দু’টি অপহরণ। একটি খুন। দীর্ঘ আট বছরের অপেক্ষা। সব শেষে অপহরণ রহস্যের জট ছাড়িয়ে স্বস্তির সমাপ্তি। পরিচালক ঋভু দাশগুপ্তর ছবি ‘তিন’-এর পরতে পরতে রহস্য। আর সেই রহস্যের জাল কেটে বেরিয়ে আসতে চাইছেন একজন বৃদ্ধ। জন বিশ্বাস।
একটি আট বছরের ছোট্ট মেয়ে অ্যাঞ্জেলার অপহরণ এবং মৃত্যু সর্বস্বান্ত করে দেয় জন বিশ্বাসকে। তবু পুলিশের খাতায় ‘আন সলভ্ড মিস্ট্রি’র পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যের কিনারা করতে মরিয়া সে। নাতনি অ্যাঞ্জেলার মৃত্যুর পর টানা আট বছর ধরে এক নাগাড়ে থানায় ধর্না দিয়েছেন বৃদ্ধ। একে একে সবাই আশা ছেড়ে দিলেও হাল ছাড়তে নারাজ জন। তিনি এবং তাঁর চেয়েও নড়বড়ে স্কুটার তাঁর এই অভিযানের সঙ্গী।
অ্যাঞ্জেলা অপহরণ মামলায় খুব কাছ থেকে হেরে গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা মার্টিন দাস। চাকরি ছেড়ে চার্চের পাদ্রী হয়ে তিনি হয়ে যান ফাদার মার্টিন দাস। কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দা অফিসার চাকরি ছেড়ে চার্চের পাদ্রী হয়ে গেলেও অ্যাঞ্জেলা অপহরণ মামলার ব্যর্থতা মার্টিনকে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছিল না। সেই ব্যর্থতা তাঁকে ভুলতেও দিচ্ছিলেন না বৃদ্ধ জন।
এরই মধ্যে একটি অনাথ আশ্রমের মূক-বধির শিশুর মাথায় অ্যাঞ্জেলার টুপি দেখতে পান জন। সেখান থেকেই শুরু রহস্যের মোড়ক খোলার। ওই টুপির সূত্র ধরে একের পর এক সূত্র হাতে আসতে শুরু করল জনের। এরই মধ্যে আর একটি অপহরণ। ঠিক সেই আট বছর পুরনো অপহরণের ধাঁচেই। দু’টি অপহরণের ঘটনায় একেবারে হুবহু মিল! এতেই খটকা লাগে পুলিশের নতুন গোয়েন্দা অফিসার সরিতা সরকারের। মামলায় সাহায্যের জন্য ডাক পড়ল এই ধরনের ঘটনার তদন্তে এক্সপার্ট ফাদার মার্টিন দাসের। এখান থেকে শুরু দু’টি অপহরণ মামলার এক সঙ্গে রহস্যভেদের দৌড়। এক দিকে নাতনির অপহরণ এবং মৃত্যুর খোঁজে বৃদ্ধ জনের লড়াই। অন্য দিকে, পুলিশের তদন্তের দৌড় নতুন অপহরণ কাণ্ডের কিনারায়।
গল্পের তৃতীয় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই দু’টি অপহরণ কাণ্ডের হুবহু মিল কী করে হল তার পেছনে।
ঋভু দাশগুপ্তর ছবি ‘তিন’-এর গোটা চিত্রনাট্য কলকাতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ছবির প্রায় সব ক’টি চরিত্রই বাঙালি। জন বিশ্বাস থেকে শুরু করে ফাদার মার্টিন দাস বা সরিতা সরকার—সকলেই বাঙালি। ‘তিন’-এর গোটা চিত্রনাট্য জুড়েই আম বাঙালির নিত্য জীবনযাত্রা। এই ছবি দেখতে দেখতে কলকাতার অতি পরিচিত অলিতে গলিতে অপরিচিত রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়বেন আপনিও।
‘তিন’-এর চিত্রনাট্য এক কথায় অসাধারণ। গল্পের শেষ পর্যন্ত যা আপনাকে আটকে রাখবে ছবির পর্দায়। একটার পর একটা ধাঁধাঁ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত জন বিশ্বাসের সঙ্গে রহস্যের কিনারা মেলার আনন্দে স্বস্তি পাবেন আপনিও।
এ ছাড়াও জন বিশ্বাসের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে আর নতুন কী বলব! যে কোনও চরিত্রেই তো তিনি অনবদ্য। অসাধারণ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিও। ফাদার মার্টিন দাসের চরিত্রে তিনি একেবারে পার্ফেক্ট।
লালবাজারের গোয়েন্দা অফিসার সরিতা সরকারের চরিত্রে বিদ্যা বালনও অসাধারণ। বিশেষত, প্রাক্তন অফিসার নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির সঙ্গে তাঁর কেমিস্ট্রি বেশ সাবলীল। এই গল্পের আর একটি বিশেষ চরিত্রে রয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। গল্পের দ্বিতীয় অপহরণটি করা হয় এই সব্যসাচী চক্রবর্তীর নাতিকে। এ ছবির প্রত্যেকটি চরিত্রই একে অপরের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা পুঁতির মালার মতো। একটি বাদ পড়লেই তাল কাটবে গল্পের স্বাভাবিক ছন্দে। তাল কিন্তু কাটেনি। বরং একটু একটু করে জমাট বাঁধা রহস্যের অন্ধকারের বুক চিরে আলোয় বেরিয়ে এসেছে। এই চিত্রনাট্যকে সুন্দর ভাবে সাজানোর জন্য পরিচালক ঋভু দাশগুপ্তর মুন্সিয়ানা অবশ্যই প্রসংশার দাবি রাখে। কারণ দু’টি অপহরণের গল্পকে শেষ পর্যন্ত দু’য়ে দু’য়ে মিলিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত ‘তিন’ ছবিটি আমাদের উপহার দিয়েছেন তিনি।