সিভিটা নেহাত ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে মিডিয়া স্টাডিজে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন। ব্যারি জোনস্ স্কুলের সার্টিফিকেট। দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম।
তবু বলিউডে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে চার-চারটে বছর।
হাতে গোনা কয়েকটা অ্যাড আর তার থেকেও কম কয়েকটা সিনেমায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর রোল করে যে টাকা পাওয়া যায়, তাতে মুম্বইতে চলা খুব কঠিন। বাবা-র কাছে অবধারিত হাত পাতা।
কিন্তু ২০১৪-র অগস্ট থেকে জীবনটাই বদলে গিয়েছে তাহির রাজ ভাসিনের। আরও ভাল করে বললে ‘মর্দানি’ রিলিজের পর থেকে। এখন নিজের পরিচয় দিতে শুধু ‘মর্দানি’তে তার অভিনীত ওয়াল্টই যথেষ্ট।
অবশ্য সে চরিত্রের জন্য কম পরিশ্রম করেননি তিনি। ‘ক্যারেকটার স্টাডি’ করতে একা একাই চলে গিয়েছিলেন কামাথিপুরার রেড লাইট এলাকায়। ছেঁড়া জিন্স-টি শার্ট আর মাথায় একটা টুপি। যাতে মিশে যেতে পারেন ওই এলাকার লোকেদের সঙ্গে। “তবে একা যাওয়াটা একদম ঠিক হয়নি। অনেক সময়ই মনে হয়েছে বিপদ ঘটলেও ঘটতে পারে। কখনও কখনও ওখানকার মহিলারা এসে জিজ্ঞেস করেছেন আমি কেন ওখানে বসে আছি,” বলছিলেন তাহির। তবে দিনের পর দিন ওই সব জায়গায় বসে থাকার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। ‘মর্দানি’তে রানি মুখোপাধ্যায় যতটা প্রশংসা পেয়েছেন, তাহিরের অভিনয়ও একই রকম প্রশংসা কুড়িয়েছে।
টেকনিক্যালি এই ছবিটাকে তাঁর জীবনের প্রথম ছবি বলা যায় না। ‘কাই পো চে’ আর ‘লাক বাই চান্স’য়ে কয়েক ঝলকের জন্য মুখ দেখাতে পেরেছেন তাহির। তবে বড় ব্যানার তো এই প্রথম। আর তাতেই বিপরীতে রানি মুখোপাধ্যায়ের মতো ডাকসাইটে অভিনেত্রী। “রানিকে সেটে দেখে তো আমি থরথর করে কাঁপতাম,” বলছিলেন তাহির। কাঁপুনিটা যে এখনও পুরোপুরি কাটাতে পেরেছেন তা নয়। এখনও যত বার ‘রানি’র নাম উচ্চারণ করছেন, ‘ম্যাম’ সম্বোধনটা বাদ যাচ্ছে না। কিন্তু অভিনয় করতে গেলে তো এই ভয় থাকলে চলে না! ‘মর্দানি’তে তাঁর অভিনয় দেখে তো সে ভয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ বোঝা যায়নি। বরং তাহিরের হিমশীতল দৃষ্টিতে রানির দিকে তাকানোই লোকেরা হল থেকে বেরিয়ে মনে রেখেছে।
‘মর্দানি’ ছবিতে রানি ও তাহির রাজ
“ভয় অনেকটা রানিম্যামই কাটিয়েছেন। প্রথম দিন দেখা হওয়াতেই আমাকে বসিয়ে বললেন যে, আমার অডিশন ওঁর ভাল লেগেছে। তার পরেই আমার জন্মদিন কবে, জিজ্ঞাসা করলেন। আর আমার অল্প বয়স নিয়ে চলল হাসিঠাট্টা। ওটা সত্যিই আমাকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। ওঁর সঙ্গে ওই হাল্কা আলাপচারিতা খুব সাহায্য করেছিল। সেটেও সব সময় মজা করতেন ম্যাম। আসলে উনি যে কী ভীষণ পিছনে লাগতে পারেন, না মিশলে বুঝবেন না,” হাসতে হাসতে বলছিলেন তাহির। কিছু পরে যোগ করলেন, “আর আপনার বিপরীতে যখন রানিম্যামের মতো অমন জাঁদরেল অভিনেত্রী থাকেন, নিজের পারফরম্যান্স আপনা থেকেই ভাল হয়ে যায়। অদ্ভুত একটা তাগিদ কাজ করে ফাটিয়ে অভিনয় করার। ‘মর্দানি’তে আমি যত প্রশংসা পেয়েছি, তার অনেকটাই কিন্তু রানিম্যামের জন্য। ওঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।” কিছুক্ষণ আগেই বলছিলেন ‘মর্দানি’-পূর্ব সময়ের স্ট্রাগলের কথা। অভিষেক কপূরের ‘কাই পো চে’তে চোখের পলকে মিলিয়ে যাওয়া একটা রোল। আর অভয় দেওল অভিনীত ‘ওয়ান বাই টু’য়ে মিনিট দশেকের একটা ছোট চরিত্র। