মির। নিজস্ব চিত্র।
ভোর সাড়ে ৫টা
অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেল আজ। এ বার গরমটা পড়ছে আস্তে আস্তে। ঘুম থেকে উঠে এক বার এ দিক আর এক বার ও দিক! এখন তো অনেকটা ট্রাভেল করতে হচ্ছে আমায়। একটা ঘর থেকে আরও একটা ঘর। বিরাট! এ দিক সে দিক করতে করতে ব্যালকনির কাছে। এক কাপ চা। নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে ভাবছি আজ শো কী দিয়ে শুরু করব? মানুষ ঘুমোবার আগেও করোনা আর মৃত্যুর খবর শুনে ঘুমোচ্ছে। না, আমি ওদের আর ওই কালো দিকটায় নিয়ে গিয়ে ফেলব না। ডিনারেও রুটি মাংস আর ব্রেকফাস্টেও রুটি মাংস একেবারেই চলে না। আমাকে ওটস দিতে হবে, ফল দেব। এখন শ্রোতা তো ঠিক আমার মতোই গৃহবন্দি। আমার গলা শুনে যেন মনে না হয়, ও বাবা আবার আর একটা দিন, কী যে হবে! অবশ্য মানুষ অফিসের চেয়ে বাড়িতে এখন বেশি ব্যস্ত! একের পর এক কাজ করে যেতে হচ্ছে তাদের। সুতরাং এ রকম মানুষের সকালটা যাতে অন্য ভাবে শুরু হয় তার দায়িত্ব আমার। আমিও তো ফেভারিট রেডিও জকি-র কাছে এটাই আশা করতাম। এ বার যাই, শো শুরু করতে হবে।
ভোর সাড়ে ৬টা
গত পঁচিশ বছরে এই প্রথম বাড়ি থেকে শো করতে হচ্ছে! প্রথমে ভেবেছিলাম, কনসল ছাড়া শো করব কেমন করে? ল্যাপটপের সঙ্গে কানেক্টেড মাইক্রোফোন আছে ঠিকই, কিন্তু স্টুডিয়োর সেই মাইক্রোফোন মুখের সামনে যখন থাকে আমার কণ্ঠস্বর, ব্যক্তিত্বকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যায়। প্রথম কয়েকটা দিন এই হোম সেট আপ ফেক মনে হচ্ছিল। তার পর ওই, মানিয়ে নিলাম।
আরও পড়ুন: আদনান, জাভেদ জাফরি-সহ একাধিক তারকাকে বিয়ে, ব্যর্থ কেরিয়ার, হারিয়েই গেলেন ঋষি কপূরের ‘হিনা’
সকাল সাড়ে ৭টা
আজ একটা গান গাইলাম। লাইনগুলো ছিল এ রকম: ‘ঝুলে গেছে ঝুলে গেছে ঝুলে গেছে। ভুলে গেছে ভুলে গেছে ভুলে গেছে। খুলে গেছে খুলে গেছে খুলে গেছে।’ অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতি ঝুলে গেছে। তাই মদের দোকান খুলে গেছে। মানুষ সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ভুলে গেছে। খুব সহজ গান চার বার করে বলতে হবে। আপনি বাচ্চাকেও শেখাতে পারেন। এখন তো এটাই ভারতের ট্রেন্ডিং নিউজ! আমি এটাও বলেছি যে, যাঁরা মদের দোকানে লাউন দিয়ে, মারামারি করে মদ কিনে এনেছেন, তাঁদের রেশন কার্ড বাতিল করে দেওয়া উচিত। কারণ তাঁদের খাবারের দরকার নেই। খাবারটা অন্য কেউ পাক! মদ নিয়ে যে রকম হ্যাংলামো মানুষ দেখাল, এর পর এ ছাড়া অন্য কিছু তো আর বলতে পারব না।
বেলা সাড়ে ১১টা
