িকা বলেছেন, রডরিক্সের জন্যই আঠেরো বছর বয়সে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বলিউডকে। মালাইকা অরোরা এবং তাঁর প্রাক্তন স্বামী আরবাজ খানের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রডরিক্স।
সাফল্যের তুঙ্গে থাকতে থাকতেই নিজের লেবেল থেকে সরে আসেন তিনি। দায়িত্ব তুলে দেন পুরনো ছাত্রী স্কুলেন ফার্নান্ডেজের হাতে। এরপর রডরিক্সের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাঁর মিউজিয়াম।
তবে শুধুই ফ্যাশন নয়। রডরিক্সের কাজের পরিধি বহুমুখী। একটি ক্যামিয়ো ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ২০০৩ সালের ছবি, ‘বুম’-এ। ছোট পর্দার নাটক ‘ট্রু ওয়েস্ট’-এও তাঁকে দেখা গিয়েছে। ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ফ্যাশন’-এ তিনি অভিনয় করেন নিজের ভূমিকাতেই।
লেখালেখি করেছেন ভ্রমণ আর রান্নাবান্না নিয়ে। বিশেষ করে গোয়ার খাবার তাঁর খুবই পছন্দসই বিষয় ছিল। তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘দ্য গ্রিন রুম’। পাশাপাশি তিনি গোয়ার ফ্যাশন নিয়েও বই লিখেছেন।
সমকামী পরিচয় নিয়ে কোনও কুণ্ঠা বা গোপনীয়তা ছিল না রডরিক্সের। ছিলেন এলজিবিটি আন্দোলনের প্রধান মুখ। ২০০২ সালে তিনি তাঁর পার্টনার জেরম ম্যারেলকে বিয়ে করেন প্যারিসে। ম্যারেলের পরিচয় তিনি দিতেন তাঁর ‘স্বামী’ বলে।
ওমানে থাকার সময়েই এক বন্ধুর মাধ্যমে ম্যারেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল রডরিক্সের। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন। আত্মজীবনীতে বলেছেন, ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে তাঁর সাফল্যের পিছনে ম্যারেলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।
রডরিক্স এবং ম্যারেল দু’জনে একসঙ্গে প্রায় দেড়শোটি দেশে একসঙ্গে সফর করেছেন। ১৯৯৩ সাল থেকে তাঁরা থাকতেন গোয়ার একটি সাড়ে চারশো বছরের প্রাচীন বাড়িতে। তার নাম ‘কাসা দোনা মারিয়া’। চার বছর আগে তাঁরা ওই বিশাল বাড়ি ছেড়ে উঠে যান একটি ছোট বাড়িতে।
‘কাসা দোনা মারিয়ায়’ তিল তিল করে নিজের সাজিয়ে তোলেন নিজের সংগ্রহশালা। রডরিক্সের সমৃদ্ধ সংগ্রহে আছে ফ্যাশন সংক্রান্ত আটশোরও বেশি দুষ্প্রাপ্য জিনিস। সংগ্রহশালার পাশাপাশি এটি একটি গবেষণাকেন্দ্রও।
ফ্যাশনের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে আরও অনেক স্বপ্ন ছিল। সে সব রয়ে গেল অধরা-ই। মাত্র ৫৯ বছর বয়সে বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হলেন ওয়েন্ডেল রডরিক্স। রেখে গেলেন তাঁর সৃষ্টি এবং অসংখ্য গুণমুগ্ধকে। (ছবি: আর্কাইভ ও ফেসবুক)