Coronavirus in West Bengal

অতিমারিতে দিনে ৬ জন পরিচিতের মৃত্যু হলে, প্রতি জনের জন্য কতটা শোকের সময় ধার্য

করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দেবালয় ভট্টাচার্য। সেই সময়কার অভিজ্ঞতা লিখলেন আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য।

Advertisement

দেবালয় ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২১ ২০:৫৭
Share:

করোনার সঙ্গে লড়াই করে কী কী শিখলেন দেবালয়?

রাত ১০.১২ হাসপাতালে মধ্যরাত

হাসপাতালে রাত কাটাতে আমার একেবারেই আপত্তি নেই। কিন্তু নার্স যদি পিপিই কিট, মাস্ক আর চশমা পরে শুশ্রূষা করেন, আরোগ্য কী করে হবে? আরোগ্য তো নার্সে আর আপেলে থাকে। ঔষধে নয়।

পেটে নির্মম বাণ ফোটাতে থাকা নার্সের চশমার ভিতর দিয়ে চোখটা দেখতে চেষ্টা করলাম। কাজল দেওয়া। ১২ ঘণ্টার ডিউটি পিপিই কিট মাস্ক আর চশমা পরে। কার জন্য কাজল পরেছেন তিনি?

তাঁদের হস্টেল থেকে হাসপাতালে আসার সময় বাসের জানলায় মাস্ক পরে বসেছিলেন তিনি। বাসটা থেমেছিল একটা সিগন্যালে। পাশে একটা বাইকে মাস্ক পরা একটি ছেলে। দু'জনের চোখাচোখি হয়। সিগন্যাল খুলে যায়। বাস আর বাইক চলতে থাকে। একটা জায়গায় এসে দুটো দু'দিকে চলে যায়। ছেলেটা আজ সারাদিন আপ্রাণ মনে রাখার চেষ্টা করেছে মেয়েটির চোখ। কাল অবধি মনে রাখতে হবে। কাজল দেওয়া টানা টানা চোখ। কাল এই বাসে যদি তাঁকে না পায়?

আমি যদি ঠিক হয়ে ফিরে যাই, আমি চিনব না, কে আমায় শুশ্রূষা দিয়েছিলেন। তাঁর মুখ আমার দেখা হয়নি। শুধু জানব, মুখহীন অথবা নির্মুখ এই শহরে ঘোর মড়কেও তিনি কাজল পরে মুগ্ধ পুরুষের কাছে শেষ বার চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে চিনিয়ে নিতে।

সকাল ১০.৪০

দৈনিক পরিসংখ্যান আসে। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বহু মানুষই নেই। শহর থমথম করছে। এক বন্ধুর মৃত্যুর খবর আসে। তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল, শীঘ্রই দেখা হচ্ছে, আড্ডা হবে।

আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়পর্বকে 'জীবন' বলি। সেখানে অপূর্ণতার হিসেব থাকে না চিরকুটে ফুটনোটে। তাই আড্ডা ফেলে রাখা উচিত নয়। সেরে ফেলা উচিত। বেঁচে থাকা বন্ধুদের নম্বর বার করি। কথাও হয়। কিন্তু প্রত্যকে বারই শেষ হয়, দেখা হবে কোভিড শেষে। আড্ডা হবে। মদ খাব ভাই এক সঙ্গে। ‘ক্লোজার’ হলও না। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা থেকেই গেল। কোন এক কবি লিখেছেন, সপ্তদশ শতকের আগে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা কেউ ভাবত না। 'উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ' একান্তই একটি মধ্যবিত্ত সুলভ ভাবনা।

Advertisement

‘অতিমারিতে দিনে ৬ জন পরিচিতর মৃত্যু হলে, প্রতি জনের জন্য কতটা শোকের সময় ধার্য’

দুপুর ২.১৫

একশো বছর আগে...।

সুকুমার রায়ের মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথ দুটো গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা ছিল, 'তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়'। তখন কালাজ্বর। অন্ধজ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মানুষ। সেদিনও মড়ক লেগেছিল। মৃত্যু ছিল সংগঠিত। তবু একা একা ছিল না শেষযাত্রা। শয্যা পাশে মানুষের স্পর্শ ছিল। শ্মশানে মৃতদেহ ছুঁয়ে বসে ছিল কেউ খুব কাছের।

হাসপাতালের ঘরটা ডুবে যাচ্ছে শোকে। যত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, মাথা পিছু শোকের সময় কমে যাচ্ছে। কিছু বছর পর অঙ্কের বইতে থাকবে, অতিমারিতে দিনে ৬ জন পরিচিত মারা গেলে, প্রতি জনের জন্য কতটা শোকের সময় ধার্য হয়।

বহুদূরে আমার বন্ধুর দেহ একা অপেক্ষা করে পুড়ে যাওয়ার জন্য। কেউ ছুঁয়ে নেই তাকে। যে হাতগুলো তাকে জড়িয়ে ছিলও আদরে স্নেহে, সেই হাতগুলো স্যানিটাইজার মেখে বসে শুকোচ্ছে রোদে। আমায় ঘিরে আছে ওষুধের গন্ধ। আরোগ্য। মহাকাশচারী নার্সেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন ‘গ্র্যাভিটি’ অগ্রাহ্য করে। মহাকাশযানে আমি সুরক্ষিত। পৃথিবীতে ফেরার আসা উজ্জল।

রাত ৯টা

পাশের বেডের ভদ্রলোক থাকতে শোক আসা অসম্ভব। ৬০ ছুঁই ছুঁই ভদ্রলোকটি তার মোবাইলে চালিয়েছেন কিশোর কুমারের গান। স্পিকারে চলছে ফুল ভলিউমে। অন্যান্য রুগি বা নার্স কারোরই কোন বিকার নেই। আমার ধারণা, তাদের মনোরঞ্জনই হচ্ছে।

'ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী?'

