নিজের মোটা চেহারার জন্য রাতের পর রাতে কাঁদতেন। আজ, সেই স্থূলতাই তাঁর তুরুপের তাস। ভারতী সিংহ দেখিয়ে দিয়েছেন তথাকথিত সুন্দরী না হয়েও দর্শকদের নজর টানা যায়। এবং, এক জন মহিলা কৌতুকশিল্পীও জনপ্রিয় হতে পারেন স্ট্যান্ড আপ কমেডির মঞ্চে।
অমৃতসরে ভারতীর জন্ম ১৯৮৪ সালের ৩ জুলাই। তাঁর বাবা আদতে ছিলেন নেপালের বাসিন্দা। মা ছিলেন পঞ্জাবি বংশোদ্ভূত। ভারতীর মাত্র ২ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। শৈশবে বাবার স্মৃতি বলতে তাঁর শুধু মনে আছে, বাড়িতে পাওনাদারদের হামলা। তাঁরা দাবি করতেন, তাঁদের সকলের কাছে টাকা ধার করে গিয়েছেন ভারতীর প্রয়াত বাবা।
দুই মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে ভারতীর মা মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁর স্বামীকে হারিয়েছিলেন। পাওনাদারদের টাকা তিনি মেটাতে পারতেন না। ফলে শুনতে হত অশ্রাব্য গালিগালাজ। এক সাক্ষাৎকারে ভারতী দাবি করেন, তিনি ছিলেন তাঁর পরিবারে ‘অবাঞ্ছিত সন্তান’। ভারতী যখন গর্ভে, তাঁর মা নাকি চেষ্টা করেছিলেন সন্তানের জন্ম রোধ করতে। কিন্তু শেষ অবধি পারেননি।
নিদারুণ অভাবী শৈশবের একটি ‘টিক টিক’ যান্ত্রিক শব্দ ভারতীকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়। ওই শব্দ ছিল সেলাই মেশিনের। তিন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে তাঁর মা গভীর রাত অবধি কম্বল তৈরি করতেন। সারা সকাল তাঁর কাটত কম্বলের কারখানায়। বাড়তি মজুরির জন্য কাজ নিয়ে আসতেন বাড়িতেও।
অভাবের সঙ্গে ভারতীর আরও এক দুঃখের জায়গা ছিল তাঁর চেহারা। স্কুলে বন্ধুদের মাঝে নিয়মিত ঠাট্টা ইয়ার্কির শিকার হতেন তিনি। চেহারা নিয়ে কটু মন্তব্য শুনতে শুনতে কেঁদেও ফেলতেন তিনি। তবে মোটা হলেও তিরন্দাজি এবং রাইফেল শ্যুটিংয়ের মতো স্পোর্টসে তিনি ছিলেন জুড়িহীন। রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে তিনি এই দু’টি খেলায় স্কুলের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছেন।
স্পোর্টস কোটাতেই ভারতী ভর্তি হন কলেজে। বড় হয়ে তিনি খেলোয়াড়ই হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের পথ বদলে গেল কলেজে। তাঁর কলেজের ছাত্র ছিলেন কপিল শর্মাও। তিনি কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে নাটকের দল চালাতেন। মিমিক্রির জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন পড়ুয়াদের।
এক বার নাটকে যমরাজের চরিত্রে ভারতীকে বেছে নিলেন কপিল ও তাঁর বন্ধুরা। কিন্তু অভিনয়ে ভারতীর কোনও আগ্রহই ছিল না। তিনি রাজি হলেন না। পরে শুনলেন প্রতি বার রিহার্সালে গেলে ১০ টাকার কুপন পাওয়া যাবে। এর পর আর তিনি পিছিয়ে আসেননি।
নাটকে ভারতীর পারফরম্যান্সে খুশি কপিল তাঁকে তাঁদের নাটকের দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সপ্তাহে দু’টি শো। শো পিছু পারিশ্রমিক ছিল ২৫০ টাকা। পারিশ্রমিকের কথা ভেবে রাজি হয়ে যান ভারতী।
ধীরে ধীরে থিয়েটারই হয়ে ওঠে ভারতীর জীবন। এর পর কপিল শর্মার কথায় তিনি ‘লাফটার চ্যালেঞ্জ’-এ অংশ নিতে অডিশন দিতে যান। অমৃতসরের এক হোটেলে সেই অডিশন হয়েছিল। ভারতী একা যাননি। একা একা হোটেলে যেতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। তাই সঙ্গে নিয়েছিলেন কিছু বন্ধুকে।
