গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
সপ্তাহের শুরুর দিন। হিসেব মতো ‘লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন’-এ টলিপাড়ার চৌহদ্দি আজ মুখর থাকার কথা। কিন্তু চেনা চালচিত্রটা কোথাও গিয়ে যেন খেই হারিয়েছে। সৌজন্যে করোনা আতঙ্ক। কোনও সিরিয়ালের শুটিং এখনও বন্ধ হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাল কেটেছে প্রবাহের। অভিনেতা, টেকনিশিয়ান থেকে মেকআপ আর্টিস্ট— সবার চোখেমুখে উদ্বেগ। আগামী ১৯মার্চ থেকে ৩১ মার্চ অবধি বলিউডের মতো টলি-টেলি পাড়াতেও কি শুটিং বন্ধ থাকবে? কী সিদ্ধান্ত নেবেন পরিচালক-প্রযোজক-টেকনিশিয়ানরা? প্রশ্ন ঘুরছে বিভিন্ন মহলে।
করোনা ভয় ছাড়াও অন্য এক আতঙ্ক জাঁকিয়ে বসছে টলি পরিবারে। বারো দিন শুটিং বন্ধ থাকা মুখের কথা নয়। এক বিরাট অঙ্কের ক্ষতি। শুধু প্রযোজক-পরিচালককে নিয়েই তো আর টলি সংসার নয়। মেকআপ আর্টিস্ট থেকে জুনিয়র টেকনিশিয়ান, যাঁরা দৈনিক পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে কাজ করেন, তাঁরা কী করবেন? আনন্দবাজার ডিজিটাল খোঁজ নিয়েছিল টলিপাড়ার অন্দরে। উঠে এল নানা মতামত।
শঙ্কর চক্রবর্তী (অভিনেতা)
নোটিস দিয়ে শুটিং বন্ধ রেখেছে বলিউড। শঙ্কর চান টলিপাড়াতেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু আর্থিক ক্ষতি কী ভাবে এড়ানো যাবে, ভাবাচ্ছে তাঁকেও। “ধরা যাক, শুটিং বন্ধ করা হল না। এ বার সত্যি যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা সবাই সমালোচনার মুখে পড়ব। আবার শুটিং বন্ধ হলেও বিপুল ক্ষতি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে পার ডে আর্টিস্টস এবং টেকনিশিয়ানসদের। যাঁরা চুক্তিতে কাজ করেন তাঁদের সমস্যা নেই। উভয়সঙ্কটে পড়েছি আমরা।”
অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা)
ছেলে মিশুক এই মুহূর্তে তাঁর কাছে রয়েছে, তাই কিছুটা স্বস্তিতে অর্পিতা। করোনার জেরে তাঁর আসন্ন ছবি ‘আবার বছর কুড়ি পর’-এর উত্তরবঙ্গ শুটিং বন্ধ হয়েছে। বললেন, “সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। আরও নামতে পারে। আগামী বাজেট এলে তা আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাবে। বললেন, “মিশুক বাড়িতে এলে খুব একটা বাইরে বেরোতে চায় না। তবে করোনা নিয়ে ওর যা আপডেট আমি তো অবাক। আমি কী খেয়াল রাখব?”
‘রানি রাসমণি’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য
অঙ্কুশ হাজরা (অভিনেতা)
এই মাসেই অঙ্কুশের প্রেমিকা এবং একইসঙ্গে টলিপাড়ার পরিচিত মুখ ঐন্দ্রিলা সেনের জন্মদিন। কয়েক মাস আগে থেকেই প্ল্যান ছিল একসঙ্গে ইয়োরোপে গিয়ে জন্মদিন পালন। কিন্তু তা হয়নি। সেই খারাপ লাগার মধ্যেই অঙ্কুশ বললেন, “প্রথমে খারাপ লেগেছিল, কিন্তু যা হয়েছে ভালই হয়েছে। আগে তো প্রাণ।”কিন্তু টেকনিশিয়ান-মেকআপ আর্টিস্টরা? তাঁদের কী হবে? অঙ্কুশ বললেন, “ক্ষতি তো সবার হবে। একটা ছবিতে পয়সা লেগে যাওয়ার পর তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া, বলিউডের থেকেও বেশি লোকসান হবে আমাদের।’’আপাতত বাড়িতেই তিনি। কী করছেন অঙ্কুশ? “এমনি যে বসে আছি তা নয়, এই যেমন স্ক্রিপ্ট পড়লাম। বাড়ির সকলের সঙ্গে একটু বেশি সময় পাব। সব কিছু তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাক।”
জয়দীপ কর্মকার (পরিচালক)
‘জিয়নকাঠি’ ধারাবাহিকের জয়দীপ কর্মকার জানালেন শুট হচ্ছে নিয়মিত ভাবেই। তবে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে শুটিং বন্ধ রাখতে হবে, সে ক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বার্থে এটুকু ‘ত্যাগ’ স্বীকার করতে মোটেও আপত্তি নেই তাঁর। জয়দীপের কথায়:“একটা বড় বিপদ ঘটে গেলে তখন কী হবে?” আর টেকনিশিয়ানরা? “ইদানিং অনেকক্ষেত্রেই ১০দিন কাজ করলেও টেকনিশিয়ানদের ২৩ দিনের প্যাকেজ সিস্টেমে পেমেন্ট দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।তবে যাঁদের দশ-বারো দিনের ‘লটের’ সিস্টেম রয়েছে তাঁদের তো অবশ্যই অসুবিধের মধ্যে পড়তে হবে।”
চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী (প্রোডাকশন ম্যানেজার)
‘নকশি কাঁথা’ সমেত জনপ্রিয় ধারাবাহিকের ফ্লোর ম্যানেজার চন্দ্রশেখর মনে করছেন, শুধু ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি এমনটা নয়। যে সব দর্শক নিয়মিত ভাবে ধারাবাহিক দেখেন, ক্ষতি তাঁদেরও। বললেন, “যদি কাজ না হয়, সবাই যদি বসে যায়, টেলিপাড়ার যেমন আর্থিক ক্ষতি, তেমনই দর্শকদেরও ভুগতে হবে। তাঁরাও করোনা আতঙ্কে যদি গৃহবন্দি হয়ে যান, সে ক্ষেত্রে বাড়ি বসে প্রিয় সিরিয়ালটাও তো দেখতে পাবেন না।”
‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য
টোটা রায়চৌধুরী (অভিনেতা)
‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকে রোহিত সেনের ভূমিকায় সদ্য দেখা গিয়েছে অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরীকে। আপাতত বাড়িতে তিনি। হঠাৎ করে শুটিংয়ে ছেদ পড়লে ধারাবাহিকের জন্য তা যে বিরাট ক্ষতি সে কথা মেনে নিয়ে টোটা বললেন, “কয়েক বছর আগে এক মাসের মতো শুটিং বন্ধ হয়েছিল টলিপাড়ায়। সেই ধাক্কা যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি তা হলে এই ধাক্কা কেন পারব না?” টোটা মনে করেন না, দশ-বারো দিন রোজগার বন্ধ থাকলে টেকনিশিয়ানদের আর্থিক ক্ষতি চরমে গিয়ে দাঁড়াবে। টোটার কথায়, “আমাদের সবারই কিছু না কিছু সেভিংস রয়েছে।আর চ্যানেলকেই যদি সর্বোচ্চ ধরি, চ্যানেলের ক্ষতিটাও কি কম? এই যে ‘শ্রীময়ী’ র বিদেশে শুট বাতিল হল, ক্ষতি তো সেখানেও হয়েছে।’’
মানালি দে (অভিনেত্রী)
‘নকশি কাঁথা’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে তিনি। রীতিমতো চালিয়ে যেতে হচ্ছে শুটিং। বললেন, “এখনও তো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে আমার মনে হয়, যদি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে সে ক্ষেত্রে তাকে স্বাগত জানানই উচিত। একশো বার তো শুটিং ফ্লোরে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং সে ক্ষেত্রে, ক’দিন শুটিং বন্ধ থাকলে আমার মনে হয় সবার জন্যই তা ভাল হবে।’’
‘নেতাজি’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য
সুদীপ্তা চক্রবর্তী (অভিনেত্রী)
চিন্তার ভাঁজ সুদীপ্তা চক্রবর্তীর গলাতেও। ইন্ডাস্ট্রির জন্য যে এক মারাত্মক খারাপ সময় অপেক্ষা করছে, সে ভয় শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে। বললেন,“যে ছবিগুলো এখন চলছে, হলে সেগুলো দেখার লোক নেই। ভাবা যায়! এই করোনাকে আমরা কেউ চিনি না। আর সেই কারণেই এত ভয় পাচ্ছি সবাই। মেয়ের স্কুল বন্ধ। ওকেও খুব একটা বাইরে নিয়ে যাচ্ছি না। নিজেও কম যাওয়ার চেষ্টা করছি। ও বেচারি ডিমের পোচ খেতে পারছে না। জানিনা কেন! মনে হচ্ছে, হাফ বয়েল্ড খাবার এখন না খাওয়াই ভাল।
অভিজিৎ দাস (মেকআপ আর্টিস্ট)
“মাস গেলে মাইনে পাই না আমরা। রোজকারের হিসেবে যে আমাদের মাইনে সে কথা সকলেই জানেন। এতগুলো দিন যদি কাজ ছাড়া থাকতে হয়, খুব অসুবিধে হবে”, দুশ্চিন্তা মাখা গলায় বললেন অভিজিৎ দাস। করোনা আতঙ্ক ইতিমধ্যে থাবা বসিয়েছে তাঁর রুজিতে। “একটা ওয়েব সিরিজের কাজ চলছে। ১৯ তারিখ থেকে বন্ধ হয়ে গেলে সেই কাজেও তালা পড়বে।
বলরাম বেহেরা (আর্ট সেটিং কর্মী)
বলরাম বললেন, “শুটিং বন্ধ হলে আমরা বেকার।” কিন্তু এটা একটাসংক্রামক রোগ।সরকার যা করবে ভেবেই করবে। শুধু আমাদের রুটিরুজি কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।”