চার ঘণ্টার শো চালাতে হচ্ছে বাড়িতে বসে। রিমোট লগ ইন করে চালাতে হচ্ছে। মুসকান আমায় এ ক্ষেত্রে হেল্প করছে। ওকেই বলেছি খবরের কাগজগুলো স্ক্যান করে হাল্কা কিছু খবর মার্ক করে রাখতে। ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, মৃত্যুর সংখ্যা কত হল, কোন রাজ্যের কী হাল— এই খবর আমার চাই না। আমি বরং বলছি, তেরো বছর বাদে মন্তেশ্বরে বাবাকে এক কোয়রান্টিন সেন্টারে খুঁজে পেয়েছে ছেলে। সেই বাবা রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। এখন অপেক্ষায় আছেন, সুস্থ হয়ে ছেলে-বউয়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরবেন। কোভিড নাইন্টিনের পজিটিভ দিক তুলে ধরা আজ খুব দরকার। প্রত্যেক দিন প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ভিটামিন পি ক্যাপসুল দরকার। ভিটামিন পি মানে পজিটিভিটি। হাওড়ায় রবীন্দ্রনাথ পাল বলে এক জন মারা যান রবিবার। তাঁর আত্মীয়-পরিজন অনেক দূরে থাকেন। কে তাঁর সৎকার করবেন? এগিয়ে আসে পাড়ার মুসলিম পরিবার। তারা সৎকারের দায়িত্ব নেয়। এই দৃশ্যটা আমরা শুধু কোভিড-১৯ নয়, তার পরবর্তীকালেও দেখতে চাইব। আমি যে লিখছি এটা নিয়ে, এটাও আহামরি কাজ নয়, বা এ ভাবে বলা উচিত নয়! এই পজিটিভ জায়গাগুলোই আমি মুসকানকে বলি। এখানে কোভিড-১৯ লোকে ছড়াতে বারণ করছে। আমরা পজিটিভিটি ছড়াব।
বাড়িতে পুষ্যির সঙ্গে অনেকটা সময় কাটছে মির-কন্যা মুসকানের। —নিজস্ব চিত্র।
দুপুর দেড়টা
আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাদের সঙ্গেই আছেন। বউ বাড়ি থেকেই কাজ সামলাচ্ছে। ও ডাক্তার। দুপুরের খাওয়ায়াটা তাই একসঙ্গে হয়। আমাদের সঙ্গে মাসি আছেন। উনিও আমাদের সঙ্গেই খেয়ে নিচ্ছেন। খাবারে প্রোটিনটা বেশি রাখা হচ্ছে। মাছ-মাংস। আর কার্বটা যতটা সম্ভব কম থাকছে। এমনিতেই বাড়িতে বসে ওয়েট বাড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এখন ইমিউনিটি বিল্ডিংয়ের জন্য অনেক কিছু খেতে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় ইমিউনিটি বিল্ডিং এক দিনের প্রক্রিয়া নয়। আচমকা আজ চ্যবনপ্রাশ খেতে শুরু করলে দারুণ কিছু কাজ হবে তা নয়। ওটা ১২ মাস খেতে হবে।
দুপুর ৩টে
নেটফ্লিক্স দেখি। ভাল ইন্টারভিউ শুনি। এখন ল্যাপটপে একটানা কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে একটু এ দিক-ও দিক করি। ব্রেক নিই। একটু ঘুমিয়ে নিই অল্প করে।
বিকেল ৫টা
একটু চা আর মুড়ি। তার পর এডিটিং, ভিডিয়ো এ সবের কাজ থাকে। সোশ্যাল মিডিয়াতে সপ্তাহে দু’-তিন বার লাইভ থাকছি। এখন অবশ্য সকলেই সোশ্যাল মিডিয়ায়, তাই যেটুকু বলার বলে চলে আসি। লাইভের জন্য আমি একটা প্রিপারেশন নিই। এখন অবশ্য দেখি মানুষ ‘লাইভ’ বাটন প্রেশ করে বলতে লাগল বা কথা পেল না…।
আরও পড়ুন: বলিউডের ‘জগ্গু দাদা’ জ্যাকি শ্রফকে হুমকি দিতে হবে শুনে পিছিয়ে গিয়েছিলেন দাউদও!
