নির্বাকের প্রতিবাদ নাটকে

প্রতীকী মোমবাতি-মিছিল দেখে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেন যুবকটি। হতচকিত প্রতিবাদীদের হাতের মোমবাতিগুলি ফুঁ-দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে হাত –পা ছুঁড়ে এ গিয়ে গেলেন জনতার মাঝে। যুবকের ভূমিকায় অতনুর মৌন প্রতিবাদ দেখে তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না, তিনি বলতে চাইছেন, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাঁরা রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না, তাঁরাই অসম্পূর্ণ মানুষ। প্রতিবন্ধী তো তাঁরাই। আমরা নয়।”

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০২:৩২
Share:

নাটকের মহড়ায় মূক-বধির শিল্পীদের সঙ্গে পরিচালক অভিষেক বর্মন। দেবরাজ ঘোষ।

প্রতীকী মোমবাতি-মিছিল দেখে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেন যুবকটি। হতচকিত প্রতিবাদীদের হাতের মোমবাতিগুলি ফুঁ-দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে হাত –পা ছুঁড়ে এ গিয়ে গেলেন জনতার মাঝে। যুবকের ভূমিকায় অতনুর মৌন প্রতিবাদ দেখে তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না, তিনি বলতে চাইছেন, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাঁরা রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না, তাঁরাই অসম্পূর্ণ মানুষ। প্রতিবন্ধী তো তাঁরাই। আমরা নয়।”

Advertisement

শুধু অতনু নন, তাঁর মতো অনেকের কাছেই জগৎটা ভাষাহীন-শব্দহীন। সমাজের আর পাঁচজনের কাছে ওঁরা মূক ও বধির। কিন্তু তথাকথিত সম্পূর্ণ মানুষজনের তুলনায় হয়তো কিছুটা বেশিই ওঁরা অনুভূতিপ্রবণ। তাই গল্প আর বাস্তব একাকার হয়ে যাচ্ছে নাটকের মহড়ায়। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তাঁরা জীবনযুদ্ধের লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের মতো করে।

ঝাড়গ্রামের ‘এসো নাটক করি’ সংস্থার উদ্যোগে গত দেড় মাস ধরে অতনুর মতো ৬ জন মূক ও বধির যুবককে নিয়ে নিয়মিত নাটকের মহড়া দেওয়া হচ্ছে। সংস্থার কর্ণধার তথা বিশিষ্ট নাট্যকর্মী অভিষেক বর্মণের লেখা নাটক, ‘পূর্ণপ্রাণ’। নাটকটির নির্দেশকও তিনি। হঠাৎ এমন উদ্যোগ কেন? অভিষেকের জবাব, “চারপাশের এই মানুষগুলোকে দেখে মনে হয়েছিল, এরা আমাদের থেকে অনেক বেশি বোধসম্পন্ন। ভাবনা থেকেই ভাষাহীন কয়েকজনকে একমঞ্চে টেনে এনেছি। বিনা পারিশ্রমিকেই ওদের শেখানো হচ্ছে।”

Advertisement

নির্দেশক জানালেন, কুশীলবরা প্রত্যেকেই নানা পেশা ও পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত। ওদের বিনোদনের জন্যই এমন ভাবনা। কিন্তু ওরা এত ভাল অভিনয় করছে, যে ওদের দিয়েই পুজোর আগে নাটকটি মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানা গেল, এক মূক ও বধিক যুবকের প্রেম ও আশাভঙ্গের কাহিনি দিয়ে ‘পূর্ণপ্রাণ’ নাটকটির সূত্রপাত। ভাষাহীন যুবকটিকে প্রত্যাখ্যান করেন সবাক যুবতীটি। পরে এক জন সম্পূর্ণ মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন ওই যুবতী। কিন্তু একদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় কথা বলা মনের মানুষটির সামনেই কয়েকজন দুষ্কৃতীর হাতে ধর্ষিতা হন ওই যুবতী। ধর্ষকরা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার লোক হওয়ায় ঘটনাটি নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এমনকী যুবতীটির জীবনসঙ্গীও চুপ করে পিঠটান দেন। বুদ্ধিজীবীর দল মোমবাতি মিছিল করেন। ওই সময় প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মূক ও বধির যুবকটি তাঁর কয়েকজন ভাষাহীন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হন। যুবতীটির পাশে দাঁড়ান।

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বছর বাইশের অতনু জানার বাড়ি ঝাড়গ্রামে। সাঙ্কেতিক ভাষায় অতনু জানালেন, ছোট বেলায় সেবায়তনের মূক ও বধির স্কুলে একবার নাটক করেছিলেন। অনেকগুলো বছর পরে এমন সুযোগ পেয়ে ভীষণই আপ্লুত তিনি। অতনু কলকাতার একটি সংস্থায় মোবাইল সারানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সপ্তাহে চার দিন নাটকের মহড়ায় যোগ দেন। নাটকের অন্যান্য অভিনেতাদের মধ্যে রয়েছেন ঝাড়গ্রাম শহরের একটি জেরক্স দোকানের মালিক আবির কর, একটি কম্পিউটার সংস্থার ডিটিপি কর্মী শুভঙ্কর পাল, চা দোকানের কর্মী সোনাইনারায়ণ দেব, রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির পড়ুয়া গৌতম আগুয়ান ও সুমন দে। সকলেই মূক ও বধির। নাটকটির আবহ ও শব্দ প্রক্ষেপণের দায়িত্বে রয়েছেন কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকর্মী শুভদীপ গুহ। নাটকের নির্দেশক অভিষেক বর্মণের কথায়, কয়েকজন সবাক অভিনেতা-অভিনেত্রীও আছেন পার্শ্বচরিত্রে। তবে তাঁরা মূলত নাটকটির সূত্রধার হিসেবে থাকবেন, যাতে নাটকের বিষয়বস্তু বুঝতে দর্শকদের সুবিধা হয়। অতনু, আবির, শুভঙ্করদের নাটক শেখানোর জন্য সাংকেতিক ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ) শিখেছেন অভিষেক। নির্দেশকের বক্তব্য, “নাটক শেখার পাশাপাশি, সাংকেতিক আড্ডা ও বিনোদনের ক্ষেত্রও হয়েছে উঠেছে মহড়ার দিনগুলি।”

মহড়ায় নির্দেশকের সাংকেতিক ভাষায় নির্বাক দৃশ্যগুলিকে চেতনার অভিঘাতে বাঙ্ময় করে তুলছেন ভাষাহীনরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement