টলি সেলেব
থমকে গিয়েছে সময়। বদলে গিয়েছে চেনা রুটিন। হাতে লাগামহীন অবসর। নতুন কোনও স্কিল শেখা বা পুরনো স্কিলকে ঝালিয়ে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু মন কি সায় দিচ্ছে সব সময়ে? করোনা অতিমারির দাপটে বিশ্বজুড়ে ঘরবন্দি মানুষকে নতুন স্কিল শেখার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদেরা। এতে সময়ের সদ্ব্যবহার হয়। উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়ে। আবার দুশ্চিন্তা, অবসাদকেও দূরে রাখা যায়। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই নতুন কিছু শিখতে হলে পারিপার্শ্বিক এবং মনের শান্তি প্রয়োজন। আর মানসিক শান্তি এখন সোনার পাথরবাটি। টলি-তারকারাও এই চেনা বৃত্তের বাইরে নন।
জন কিটসের ‘নেগেটিভ কেপেবিলিটি’-র তত্ত্ব অনুযায়ী, শিল্পীমন যখন দ্বন্দ্ব-দুশ্চিন্তার দোলাচলে জীর্ণ, তখনই নতুন শৈল্পিক ভাবনার জন্ম হয়। টলিউডের সেলেবরা কি এই অবসর প্রোডাক্টিভ ভাবে কাটাচ্ছেন? পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এটা যার-যার মানসিক গঠনের উপরে। লকডাউন শুরুর প্রথম কয়েকটা দিন আমি খেয়ে-ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।’’ আবার ইশা সাহা বলছেন, ‘‘এই সময়ে খেয়ে-ঘুমিয়ে কাটিয়ে কেউ যদি পজ়িটিভ থাকেন, সেটা ভাল। প্রোডাক্টিভের চেয়েও পজ়িটিভ থাকা আমার কাছে বেশি জরুরি।’’ অনির্বাণ ভট্টাচার্যের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা দার্শনিক, ‘‘প্রোডাক্টিভ থাকি বা না-থাকি, এই অস্থির সময় আমাকে সমৃদ্ধ করবেই।’’
শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বেশির ভাগ টলিউডের তারকাকে ঘরের কাজ নিজেদেরই করতে হচ্ছে। তাই ঘরের কাজে এ ক’দিন তাঁরা বেশ পাকাপোক্তই হয়ে উঠেছেন। পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘আগে ১৫-১৬ ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকতাম। ঘরের কাজে ফিরেও তাকাতাম না। বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ার সময়ে ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, বাসন মাজা সবটাই আমার জানা ছিল। এই সুযোগে সেই পুরনো স্কিলই কাজে লাগছে। রান্নাও করতে পারি, করছিও।’’ বাড়িতে বৃদ্ধা মা আছেন বলে ঘরদোর পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে বেশ সচেতন পরিচালক। বললেন, ‘‘মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করি। কিন্তু গরম করার প্লেটটা পরিষ্কার রাখা, আভেনের চারপাশের ময়লা পরিষ্কার করার কাজটা এখনই শিখছি।’’ পাশাপাশি বাড়িতে সাধারণ কাপড় দিয়ে মাস্কও বানাচ্ছেন পরিচালক।
