অফিসে খুব চাপ যাচ্ছে? কলেজ সিলেবাসের মহাসমুদ্রে ডুব মারার আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চান? মাথা খারাপ করে দেওয়া একটা দিনের পর ক্ষণিকের শান্তির খোঁজে? আই-পডে বিরক্তি? বোকা-বাক্স বড্ড বেশি বোকা মনে হচ্ছে? ল্যাপটপের কৃত্রিমতা সহ্য করতে পারছেন না?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলির একাধিকের উত্তরে যদি ‘হ্যাঁ’ বলে থাকেন, তা হলে আর চিন্তা করবেন না। আপনার জন্যই একেবারে মাপ দিয়ে বানানো হালফিলের নতুন ট্রেন্ড— বড়দের রং করার জন্য ছবির বই।
ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দেওয়ার আগে শুনে নিন, বিলেতে এই ট্রেন্ড রীতিমতো ফুলিয়েফাঁপিয়ে চলছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ এই ধরনের বই অ্যামাজনের বেস্টসেলার তালিকার প্রথম দশে থাকছে। আর চাহিদা এত বেশি যে, লক্ষ-লক্ষ বই ছাপিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না প্রকাশক সংস্থা। যে স্কটিশ মহিলাকে এই ট্রেন্ডের ধাত্রী বলা যেতে পারে, সেই জোহানা বাসফোর্ডের বই দোকানে আসতে না আসতে উধাও হয়ে যাচ্ছে! আর যাচ্ছে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। বাসফোর্ড একা নন। এই তালিকায় রয়েছে আরও ডজনখানেক নাম।
প্রযুক্তির রমরমা বাজারে হঠাৎ এ রকম বইয়ের জনপ্রিয়তার কারণ কী? বাসফোর্ড বলছেন, এর মধ্যে ‘হঠাৎ’ বলে কিছু নেই। ব্যাপারটা বছরদুয়েক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু সে সময় জিনিসটাকে দেখা হচ্ছিল বাচ্চা-বাচ্চা একটা ব্যাপার হিসেবে। মন ভাল করতে আমি ছবির বইয়ে রং করি— এমন স্বীকারোক্তি জনসমক্ষে করার সাহস দেখাতে পারেননি কেউ। সাধারণ ধারণা ছিল, এ রকম কিছু বললে লোকে হেসে উড়িয়ে দেবে। বা হয়তো অদ্ভুত ভাবে তাকাবে। সেখান থেকে এ রকম ‘নিশ’ বইয়ের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার কারণ তুখোড় মার্কেটিং। স্ট্রেস কমানোর মাধ্যম হিসেবে তাদের তুলে ধরা।
যার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বাসফোর্ডের দুটো বই ‘সিক্রেট গার্ডেন’ আর ‘এনচান্টেড ফরেস্ট’-ই যেমন সব মিলিয়ে বিক্রি হয়েছে প্রায় তিরিশ লক্ষ। স্পেন থেকে ইউক্রেন—অনুবাদ হয়েছে প্রায় তিরিশটা দেশের ভাষায়। মার্কিন টিভি স্টার থেকে কোরিয়ান পপ তারকা, টুইটার থেকে ইনস্টাগ্রাম— বড়দের রং করার বই এখন ভীষণ ভাবে মেনস্ট্রিম। সোশ্যাল মিডিয়া প্রফেশনাল মধুবন্তী যেমন বলছেন, ‘‘বইগুলো আমার দারুণ লাগে। কম্পিউটারের ব্যস্ততার যুগে জীবনের গতি একটু স্লো করে দেওয়া যায়। আর বইগুলোর মধ্যে একটা নস্ট্যালজিয়া আছে। রং করতে করতে মনে হয় ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছি।’’