সন্ধে সাড়ে ৭টা
ঋষি কপূরের ভিডিয়ো দেখছি। মনটা খারাপ হয়ে আছে। একেবারে বেড়ে ওঠা এই মানুষটাকে দেখে। একটা পুরনো ইন্টারভিউ দেখলাম। রাজীব কপূর, ঋষি কপূর আর রণবীর কপূরের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনুপম খের। সিমি গারেওয়ালের ‘রঁদেভু’ দেখলাম, ঋষি আর নিতু কপূরকে নিয়ে। এ রকম দেখতেই বেশি ভাল লাগে। বাস্তব মনে হয়।
লকডাউনে ঘরবন্দি মির। নিজস্ব চিত্র।
রাত সাড়ে ৯টা
ডিনারটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি আমরা। যাতে খেয়েই শুয়ে পড়তে না হয়। এই সময়টায় মুসকানকে দেখি আমি। ওকে তো আর স্কুলে পড়তে দেখি না আমরা। দেখছি ও স্কুলের অনলাইন ক্লাস, টিউশন কেমন করে ম্যানেজ করছে। আমি ওকে দেখে মোটিভেটেড হচ্ছি। এক এক সময় দিনে পাঁচটা ক্লাস থাকছে, পরের বছর ও আইএসসি দেবে। স্কুল লাইফের শেষ বছর এ ভাবে কাটবে ও ভাবতেই পারেনি! আমার খালি মনে হয়, ও মনমরা না হয়ে যায়। আমাদেরই কেমন লাগছে! বাচ্চারা যে ভাবে আছে! চিৎকার করে বলছে না আমি বাড়ি থেকে বেরবোই, এটাই অনেক! আমরা ছোটবেলায় এতটা পারতাম না। তবে টেকনোলজি ওদের হেল্প করছে এখন। দিব্যি ভার্চুয়াল আড্ডা দিচ্ছে। এ বার শুতে যাব… ভোরে উঠতে হবে।
রাত ১১টা
সাদা পাতায় লিখলাম একটা শব্দ— ‘NORMAL’। এই শব্দটা আমাদের জীবন থেকে চলে গেল! আর ফিরবে না। সকলে যে বলছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে? আবার সব স্বাভাবিক… না! গ্লোবাল ট্রেন্ড যা বলছে তাতে মনে হয়, কোভিড-১৯ নিয়েই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদের আশপাশে এই ভাইরাস বেশ কয়েক বছর থাকবে। যার রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে সে থেকে যাবে। এই ভাইরাসের সঙ্গে আমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হবে। শুনতে খারাপ লাগবে। বুঝতে খারাপ লাগবে। তবে এই যে একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে জড়িয়ে ধরা, হাতের ছোঁয়া, আমাদের ভুলে যেতে হবে। এখন বেশ রাত, তা-ও ওই মদের দোকানের লাইনের দৃশ্য ভুলতে পারছি না। এঁরা কোন জগত থেকে এসেছেন? এত বার সামজিক দূরত্ব নিয়ে বলার পরেও এই ছবি? এঁদের থেকে দূরে থাকতে হবে। এঁরা নিজেদের জীবনে ঝুঁকি তো আনছেনই, তার সঙ্গে পরিবার আর অন্য মানুষকেও বিপদে ফেলবেন! অনেকে বলবেন, যাঁরা নিয়মিত নেশা করেন তাঁরা মদ না পেয়ে সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন। এখন হয়তো তাঁরা স্বাভাবিক জীবন কাটাবেন। বেশ! তাঁরা কাটান। কিন্তু মদের জন্য সুস্বাস্থ্য না কি সংক্রমণ দূরে রাখার জন্য সামাজিক দূরত্ব? আজ কোনটা জরুরি?
উত্তর আমাদের কাছেই আছে। আমরা বলব? নাকি আমরা উটপাখির মতো সেজে থাকব?