কিছুটা একই স্কিল ডেভেলপ করেছেন তনুশ্রী চক্রবর্তী। ঘরকন্না চালানোর জন্য যে গঠনমূলক স্কিল দরকার, তা পরিস্থিতির চাপে রপ্ত করেছেন তিনি। ‘‘লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে চাল-ডাল কতটা আছে, কী কী তরকারি কবে রান্না করে ফেললে নষ্ট হবে না, এ সবই এখন আমার দায়িত্ব। ওয়াটার পিউরিফায়ার খারাপ হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। আলাদা করে জল ভরে, তা স্যানিটাইজ়ড করে পিউরিফায়ারে ভরছি,’’ হেসে বললেন অভিনেত্রী। বাগান করার কাজও রপ্ত করেছেন তনুশ্রী।
ঘরের কাজে দক্ষতা এখন আবশ্যিক। কিন্তু মনের খোরাকের জন্য যে স্কিল রপ্ত করা হয়েছিল, তাতেও কি শান দিচ্ছেন তাঁরা? পরমব্রত বলছিলেন, ‘‘গিটার বাজাতে পারি ঠিকই। কিন্তু নিয়মিত রেওয়াজ, রোজ এক-দু’ঘণ্টা করে বসা আমার কাছে বিলাসিতার শামিল ছিল। কিন্তু এই লকডাউনে গিটার বাজানো উপভোগ করছি।’’ আরও একটি স্কিল ঘষামাজা করছেন তিনি। ‘‘স্ক্রিপ্ট লিখতে আমি বরাবর ভালবাসি। কিন্তু এই পুরো প্রসেসটা আমার কাছে খুব অস্বস্তিকর ছিল। একবার সিগারেট খেতে উঠি, এক বার চা খেতে, পায়চারি করি... কিন্তু লকডাউনের মধ্যে লিখতে বসে মাথা ঠান্ডা করতে শিখছি। একটা ভাবনার যে নিজস্ব চলন আছে, তাকে মাথার মধ্যে খেলতে দিতে হয়...এই ব্যাপারগুলো শিখছি,’’ বললেন অভিনেতা-পরিচালক।
ইশা আবার এর মধ্যেই আধা-শেখা ডিজিটাল পেন্টিং আর তুর্কি ভাষায় স্কিল ডেভেলপ করেছেন। ‘‘অ্যাপের সাহায্যে তুর্কি ভাষা শিখছি। ডিজিটাল পেন্টিংও জানতাম। সেটা কয়েক দিন করেছি। তবে কিছু দিন করেই বোর হয়ে যাচ্ছি। মন অশান্ত, তাই সব সময়ে যে মন বসছে, তা নয়।’’
রাইমা সেন আলাদা করে নতুন স্কিল ডেভেলপ না করলেও পড়ার পুরনো অভ্যেসটাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। ‘‘নেটফ্লিক্সে সিরিজ়-সিনেমা দেখছিলামই। মনে হল, অনেক দিন বই পড়ি না। তাই এক যোগীর অটোবায়োগ্রাফি পড়ছি এখন।’’ আবার আলসেমি লাগলেও সকালে নিয়ম করে এক-দেড় ঘণ্টা ওয়র্কআউট করছেন তিনি। ‘‘নিজেকে অ্যাক্টিভ রাখা ভীষণ জরুরি। আর মায়ের সঙ্গে আমিও ঘরদোর, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছি,’’ বললেন রাইমা।
কারও পেন্টিং বা নাচের ভিডিয়ো দেখলে কখনও কি মনে হচ্ছে, কিছু না শিখলে পিছিয়ে পড়ছেন? উত্তর দিচ্ছেন অনির্বাণ, ‘‘অনেক দিনই আমি বাড়িছাড়া। তাই ঘরের কাজকর্ম জানি। একটু-আধটু আঁকতে পারি, বই পড়ছি। কিন্তু যদি বলেন, বইয়ের তালিকা বানিয়ে ফেলেছি, আর রোজ একটা করে পড়ছি... সেটা পারছি না। আমাদের পেশায় রোজ এত ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হত যে, এই দেখা না-হওয়াটা শূন্যতা তৈরি করেছে। তাই নতুন কিছু না শিখেও যদি পারিপার্শ্বিকের শূন্যতা আত্তীকরণ করতে পারি বা অবজ়ার্ভ করতে পারি, সেটাই আগামী দিনে অভিনেতা হিসেবে আমাকে পরিণত করবে।’’
এই অভূতপূর্ব মুহূর্তে প্রত্যেককেই জীবন নতুন কিছু না কিছু শেখাচ্ছে। ব্যক্তিগত শেখার সঙ্গে জীবনের শেখার যোগসূত্র তৈরি হলেই কঠিন সময় কেটে যাবে।