মৈনাক ভৌমিক, বিরসা দাশগুপ্ত, দেবালয় ভট্টাচার্য এবং অরিন্দম শীল।
বিনোদন জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসছে সিনেমাটোগ্রাফ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল। ১৯৫২ সালে তৈরি হয়েছিল সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট। এ বার সেই আইন সংশোধনের প্রয়োজন অনুভব করেছে কেন্দ্র। সেই সংশোধনী খসড়াতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া ছবিকে আটকাতে পারে বা যে কোনও পরিবর্তনের নির্দেশ দিতে পারে। অনুরাগ কশ্যপ, ফারহান আখতার, শাবানা আজমি, জোয়া আখতার এবং দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেক শিল্পী ইতিমধ্যেই তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রককে চিঠি লিখে সংশোধনী খসড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। টলিউডের শিল্পীরা এ বিষয়ে কী ভাবছেন?
পরিচালক অরিন্দম শীল ‘মহানন্দা’-র শ্যুটিং ফ্লোর থেকে আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “কোনও দেশে শিল্পীদের গলা টিপে কাজ বন্ধ করতে চাইলে সেই দেশের সমৃদ্ধি বলে কিছু আর থাকে না। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হচ্ছে। শিল্পটাই বাকি ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এখন শিল্পকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াসকে বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে। কী আর বলব। কিছু বলার নেই।” বিরক্ত অরিন্দম শীল এর বেশি আর কথা বলতে চাইলেন না।
এক সময় সমকামিতার মতো ‘বিতর্কিত’ বিষয়কে পর্দায় নিয়ে এসেছিলেন পরিচালক মৈনাক ভৌমিক। তিনি বললেন, সিনেমা নিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্য কী করছে সে দিকে মনোনিবেশ না করে, বক্স অফিসে সাফল্য পাবে, এমন বাংলা ছবি তৈরির দিকে মন দিতে হবে। তিনি মনে করেন, সমকামিতা বা যৌনতা নিয়ে তৈরি ছবিতে কাঁচি চালানো হল কি না, সে দিকে নজর দেওয়ার সময় এখন না। পরিচালকের কথায়, “নেটমাধ্যমেই বাংলা ছবি নিয়ে মানুষের যত মাথাব্যথা । প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বাংলা ছবির জন্য মানুষের ভিড় জমতে দেখা যায় না।” তাঁর মতে, বিনোদনের উপাদান না থাকলে বক্স অফিসে ছবির ভাঁড়ার খালি থেকে যাবে। তাই সে দিকেই এই মুহূর্তে মনোনিবেশ করা উচিত ছবির নির্মাতাদের।
খর্ব হতে চলেছে শিল্পী স্বাধীনতা?
তবে ফারহান, অনুরাগদের মতো একই ভয় পাচ্ছেন ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’-র পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায়। তিনি মনে করছেন কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে শৈল্পিক স্বাধীনতায় ভাটা পড়তে পারে। তাঁর কথায়, “শিল্পীদের ভাবনা চিন্তার স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কোন ধরনের বিষয় ভাবব, কী ভাবে ছবি বানাব সেটাই এ বার দু’বার ভাবতে হবে। আমি যে ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করি, সেটা কি আর করতে পারব?” এর পরেই খানিক খোঁচার সুরে অরিত্র বললেন, “হীরক রাজার দেশে আজকের দিনে মুক্তি পেলে সবার আগে তা হলে সেই ছবিকেই আটকে দেওয়া হত।”
কেন্দ্রকে লেখা অনুরাগ, ফারহান, শাবানাদের খোলা চিঠিতে এই সংশোধনী খসড়ার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছেন প্রায় ১৪০০ ব্যক্তি। তাঁরা মনে করছেন, এই বিল পাশ হলে পরিচালক এবং সেন্সর বোর্ডের স্বাধীনতা খর্ব হবে। তবে প্রতিবাদের এই পন্থাকে ‘সোশ্যাল মিডিয়া স্টান্ট’ বলে চিহ্নিত করলেন পরিচালক বিরসা দাশগুপ্ত। “যত ক্ষণ না চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তত ক্ষণ এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করব না। কী করব? কেন্দ্রে চিঠি পাঠাব? প্রধানমন্ত্রী আমার চিঠি পড়বেন?” প্রশ্ন তুললেন বিরসা। তিনি বললেন, টলিউডে তাঁর বা তাঁর কোনও সহকর্মীর ছবি আটকে দিলে তিনি নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন।
বিরসার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যের। তবে সিনেমাটোগ্রাফ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল প্রসঙ্গে বিরসার সঙ্গে একমত নন তিনি।‘চরিত্রহীন’-এর মতো ওয়েব সিরিজ তৈরি করেছেন দেবালয়। সেখানে সাবলীলভাবে পর্দায় যৌনতার দৃশ্য তুলে ধরেছেন পরিচালক। কেন্দ্রের নজরদারিতে শিল্পীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে মনে করে কিছুটা ক্ষুব্ধ পরিচালক। দেবালয় বললেন, “সেন্সর বোর্ডের উপরে আবার কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ! মানুষ যে মাধ্যমে নিজের মতামত ব্যক্ত করবে, সেই মাধ্যমেই বিধিনিষেধ আরোপ করে দেবে কেন্দ্র। কোনও ছবিতে যদি চানাচুর খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়, তা হলে বলবে অম্বল রোগীদের ভাবাবেগে আঘাত করতেই রাখা হয়েছে সেই দৃশ্য।”
পূর্বে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কী দেখানো হবে, তা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে নির্দেশিকা তৈরির আদেশ দিয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। গোটা বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ‘তাণ্ডব’, ‘মির্জাপুর’, ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর মতো সিরিজ নিয়েও রাজনৈতিক দিক থেকে নানা আপত্তি উঠে এসেছে। সেই কারণেই কি আরও বেশি করে বিধিনিষেধ আরোপ করতে উদ্যত কেন্দ্রীয় সরকার? প্রশ্ন ঘুরছে সর্বভারতীয় বিনোদন মহলে।