কিশোরকুমার (বাঁ দিকে)-এর সঙ্গে রাহুল দেববর্মণ। ছবি: সংগৃহীত।
পরিচালক বা অভিনেতা না হলে বোধ হয় গান নিয়ে গবেষণা করতাম। প্রশ্ন করুন, কেন? আসলে, আমাদের বাড়ি গানের বাড়ি। বাবাকে দেখেছি, সময় পেলেই বুঁদ হয়ে গান শুনতেন। সঙ্গগুণে আমিও তাই। বাবার কল্যাণে ভীমসেন জোশী থেকে পঙ্কজ মল্লিক হয়ে আরডি বর্মণের দেদার রেকর্ড এবং ক্যাসেটে ঘরবোঝাই।
এই প্রজন্মের সুরকার, শিল্পীদের গানও রয়েছে। সবার গান মন দিয়ে শুনেছি। তার পর মনে হয়েছে, গানের এই বিস্তৃতি, ব্যাপ্তি, সঙ্গীতের আঙিনায় এত শিল্পীর আনাগোনা— তবু সবার সব বৈশিষ্ট্য যেন রাহুল দেববর্মণের গানে, সুরে।
সময়টা সত্তরের দশক। আমি তখন ছয়, বা সাত। ভবানীপুরে থাকতাম। আমাদের বাড়ির সামনে দু’টি বারোয়ারি কালীপুজো হত। একটি পুজোর সঙ্গে বাবা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। আমার দায়িত্ব ছিল মাইকে গান বাজানো। আমি আবার রেকর্ড চালিয়ে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতাম, কোন গানে শ্রোতার কেমন অভিব্যক্তি, খেয়াল করতাম! ওই বয়সেই ছোটখাটো ‘প্যান্ডেল জকি’ হয়ে গিয়েছিলাম!
যে বছরের কথা বলছি, সে বার, পুজোর গান হিসাবে চারটি গান বেরিয়েছিল। ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’, ‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দু’জনে’ — দু’টি গানই আশা ভোঁসলের। পঞ্চম গেয়েছিলেন ‘যেতে যেতে পথে হল দেরি’, আর একটি গান। সে বারের কালীপুজোয় ওই গান দিয়ে আমার পঞ্চমের সঙ্গে পরিচয়। তার পর যত শুনেছি, মানুষটির গানের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি। গানকে বন্ধু বানিয়ে বেড়ে উঠছি।
নানা রকম গান শুনেছি আমি। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, কে এল সায়গল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি— সব। এ সব শুনতে শুনতে এক সময় আবিষ্কার করলাম, সকলের, সব গানের ভালটুকু ছেঁচে যেন রাহুল দেববর্মণ নামক শিল্পীটি গড়ে উঠেছেন! ওঁর উত্থান ১৯৬৬-তে, ‘তিসরি মঞ্জ়িল’ ছবির গান দিয়ে। ২০২৪-এও সেই গান শুনে দেখবেন, মনে হবে সমসাময়িক। হিপহপ থেকে সালসা, ডিস্কো থেক রাগপ্রধান গান— সব তাঁর ঝুলিতে। ওঁর মতো এমন ‘ভার্সেটাইল’ আর কে আছেন? তাল নিয়ে ওঁর মতো পরীক্ষাও আর কেউ করেননি।
বয়স আরও বাড়ল। আমি ছবি পরিচালনার দুনিয়ায় এলাম। পরিচালক আমি আবিষ্কার করলাম, আর এক আর ডি বর্মণকে। গানের সুরের পাশাপাশি কী অসাধারণ আবহসঙ্গীত বানাতেন উনি! ওঁর জন্যই রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ ছবির আবহ কালজয়ী হয়েছে। আবার ছবির গানের মধ্যে যে নাটকীয়তা থাকে, তাকে সুরের মাধ্যমে গানে তুলে ধরার কৌশলটাও এক মাত্র উনিই জানতেন। যে কারণে ওঁর গানে রেলের হুইসল বা ঝমঝম শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। এই নাটকীয়তা থেকে আবার গানের সুরে ফেরার খেলায় পঞ্চম পাকা খেলোয়াড়।
অনেক সঙ্গীতকারকে বলতে শুনেছি, নাটকীয়তার ওই আবহ পরে স্টুডিয়োয় তৈরি করে নেওয়া হবে। আরডি বর্মণ কিন্তু তা করেননি। হিন্দির পাশাপাশি ওঁর বাংলা গানেও একই বৈশিষ্ট্য বর্তমান। তাই সময়ে অসময়ে আমাদের বাড়িতে বেজে উঠত, ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ কিংবা ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘একান্ত আপন’ ছবির গান।
সেরা সুরকারের মতোই অসাধারণ মানুষ ছিলেন রাহুল দেববর্মণ। ওঁর একান্ত সাক্ষাৎকার পড়ে জেনেছি, একবার পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত সুরকার-শিল্পী। সেই সময় শক্তি সামন্ত ‘অমর প্রেম’ বানাচ্ছেন। সুরের দায়িত্ব পঞ্চমের উপর। পারিবারিক কারণে তিনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় তাঁকে গানের সুর করতে হবে।
মন শান্ত না থাকলে সুর ধরা দেয়? অশান্ত মন নিয়ে আরডি-ও সুর দিতে পারছেন না। এ দিকে গান লেখা হয়ে গিয়েছে। পরিচালক জানিয়েছেন, তিনি নির্দিষ্ট দিনে গান রেকর্ড করবেন। নিরুপায় সুরকার ধরলেন বন্ধু কিশোরকুমারকে। সব জানিয়ে বললেন, ‘‘কিছুতেই সুর দিতে পারছি না। অথচ আগামী কাল রেকর্ডিং।’’
সে দিন চুপচাপ বন্ধুকৃত্য করেছিলেন গায়ক। ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’ গানটির প্রথম চারটি পঙ্ক্তির সুর তিনি দিয়েছিলেন। বাকিটা গাইতে গাইতে দুই বন্ধুতে তৈরি করে নিয়েছিলেন। পরে সেই গান ইতিহাস।
কিশোরকুমার এ কথা কাউকে জানাননি। পঞ্চম পরে সাক্ষাৎকারে সে কথা ফাঁস করেন। সেই সময় ইন্ডাস্ট্রিতে এমন বিরল বন্ধুত্ব ছিল। শিল্পীরা ছিলেন শিশুর মতো সরল। এই সারল্য না থাকলে এমন সুর দেওয়া সম্ভব?
এই কারণেই আর একজন পঞ্চম হলেন না। বেসরকারি রেডিয়ো চ্যানেল থেকে পানশালা হয়ে রিয়্যালিটি শো— সর্বত্র আমার ‘গুরু’র গান আজও হিট! আজও পুজোর প্যান্ডেলে ‘কটি পতঙ্গ’, ‘আঁধি’, ‘আরাধনা’র গান রমরমিয়ে বাজে। আমিই প্রেমিকার মান ভাঙাতে কত বার গেয়েছি, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে’।
রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডির যুগ পেরিয়ে যত গান সহজলভ্য হয়েছে, ততই এ কালের গানের কদর কমেছে। আর রাহুল দেব বর্মণের জন্য হাহাকার বেড়েছে। এই প্রজন্মও ওঁকে গানের ভিতরে আতিপাঁতি খোঁজে। ওঁর ছায়ায় যদি আরও একটা ‘রুবি রায়’ তৈরি হয়! এই না হলে আমার গুরু!