উচ্চারণের অস্পষ্টতা ছিল অনেক দিন। ডিসলেক্সিক শৈশব পিছিয়ে রাখত বাকি বন্ধুদের তুলনায়। তার থেকেই সঙ্গী হয়েছিল কিছু মানসিক সমস্যারও। সে সব কিছু অতিক্রম করেই পরে ‘ভাইরাস’-এ উত্তরণ, বোমান ইরানির।
মহারাষ্ট্রের পার্সি পরিবারে জন্ম ১৯৫৯ সালের ২ ডিসেম্বর। মুম্বইয়ের সেন্ট মেরিজ স্কুলের পরে তাঁর গন্তব্য ছিল মিঠিভাই কলেজ। পলিটেকনিক কোর্সের পরে যোগ দেন মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে।
কাজের শুরুতে বোমান ছিলেন ওই হোটেলের ওয়েটার এবং রুম সার্ভিসে। তার পর পদোন্নতি। দায়িত্ব পান তাজ হোটেলের রুফটপ ফরাসি রেস্তরাঁ ‘রঁদেভু-’র।
দু’বছর তাজ হোটেলে কাজ করেছিলেন বোমান। এই সময়ে বেতন ছাড়াও তাঁর পকেটে জমা হয়েছিল বখশিসের মোটা অঙ্ক। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বোমান এ বার পড়লেন ফোটোগ্রাফির শখ নিয়ে। জমানো বখশিসের টাকা দিয়ে ক্যামেরা কিনেছিলেন।
বিভিন্ন স্কুল স্পোর্টসের ছবি তুলতেন তিনি। ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ মূলত। তার পর সেগুলি বিক্রি করতেন সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলিতে। যা রোজগার হয়েছিল, জমিয়ে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলেন উটি। ছবি তুলে বিক্রি করার শখ বোমানের ছিল বিয়ের পরেও।
হবু জীবনসঙ্গিনীকে পেয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসার সুবাদে। তাঁদের ব্যবসা ছিল খাবারের। পারিবারিক বেকারি এবং নোনতা খাবারের দোকান ছিল মুম্বইয়ের গ্রান্ট রোডে, অপ্সরা সিনেমার কাছে।
বোমানের জন্মের ছ’মাস আগে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তার পর দোকানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর মা। পরে দীর্ঘ দিন বোমানই সামলাতেন পারিবারিক ব্যবসা।
জীবনের এত পর্ব সামলানোর ফাঁকে কর্তব্যের আড়ালে চলে গিয়েছিল ছবি দেখার শখ। স্কুলের পড়ার সময় থেকেই বোমান ভালবাসতেন সিনেমা দেখতে। ছেলের আধো আধো উচ্চারণের সমস্যা কাটাতে মা’ও উৎসাহ দিতেন ছবি দেখতে।
এমনও দিন গিয়েছে, বোমান স্কুলের পরে রোজ সিনেমা দেখেছেন আলেকজান্ডার সিনেমা হলে। কলেজজীবনেও বজায় ছিল অভিনয়ের শখ। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ অবধি তিনি অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন হংসরাজ সিন্ধিয়ার কাছে। থিয়েটারে হাতেখড়ি হয় অ্যালেক পদমজির কাছে।
বেশ কিছু বছর থিয়েটারে অভিনয়ের পরে সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেন ৪১ বছর বয়সি বোমান ইরানি। তার আগেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছবিতে।
২০০১ সালে মুক্তি পায় বোমান ইরানির প্রথম সিনেমা ‘এভরিবডি সে’জ অ্যাম ফাইন’। এর পর ‘ডরনা মানা হ্যায়’, ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’, ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ ছবিতে বোমানের কাজ প্রশংসিত হয় দর্শকের দরবারে।
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় ‘থ্রি ইডিয়টস’। ২০০৯ সালের আইকনিক এই ছবিতে বোমান অভিনয় করেছিলেন এক ও অদ্বিতীয় বীরু সহস্রবুদ্ধি বা ‘ভাইরাসের’ চরিত্রে। নেগেটিভ এবং কমেডিয়ান চরিত্রের মিশেলে এই চরিত্রটি বলিউডের ইতিহাসে অনন্য।
বোমানের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ছবি হল ‘ম্যায়ঁ হু না’, ‘নো এন্ট্রি’, ‘হাউসফুল’, ‘ককটেল’, ‘খোসলা কা ঘোসলা’, ‘বীরজারা’, ‘লক্ষ্য’, ‘একলব্য’, ‘সরি ভাই’ এবং ‘পেজ থ্রি’।
২০১৯-এ বোমান শুরু করেন তাঁর প্রোডাকশন হাউজ ‘ইরানি মুভিটোন’। জীবন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা কিছু কম করেননি তিনি। চলার পথে ওঠাপড়ার নানা পর্বে তাঁর পাশে আছেন স্ত্রী জেনোবিয়া।
জেনোবিয়াকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন নিজেদের পারিবারিক দোকানে। সেখানে পটেটো চিপস আর ওয়েফার কিনতে এসেছিলেন জেনোবিয়া।
প্রথম আলাপের কয়েক দিনের মধ্যেই জেনোবিয়ার কাছে ওয়েফার কেনা হয়ে দাঁড়াল উপলক্ষ মাত্র। বোমানের সঙ্গে গল্প করার জন্য রোজই তিনি দোকানে হাজির হতেন।
বোমানও বুঝলেন, এ শুধু তার দোকানের খাবারের স্বাদের গুণ নয়। ক্রেতা আসলে মজেছেন বিক্রেতায়। দীর্ঘ দিন দোকানে দাঁড়িয়ে আড্ডার পরে সাময়িক বিচ্ছেন জেনোবিয়ার বিএসসি পরীক্ষার জন্য।
পরীক্ষার পরে আবার দেখা হল। তবে এ বার আর দোকানে নয়। দু’জনে গেলেন প্রথম ডেটিং-এ। রেস্তরাঁয় মুখোমুখি বসে তখনও মেনুকার্ডই আসেনি। বোমান প্রোপোজ করে বসলেন জেনোবিয়াকে।
বোমান ভেবেছিলেন উল্টো দিকের উত্তরে হয়তো অনিশ্চয়তা থাকবে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে জবাব এল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই আমাদের বিয়ে করা উচিত। ওহ! আমি ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছি।’ প্রেয়সীর এই খাপছাড়া উত্তরে চমকে যান বোমান।
কিন্তু তখন আদৌ বৃষ্টি পড়ছিল না। জেনোবিয়া যেটা বৃষ্টি বলে ভেবেছিলেন, সেটা ছিল রেস্তরাঁয় অন্য টেবলে সিজলার্সের চটপট শব্দ!
অবশেষে ১৯৮৫ সালের ২৮ জানুয়ারি পার্সি রীতিনীতি মেনে বিয়ে হল বোমান-জেনোবিয়ার। বোমান তখন ২৫ বছরের যুবক। জেনোবিয়া ২২ বছর বয়সি।
সন্তানদের নিয়ে বোমান-জেনোবিয়ার এখন ভরপুর সংসার। ৩৫ বসন্ত পেরোনো দাম্পত্যে জেনোবিয়াকেই কাণ্ডারি বলে মনে করেন বোমান।
বোমানের কথায়, তিরিশ বছর বয়সে ফোটোগ্রাফার থেকে পঁয়ত্রিশে মঞ্চাভিনেতা হয়ে চুয়াল্লিশে সিনেমার তারকা— তাঁর এই উত্তরণের নেপথ্য কারিগর স্ত্রী জেনোবিয়াই।