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ছিল তাহিরের ঝুলিতে। অডিশন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়াটা প্রায় রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল তাহিরের। জীবনের প্রথম অডিশনের কথা বলতে গিয়ে চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায় তাঁর। “একটা ফাস্ট ফুডের বিজ্ঞাপন। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি ঘণ্টা চারেক। অডিশন রুমের দোরগোড়ায় গিয়ে হঠাৎ শুনলাম আমার অডিশন দেওয়ার দরকার নেই। না, কাস্টিং ডিরেক্টর নয়। কাস্টিং ডিরেক্টরের সহকারীর সহকারীই আমাকে দরজা থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিল,” বললেন তাহির। তবে আশা ছেড়ে দেননি। বরং নিজের স্ট্র্যাটেজি পাল্টে নিয়েছিলেন। পঞ্চাশটা অডিশন দিয়ে আটচল্লিশটাই নাকচ হওয়ার থেকে ঠিক করে নিয়েছিলেন যে, বড়জোর দু’-তিনটে অডিশনে যাবেন।
কিন্তু যে ক’টায় যাবেন পুরো ১০০ শতাংশ তৈরি হয়ে। আর নেগেটিভ চিন্তা যাতে মাথায় না আসতে পারে, তার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সব সময়। যেটুকু টাকা রোজগার করতেন খাওয়া ছাড়া সবটাই খরচ করতেন কিছু না-কিছু শিখতে। যোগ দিয়েছিলেন ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড অ্যাক্টিং অ্যান্ড বিহেভিয়েরাল স্টাডিজের কোর্সে। ভর্তি হয়েছিলেন মার্শাল আর্টস আর নাচের ক্লাসেও। কাজ দিয়েছিল তাতে। স্যামসুং, এক্সইউভি আর ক্যাননের বিজ্ঞাপনে সুযোগ এ ভাবেই। তাই বলে রোজগার যে সাঙ্ঘাতিক হত তা নয়। নিজেই বলছিলেন, “মাঝে মাঝেই হাত পাততে হয়েছে বাবার কাছে। না হলে দিন চলত না। বাড়ি লোকেরা ভাবত, মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে কেন অন্য কোনও চাকরি জুটিয়ে নিচ্ছি না? একগুঁয়ে হয়ে পড়ে রয়েছি অভিনয় করব বলে?”
একই প্রশ্ন অবশ্য তিনি আবারও শুনেছেন। পারিবারিক এক বন্ধুর সূত্রে আলাপ হয়েছিল যশরাজ ফিল্মসের কাস্টিং ডিরেক্টর শানু শর্মার সঙ্গে। সব সময় ব্যাগে কিছু ছবি, শো রিল আর জুতো নিয়ে ঘুরতেন সে সময়। যদি হঠাৎ কোনও অডিশনের সুযোগ আসে। তা শানুকে সেই ছবি দেখাতেই প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল, কেন অভিনয়ই করতে চান তাহির। “শানুকে বলেছিলাম, সেই ১৩ বছর বয়স থেকে অভিনয় করছি। টিপিক্যাল হিরোর মতো দেখতে না হলেও অভিনয়টা তো ভালই পারি। একটা স্ক্রিন টেস্ট নিয়েই দেখুন না,” বলছিলেন তাহির।
স্ক্রিন টেস্ট দিয়েছিলেন তাহির। একদিন একটা মেসেজ এল, ‘ইউ ওয়্যার রাইট’। শানুর কাছ থেকে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর।
দু’মাস পরে ফোন করা হয়েছিল যশরাজ থেকে। তখনও পর্যন্ত জানতেন প্রদীপ সরকারের এক সেন্সিটিভ সিনেমার জন্য একটা অডিশন দিতে হবে। প্রায় একশ’জনের মধ্যে থেকে তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল ওয়াল্টের চরিত্রের জন্য। বাকিটা তো এই ২০১৪-র সেপ্টেম্বরেই। ইতিহাস মনে হয়।
বক্স অফিস সাফল্য। ফিল্ম সমালোচকদের প্রশংসা। তা-ও প্রথম বলিউডি বড় প্রজেক্টে। এর পর কোনটাকে পাখির চোখ করবেন তাহির রাজ ভাসিন? ২৭ বছরের ছেলের চোখ জ্বলে ওঠে। ভবিষ্যতের রোডম্যাপ যে স্পষ্ট, তা টের পাওয়া যায়। উত্তরটাও তাই সঙ্গে সঙ্গেই এল, “এখন যে জায়গায় পৌঁছেছি, তাতে পরের ছবিটা সময় নিয়ে বেছেই করতে পারব বলে মনে হয়। আর এখন বলিউডে তো সে ধরনের গল্প নিয়ে কাজও হচ্ছে। বাঁধাগতের চরিত্র না করে আমার পছন্দ একটু লেয়ারওয়ালা চরিত্রে।”
একটু থেমে যোগ করলেন, “এখন তো তাহির রাজ ভাসিন বললেই লোকে চিনতে পারে। অডিশনের জন্য আর শো-রিল নিয়ে ঘুরতে হবে না। সেটাই সব থেকে বড় পাওয়া।”