এ দেশে এখন পর্যন্ত এ রকম বই প্রকাশ হয়নি তো কী, ইন্টারনেটের দৌলতে পছন্দের আলঙ্কারিকের বই দিনতিনেকের মধ্যে চলে আসবে আপনার বাড়িতে। আর আসছেও। বছর চল্লিশের হোমমেকার স্মৃতি বসুর কথায়, ‘‘এক বন্ধুর কাছে ছবিগুলো দেখেই প্রচণ্ড লোভ হল। অনলাইন কিনে ফেললাম। ছবিগুলো এত সুন্দর যে, দেখলেই মনে হয় রং করতে বসে যাই!’’ বাড়ি সামলানোর প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে আধ ঘণ্টা বরাদ্দ আছে এই বইয়ের জন্য, যে তিরিশটা মিনিট স্মৃতির কাছে স্ট্রেস-বাস্টার। সব কিছু ভুলে সৃষ্টির আনন্দে ডুবে থাকা।
বাসফোর্ডের বেস্টসেলার বইদুটো এখনও অ্যামাজন ইন্ডিয়ার তালিকায় নেই, কিন্তু রয়েছে আরও অনেক রকমের বই। কোথাও পাতা জুড়ে ট্রপিক্যাল জঙ্গলের রোমান্স। গাছ-লতাপাতা রং করতে করতে যেখানে হঠাৎ খুঁজে পাবেন লুকিয়ে থাকা ছোট্ট একটা পাখি। কোথাও নানা রকমের কলকা, যেগুলো মন দিয়ে রং করতে বসার নিটফল— কয়েক মিনিটে কপাল থেকে দুশ্চিন্তার ভাঁজ উধাও হয়ে মন জুড়ে শান্তি। কোনও কোনও বই আবার নির্দিষ্ট থিম মাথায় রেখে তৈরি। কেক-পেস্ট্রির দোকান, ফ্যাশন বুটিক, ফুল-ফল-গাছ-পাখি, প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে হলেও এত কিছুর মধ্যে নিজের পছন্দের বইটা পেয়ে যাবেন।
যাঁরা সৃষ্টিশীল, যাঁদের মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে রং-তুলির দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে, সে রকম মানুষও কিন্তু ধুধু সাদা একটা পাতা দেখে ঘাবড়ে যেতে পারেন। কী আঁকব-র এই ধাঁধাটাকে উড়িয়ে দিচ্ছে এই সব বই। বরং হাতে পেয়ে যাচ্ছেন ‘রেডি টু কালার’ একগুচ্ছ সাদা-কালো ছবি। একদম নতুন কিছু সৃষ্টির চাপটা থাকছে না, কিন্তু সৃষ্টির তৃপ্তি হাতেগরম পাচ্ছেন। কানাডার মন্ট্রিয়ালে পিএইচডির ছাত্রী পূর্ণা রায়ের কথায়, ছবি রং করতে বিশেষ স্কিল লাগে না, কিন্তু পদ্ধতিটা ভীষণ তৃপ্তির। ‘‘বিশেষ করে আমার মতো মানুষের জন্য, যারা একদম আঁকতে পারে না। শিল্পের এত সুন্দর নিদর্শন যে আমার সৃষ্টি, ভাবনাটা খুব ইন্সপায়ারিং।’’
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, বইয়ের দাম মোটেও আকাশছোঁয়া নয়। শুরু পাঁচশোর আশেপাশে, বাসফোর্ডের চোখজুড়নো অলঙ্করণ চাইলে সামান্য বেশি, সাড়ে আটশো মতো। রিটেল থেরাপির হাজার-হাজার টাকা নয়। যোগা ক্লাস বা স্পা মেম্বারশিপের চেয়ে অনেক, অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু পরিণতি এক— শরীর-মনের টেনশন উড়িয়ে প্রশান্তি আমদানি, নিজের সঙ্গে নিজে সময় কাটানো, বাড়তি একাগ্রতা নিয়ে জীবনে ফেরা।
বেশি কিছু না, ইন্টারনেটে একটু খুঁজে দেখুন। পাতার পর পাতা নিয়ে সাদা কালো একটা পৃথিবী অপেক্ষা করে বসে আছে আপনার রঙের ছোঁয়ার জন্য। আর কে বলতে পারে, মায়াবী এই পৃথিবীতে পথ হারিয়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাবেন না!