রবিবার সকাল হতে না হতেই পাড়া সুনসান। কচিকাঁচা তো বটেই, বাড়ির বড়রাও বসে পড়তেন টিভির সামনে। আধ ঘণ্টার জন্য নট নড়নচড়ন। টিভিতে ‘রামায়ণ’ চলছে যে! তা সেই রামায়ণের রাম-সীতা-রাবণের সঙ্গে লক্ষ্মণকে এখনও ভোলেননি অনেকে। ১৯৮৮-র সেই টেলি-সিরিয়ালের লক্ষ্মণ এখন কী করছেন জানেন?
গত শতকের আটের দশকে শুরু হয়েছিল রামানন্দ সাগরের টেলি-সিরিয়াল ‘রামায়ণ’। রবিবাসরীয় সকালে দূরদর্শনের পর্দা জুড়ে তখন শুধুই রাম-সীতা-লক্ষ্মণ-হনুমানদের রাজত্ব। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় আম আদমির ঘরের লোক তাঁরা। ওই চাঁদের হাটেও লক্ষ্মণ থুড়ি, সুনীল লহরী আলাদা করে চোখে পড়তেন।
সৌম্যকান্তি, গভীর শান্ত দৃষ্টির সুনীল লহরী তখন রামবেশী অরুণ গোবিলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয়। মহিলামহলেও রীতিমতো চর্চার বিষয়।
রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’-এ কাজ করার আগে বেশ কিছু টেলি-সিরিয়ালে দেখা গিয়েছিল সুনীল লহরীকে। ছোট পর্দায় কাজের আগেই অবশ্য হিরো হিসেবেও মুখ দেখিয়েছেন গুটিকয়েক ফিল্মে।
সেই শুরুর কথা জানার আগে ফেরা যাক সুনীল লহরীর ছোটবেলায়। মধ্যপ্রদেশের অখ্যাত শহরে দমোহ-তে ছোটবেলাটা কেটেছে সুনীলের। বাবা ছিলেন ওই রাজ্যের একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক। তবে বাবার মতো শিক্ষকতা নয়, বরং ছোট থেকেই অভিনয়ের শখ ছিল সুনীলের। অভিনয় করবেন বলে এক সময় পাড়ি দিলেন মুম্বই।
মুম্বইয়ে গিয়ে কম স্ট্রাগল করতে হয়নি সুনীলকে। অবশেষে ১৯৮০-তে এল সুযোগ। খাজা আহমেদ আব্বাসের ফিল্ম, ‘দ্য নক্সালাইটস’। হিরো মিঠুন চক্রবর্তী-স্মিতা পাটিলের পাশে ছোট রোল। তবে বক্স অফিসে চলল না সে ফিল্ম।
এর পর হন্যে হয়ে ঘুরলেও ফিল্মে সুযোগ মিলছিল না সুনীল লহরীর। বছর পাঁচেকের দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে একেবারে হিরোর রোল। ১৯৮৫-তে রিলিজ করল জয়প্রকাশ বিনায়কের ফিল্ম ‘ফির আয়ি বরসাত’। তাঁর পাশে অনুরাধা পটেল, নীলমের মতো নায়িকা। তবে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল সে ফিল্ম। কিন্তু ফিল্ম ফ্লপ হলে তুমুল সফল হল তার গানগুলো।
ফিল্মের আশা ছেড়ে এর পর ছোটপর্দার নতুন ইনিংস শুরু করলেন সুনীল লহরী। রামানন্দ সাগরের ‘বিক্রম অউর বেতাল’-এর কয়েকটি পর্বে অভিনয়ের পর মোতি সাগরের ‘দাদা-দাদি কি কহানিয়া’-তেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এর পর সুযোগ এল ‘রামায়ণ’-এ। বাকিটা ইতিহাস।
টেলি-সিরিয়ালে ‘রামায়ণ’ ছাড়াও সুনীল লহরীর জীবনের একটি মাইলফলক হল চেতন আনন্দের পরিচালনায় ‘পরমবীর চক্র’-তে অভিনয়। ’৮৮-র সেই হিট সিরিয়ালে সেকেন্ড লেফ্টটেন্যান্ট রামরাঘব রানের ভূমিকায় বেশ বাহবা কুড়িয়েছিলেন সুনীল।
রামায়ণে লক্ষ্মণের ভূমিকায় প্রথমে সুনীল লহরীর নাম ভাবেননি রামানন্দ সাগর। বরং সঞ্জয় যোগের কাছেই এই রোল নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে সঞ্জয় সে রোল করতে রাজি ছিলেন না। পরে অবশ্য ভরতের ভূমিকায় নামেন সঞ্জয়। এর পরে শুরু হয় লক্ষ্মণের খোঁজ।
লক্ষ্মণের রোলের জন্য প্রায় দেড়শো অভিনেতার অডিশন নেন রামানন্দ সাগর। তাঁদের মধ্যে থেকে সুনীলকে বেছে নেন তিনি। এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি সুনীলকে।
‘রামায়ণে’র হাত ধরে তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেও ফের বড় পর্দায় অভিনয়ের জন্য কম চেষ্টা করেননি সুনীল লহরী। ’৯১-এ ‘বাহারোঁ কি মঞ্জিল’ ফিল্মে গুরুত্বপূর্ণ রোলও পেয়েছিলেন সুনীল। তবে সে ফিল্মে সুনীলকে তেমন পছন্দ করেননি দর্শকেরা। অনেকেই বলেন, লক্ষ্মণের ইমেজেই যেন আটকে পড়েছিলেন সুনীল।
বহু বছর পর অরুণ গোবিলের সঙ্গে মিলে একটি প্রযোজনা সংস্থাও খুলেছিলেন সুনীল লহরী। তাঁরা দু’জনে মিলে আঞ্চলিক সিনেমা তৈরি করায় মন দেন।
২০১৭-তে ফের বড় পর্দায় শেষ বার দেখা গিয়েছিল সুনীল লহরীকে। ফিল্মের নাম, ‘আ ডটারস টেল পঙ্খ’।
এখন কী করছেন ‘রামায়ণে’র সেই লক্ষ্মণ? মুম্বইয়ে থাকলেও কোনও ফিল্ম নয়, স্ত্রী ভারতী পাঠকের সঙ্গে মিলে একটি প্রযোজনা সংস্থার মালিকানা রয়েছে সুনীলের। সেই সংস্থার কাজই দেখাশোনা করেন রামায়ণের সেই লক্ষ্ণণ, সুনীল লহরী।