অডিশনের দু’সপ্তাহ পরে ভারতীর কাছে ফোন এল। সঙ্গে এল মুম্বই যাওয়ার বিমানের টিকিট। সেই প্রথম মায়ের সঙ্গে বিমানের আসনে বসলেন ভারতী। তার আগে বাসে উঠতেও ভাড়ার কথা ভাবতেন তাঁরা।
‘লাফটার শো’-এ ভারতী তৃতীয় স্থান পান। পুরস্কারস্বরূপ তাঁর বাড়িতে এসেছিল বড় একটা টেলিভিশন সেট। যে পরিবারে দু’বেলা খাবার যোগাড় করাই ছিল কঠিন, তাঁদের বাড়িতে বড় টিভি দেখে হকচকিয়ে গেলেন পড়শিরা।
কিন্তু টিভিতে কেবল সংযোগ নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তাই নতুন টিভিতেও ভারতীরা দেখতেন দূরদর্শনই। তবুও থেকে গিয়েছিল অনটন। অভাবের সংসারে দু’সপ্তাহ পরে আবার ফোন এল মুম্বই থেকে।
এ বার একটি অলঙ্কার বিপণির হয়ে স্ট্যান্ড আপ শো করলেন ভারতী। পারিশ্রমিক পেলেন ১৫ লক্ষ টাকা। টাকার এই অঙ্ক সে সময় তাঁর কাছে ছিল অকল্পনীয়। পারিশ্রমিক দিয়ে সবার আগে পাওনাদারদের টাকা শোধ করেছিলেন ভারতী। তাঁর সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে লাগল পারিপার্শ্বিকও।
ভারতী এর পর অংশ নিলেন ‘কমেডি সার্কাস’-এ। সেখানে তাঁর পর্টনার ছিলেন শরদ কেলকার এবং সুরেশ। ক্রমশ টেলিভিশনে সঞ্চালনা এবং কৌতুকশিল্পী হিসেবে প্রথম সারিতে চলে আসেন তিনি।
সুযোগ আসে ছবিতে অভিনয়েরও। ‘খিলাড়ি ৭৮৬’, ‘সনম রে’-সহ বেশ কিছু হিন্দি, পঞ্জাবি এবং কন্নড় ছবিতে অবিনয় করেছেন তিনি। তবে তাঁর পাখির চোখ ছিল টেলিভিশনই। পাশাপাশি, তিনি কোনও নির্দিষ্ট শিবিরের অংশ হতে চাননি। সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
খ্যাতির মধ্যগগনে ভারতীর সঙ্গে পরিচয় হয় উঠতি চিত্রনাট্যকার হর্ষ লিম্বাচিয়ার। তিনি কমেডি সার্কাসে ভারতীর জন্য স্ক্রিপ্ট লিখতেন। প্রথমে সেই চিত্রনাট্য সফল না হলেও পরে ভারতীর পারফরম্যান্সে সুপারহিট হয়েছিল সেই চিত্রনাট্য। আলাপ থেকে ক্রমে প্রেম গভীর হয় দু’জনের।
টানা ৬ বছর চলেছিল দু’জনের প্রেমপর্ব। ভারতীর পাশাপাশি হর্ষও এগোতে থাকেন কেরিয়ারের পথে। সহকারী চিত্রনাট্যকার থেকে তিনি হয়ে ওঠেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। ২০১৭ সালে বিয়ে করেন হর্ষ-ভারতী।
যে শহরে ভারতী পা রেখেছিলেন প্রোডাকশন হাউসের টিকিটে, সেই মুম্বইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি। মহার্ঘ্য গাড়ি তাঁর বাহন। নিজের স্বপ্নপূরণের পাশাপাশি ভারতীর লক্ষ্য এখন তাঁর মায়ের পাশে থাকা। তাঁদের তিন ভাইবোনের জন্য মায়ের কষ্ট তিনি ভুলতে পারেন না।
কিন্তু আচমকাই কাটল স্বপ্নের সুর। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের শেষে শনিবার কমেডিয়ান ভারতী সিংহকে মাদক কাণ্ডে গ্রেফতার করে নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)। শনিবার সকালে ভারতীর মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে ৮৬.৫ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করে এনসিবি। তার পরেই ভারতী এবং তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনসিবি দফতরে নিয়ে আসা হয়।
টানা ১৫ ঘণ্টা জেরার পরে রবিবার সকালে ভারতীর স্বামী হর্ষ লিম্বাচিয়াকে গ্রেফতার হন। জিজ্ঞাসাবাদে ভারতী এবং তাঁর স্বামী হর্ষ দু’জনেই গাঁজা খাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বলে দাবি এনসিবি-র তদন্তকারীদের। (ছবি: আর্কাইভ এবং সোশ্যাল মিডিয়া)