'প্লেগ'-এ কাম্যুও তাই বলেছেন। প্রেমহীন পৃথিবী আসলে মৃত পৃথিবী। (বইটা আমার শিয়রে। জানলার থেকে এক হাত দূরে। ওই জানলার ও পাশে একটা রাধাচূড়া গাছ ছিল, আমার ছেলের যখন জন্ম হয় এই হাসপাতালে। এখন সেখানে একটা পাম্পঘর)

তিনি কাল ছাড়া পাচ্ছেন। আরোগ্য লাভ করেছেন। ফিরে যাবেন পরিবারের কাছে। অনেকেই যাবে না। তিনি কি তাদের গান শুনিয়ে গেলেন শিয়রে বসে?

আমায় থাকতে হবে। আমি অক্সিজেন পাচ্ছি। ব্ল্যাকে ওষুধ কিনেছি প্রায় ১ লক্ষ্ টাকা দিয়ে। আমি প্রিভিলেজড। তাই বিছানা পার্শে আলব্যের কাম্যুর 'প্লেগ'। বহু বছর আগে আমি আর এক বন্ধু একটা গোটা রাত তর্ক করে কাটিয়েছিলাম যে, কাম্যুকে 'প্লেগ' না 'আউটসাইডার', কোনটার জন্য নোবেল দেওয়া উচিত ছিল? তখনও জানতাম না, বহু বছর পরে আমাদের এই শহরটাই হয়ে যাবে সেই উপন্যাসে উল্লিখিত ফরাসি আলজিরিয়ার সেই ওরান শহর।

‘হাসপাতালের ঘরটা ডুবে যাচ্ছে শোকে।’

রাত ১.৩৪

সমুদ্রশহরে অনেকগুলো লোক মারা গেছে অক্সিজেন না পেয়ে। অক্সিজেনের জন্য ফোন করছিল ওরা বার বার মরিয়া হয়ে। অক্সিজেন সাপ্লায়ার লোকটার ফোন অফ করা ছিল। এ সময়ে ফোন বন্ধ রাখা উচিত নয়। আমি আমার ফোনটা অন করে দিলাম। একটু পরে একটা নোটিফিকেশান আসে।

সকালে যে বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ এসেছিল, তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, ফেসবুকে। লেখা-- কনফার্ম, ডিলিট। আর কোন অপশন নেই।


সকাল ১১টা

'প্লেগ'-এর মধ্যে একটা পাতা। আমার প্রাক্তন প্রেমিকা তার অভয়ারণ্য থেকে বুকমার্ক করে পাঠিয়েছে। তার জানলার বাগানে জমে থাকে অক্সিজেন। সেটা আমার বাড়ি। সেখানে যাওয়া এখনও মানা।

আর অক্সিজেন লাগছে না আমার। আরোগ্য? আমার বাঁ পাশে বিরাট একটা অক্সিজেন স্তম্ভ। লোহার সিলিন্ডারে ভরা অক্সিজেন। ডানদিকের জানলার বাইরের গাছটা আর নেই। ওটার দরকার নেই। অক্সিজেন তো আমরা বানিয়ে নিতে পারি এখন কারখানায়। শুধু কারখানার মালিককে জেগে থাকতে হবে। তাকে ঘুমোতে দেওয়া যাবে না।

চারদিকে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার কি সমস্ত হত্যা হওয়া গাছেদের জন্য শোক, যা মানুষ এতকাল করেনি? সময় পায়নি। বাকি থেকে গেছে। খুব গাছ দেখতে ইচ্ছে করছে একটা।

বেড থেকে নেমে করিডর দিয়ে হেঁটে শেষ প্রান্তে কাচের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা বেখাপ্পা গাছ ক'টা। রোদে দাড়িয়ে। তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটা বেজার ইস্কুল বাস। বাচ্চারা আর তার কাছে আসে না। ক'দিন যাক, আবার আসবে। মনে মনে আশ্বস্ত করলাম তাকে। বাইরেটা ডাকছে। রাস্তা চায়ের দোকান সাইকেল... ডাকছে।

খেয়াল করিনি, জানলার পাশে একটা দরজা। ফায়ার এ্সকেপ। দরজাটা হাতল ধরে টানতেই খুলে গেল। বাইরে প্রশস্ত সিঁড়ি। এগিয়ে গেলাম। যেন কফিন থেকে বেরিয়ে এলাম। চারতলার উপর আমি। সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। এই সুযোগ পালানোর। পালাও। পালাও। দরজা খুলে গেল। "একি আপনি বেরিয়েছেন কেন?"

Advertisement

‘যত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, মাথা পিছু শোকের সময় কমে যাচ্ছে।’

ফুটনোট অথবা চিরকুট:

১। ডিউটিতে কাজল পরা নিষেধ। কিন্তু এই কোভিডে চশমা পরতে হচ্ছে বলে চোখ অধরা। কাজল পরতে ভালবাসে সে। পরে নিচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না।

২। একটা ভিডিয়ো হোয়াটসঅ্যাপে এসেছে। এই লকডাউনে আপনার স্ত্রী কি একদিনও সেজেছেন? নাহ্‌। তার মানে আপনার জন্য তিনি সাজেন না। এই উপলব্ধিতে বিদ্ধ হয়ে কোভিড শেষে যে নতুন বাঙালি জন্ম নেবে, তারা কেমন হবে?

৩। আমার এক বন্ধুর ছেলে কী করছে জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী বললেন, গিটার বাজিয়ে রেকর্ড করছে। শোক থেকে সৃষ্টি হবে। জন্ম নেবে স্মৃতি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement