Haybadan

মাথা না শরীর, কে চালায় মানুষকে? মুখ-মুখোশের ধোঁয়াশায় উত্তর খুঁজবে দেবেশের ‘হয়বদন’

‘হয়বদন’ নাটকের সর্বত্রই একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়: ‘আত্মা’, ‘আমিত্ব’, ‘স্বয়ং’ ব্যাপারগুলি কোথায় থাকে? শরীরে, না কি মনে?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৭:০৮
Share:

আগামী ১৫ ডিসেম্বর আসছে ‘হয়বদন’। ছবি: ফেসবুক

‘আমি’ ব্যাপারটা কোথায় থাকে? শরীরে, না মনে? মাথা কেটে ফেললে কি অস্তিত্ব বাদ দেওয়া সম্ভব? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এক ঘোড়ামুখো মানুষ এসে ঢুকে পড়বে ত্রিকোণ প্রেমের মাঝে। না-মানুষ, না-ঘোড়া থেকে পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠতে চেয়ে সে পাকাবে বড়সড় গোল। এ গল্প শুধু কথাসরিৎসাগরের দেবদত্ত-পদ্মিনী-কপিলের নয়। গল্প আত্মানুসন্ধানের। যা চলতেই থাকে, পুরনো হয় না। সঙ্গে লোকসংস্কৃতির নির্যাস, মাটির টান— সব কিছু ফিরিয়ে আনছেন পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। আসছে সংসৃতির নতুন নাটক ‘হয়বদন’।

Advertisement

১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় গিরিশ করনড়ের নাটক ‘হায়বদন’। যে নাটক টমাস মানের উপন্যাস ‘দ্য ট্রান্সপোজড হেডস’-এর মূল ভাবের পুনর্নির্মাণ। এগারো শতকের কথাসরিৎসাগর অনুসরণে সেটিকেই ভারতীয় করে তোলেন গিরিশ। বাংলায় অনুবাদ করেন শঙ্খ ঘোষ। সেই স্ক্রিপ্ট অবলম্বনেই দেবেশের হয়বদন। করনড়ের নাটক যেখানে যক্ষগানের আদলে তৈরি, দেবেশের নাটক অনুসরণ করে মাটির টান। দক্ষিণ দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি খন পালা, রাজবংশী গানের চেনা গন্ধ মিশে যায় বাংলার ‘হয়বদন’-এ। করনড়ের মূল নাটকটিতে থাকা ‘যক্ষে’র গান বাংলায় যেন রূপ পেয়েছে দিনাজপুরের নিজস্ব ‘খন গান’-এ।

দেবেশ বললেন, ‘‘মাথা পাল্টাপাল্টির গল্প। একটি মেয়ে দু’জন মানুষ। তাদের প্রকৃতি আলাদা। একটা সময় গিয়ে এর মাথা ওর ঘাড়ে চলে যায়। শরীর শ্রেষ্ঠ, না মাথা শ্রেষ্ঠ? এই সংশয় থেকে কথাসরিৎসাগর বলে, মাথাই শ্রেষ্ঠ। মাথাই শরীরকে চালনা করে। টমাসম্যান এর পর ‘ট্রান্সপোজ্ড হেডস’-এ খুঁজতে চেয়েছিলেন, এর পরে কী ঘটে? তার পর কি মাথা শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে? যে মাথার যে শরীর ছিল না, সেই মাথা কি এই শরীরকে আগের শরীরে বদলে নিতে পারে? এর থেকে গিরিশ করনড়ের আর একটু উত্তরণ ঘটে, যেটা ‘হায়বদন’। দেবদত্ত, পদ্মিনী আর কপিলের মূল গল্পে এক মানুষ আসে, যার মাথা ঘোড়ার মতো।’’

Advertisement

পদ্মিনীর শিশুপুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছে একরত্তি স্কুলপড়ুয়া ত্রিহান সাহা। নিজস্ব চিত্র

তবে খন গানের পরশ না থাকলে এ নাটক এমন পাখনা মেলত না। দেবেশের কাছে তালিম নিয়েই লোকনাচ এবং গানে তৈরি হয়েছেন দলের কলাকুশলীরা। নাটকের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ছাঁদের মুখোশ তৈরি হচ্ছে কলকাতাতেই।

করনড়ের নাটক বাঙালিকে এখনও ছুঁতে পারে? আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রেখেছিল পরিচালকের কাছে। দেবেশ বললেন,‘‘‘তুঘলক’ করার সময় গিরিশ করনড়ের সঙ্গে কাজ করেছি। বাঙালির গিরিশ করনড়ের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ওঁর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করা একটি মন্তব্যের জেরে। ‘তুঘলক’ যেমন ইমার্জেন্সির সময় প্রাসঙ্গিক ছিল, এখনও তো তেমনই প্রাসঙ্গিক। তা ছাড়া আমি যে অনুবাদটা নিয়ে কাজ করছি সেটা শঙ্খ ঘোষের করা।

শঙ্খ ঘোষের মতো কবি যখন গিরিশ করনড়ের একটি লেখার অনুবাদ করেন, তখন এমনিই তার কাব্যগুণ, ভাষা, শব্দ আলাদা মাত্রা পায়। কাজেই যে বাঙালিরা সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কাছে এই কাজ পৌঁছবে বলেই আমি বিশ্বাসী।’’

‘হয়বদন’ নাটকের সর্বত্রই একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়: ‘আত্মা’, ‘আমিত্ব’, ‘স্বয়ং’ ব্যাপারগুলি কোথায় থাকে? শরীরে, না কি মনে? এই প্রশ্ন নাগরিক জীবনে আরও বেশি করে ঘনীভূত হয়। মূর্তিমান প্রশ্ন হয়ে সামনে ঘুরে বেড়ায় পূর্ণতার দেবতা গণেশ। যার নিজেরই মানুষের শরীর, আর হাতির মাথা। তবে কি পূর্ণতা খুঁজতে যাওয়া নেহাতই বোকামি?

নাটকের তৃতীয় তথা শেষ ভাগে দেখা যাবে, ঘোড়ামুখো সম্পূর্ণ ভাবেই ঘোড়ায় রূপান্তরিত। সে জন্য আক্ষেপও নেই তার। এই রূপান্তরে খানিকটা হলেও যেন সাহায্য করে দেবদত্ত এবং পদ্মিনীর শিশুপুত্র। যার ভূমিকায় অভিনয় করেছে একরত্তি স্কুলপড়ুয়া ত্রিহান সাহা। দেবেশেরই এক পরিচিতের পুত্র সে। তবে নাটকে বড় ভূমিকায়।

‘হয়বদন’-এর প্রস্তুতি কেমন চলছে— জানালেন অভ্র মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

কপিলের ভূমিকায় অভিনয় করবেন সংসৃতি নাট্যদলের জনপ্রিয় মুখ তথা ‘বোমকেশ হত্যামঞ্চ’-র অভিনেতা অভ্র মুখোপাধ্যায়। ‘হয়বদন’-এর প্রস্তুতি কেমন চলছে, খোঁজ নিতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। জানালেন, স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করছেন নিয়মিত। অনেক গান রয়েছে মূল টেক্সটে। যার সঙ্গে নাচের মুদ্রা তুলতে হচ্ছে। মেলা প্রস্তুতি! তবে সবটাই দেবেশের নিজস্ব ধরনে, অর্থাৎ স্ক্রিপ্ট ছাড়া।

অভ্রর কথায়, ‘‘সংলাপের মধ্যে যে যুক্তি সেগুলো দিতে দিতে যাচ্ছেন নির্দেশক, সেই অনুযায়ী আমরা ভিতরের কথা তৈরি করছি। বাচনের মধ্যে দিয়ে শরীরের মধ্যে দিয়ে আমরা মিলিয়ে নিচ্ছি। খুব আনন্দ করে হইহই করে কাজ হচ্ছে।’’

কালী, গণেশ, ঘোড়ামুখো থেকে শুরু করে বিভিন্ন পশু চরিত্রেও আকর্ষণীয় মুখোশের ব্যবহার রয়েছে দেবেশের ‘হয়বদন’ নাটকে। নিজস্ব চিত্র

কালী, গণেশ, ঘোড়ামুখো থেকে শুরু করে বিভিন্ন পশু চরিত্রেও আকর্ষণীয় মুখোশের ব্যবহার রয়েছে এই নাটকে। অভ্র সহাস্যে বললেন, ‘‘কপিল চরিত্রেও শেষমেশ মুখোশ এসে গেলে আশ্চর্য হব না।’’ মুখোশ তৈরি হয়ে চলে এসেছে কিছু কিছু। সেগুলো পরেই মহড়া চলছে।

প্রায় ৮-৯ বছর আগে দক্ষিণ দিনাজপুরের স্থানীয়দের নিয়ে যৌথ ভাবে ‘হয়বদন’ মঞ্চস্থ করেছিলেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এবং অর্পিতা ঘোষ। তবে কলকাতার বুকে কলকাতার মানুষদের নিয়ে সেই ‘খন’ নিরীক্ষা এই প্রথম। অভিনেতাদের নাচগান তোলাতে বিশেষ কর্মশালারও আয়োজন করছেন দেবেশ। প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে।

আগামী ১৫ ডিসেম্বর অ্যাকাডেমি মঞ্চে প্রথম প্রযোজনা ‘হয়বদন’-এর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement