মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে। স্বামীর উৎসাহেই অভিনয় শুরু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে উঠলেন হিন্দি সিনেমার স্নেহময়ী মায়ের প্রতিরূপ। চোখের কোণে জল নিয়ে তাঁর অভিনয় দাগ কেটে যেত দর্শকদের মনে। তিনি, নিরূপা রায়। কিন্তু বলিউডে মা বলতে প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসে, বাস্তবে মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পত্তি নিয়ে ছেলেদের বিবাদ পৌঁছেছিল আদালত অবধি।
নিরূপার জন্ম ১৯৩১ সালের ৪ জুলাই, গুজরাতের ভালসাদে। তাঁর জন্মগত নাম ছিল কোকিলা কিশোরচন্দ্র বালসারা। কমল রায়কে বিয়ে করে পঞ্চদশী কোকিলা নতুন সংসার শুরু করেন সেকালের বম্বে, আজকের মুম্বইয়ে। বিয়ের পরেই ১৯৪৬ সালে গুজরাতি সংবাদপত্রে ‘অভিনেতা ও অভিনেত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দেখে কোকিলা ও তাঁর স্বামী আবেদন করেন। অডিশনে মনোনীত হন কোকিলা।
গুজরাতি ছবি ‘রঙ্কাদেবী’ দিয়ে শুরু হয় কোকিলার অভিনেত্রী-কেরিয়ার। সে বছরই মুক্তি পায় তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘অমর রাজ’। নতুন জীবনের সঙ্গে এল নতুন পরিচয়। পাল্টে দেওয়া হল কোকিলার নাম। তাঁর নতুন নাম হল ‘নিরূপা’। তার পর থেকে নিরূপা রায় পরিচয়েই বিখ্যাত হন তিনি।
প্রথমদিকে নিরূপা অভিনয় করতেন মূলত পৌরাণিক ছবিতে। দেবীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় জনপ্রিয় ছিল দর্শকদের মনে। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে নিরূপা রায় অভিনীত পৌরাণিক চরিত্রগুলি এতই জনপ্রিয় হয় যে, তাঁর বাড়িতেও সাধারণ মানুষ চলে যেতেন আশীর্বাদ নিতে।
পৌরাণিক ছবিগুলিতে নিরূপার নায়ক মূলত ছিলেন ত্রিলোক কপূর। পৃথ্বীরাজ কপূরের ভাই ত্রিলোকের সঙ্গে ১৮টি ছবিতে কাজ করেছেন নিরূপা। পাশাপাশি তিনি ভারত ভূষণ, বলরাজ সাহনি ও অশোককুমারে সঙ্গেও কাজ করেছেন। তবে কেরিয়ারের প্রথম অর্ধের তুলনায় দ্বিতীয় অর্ধে নিরূপা অনেক বেশি জনপ্রিয় ও প্রশংসিত হয়েছেন। অভিনয়ের করুণরসকে তুরুপের তাস করে তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দি ছবির ‘মিজারি কুইন’। যেমন মীনাকুমারী ছিলেন ‘ট্র্যাজেডি কুইন’।
সত্তরের দশকে অমিতাভ বচ্চন ও শশী কপূরের মা হিসেবে আইকনিক হয়ে ওঠেন নিরূপা। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর কেরিয়ারের মাইলফলক ছবি ‘দিওয়ার’। এই ছবিতেই তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় অমিতাভ বচ্চন-শশী কপূরের সেই দৃশ্য, যা বলিউডে সর্বকালীন সেরার মধ্যে অন্যতম। যতদিন হিন্দি ছবি থাকবে, ততদিন শশী কপূরের মুখে ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ সংলাপ থাকবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এই ছবিতে মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ প্রথমে গিয়েছিল বৈজয়ন্তীমালা বালির কাছে। কিন্তু তিনি সেই অফার ফিরিয়ে দেন। তারপর অভিনয়ের প্রস্তাব যায় নিরূপা রায়ের কাছে।
নিরূপা রায়ের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য বাকি ছবি হল ‘দো বিঘা জমিন’, ‘মুসাফির’, ‘দুলহন’, ‘আঁচল’, ‘বেনজির’, ‘মুঝে জিনে দো’, ‘ঘর ঘর কি কহানি’, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘সুহাগ’, ‘বেতাব’ এবং ‘ইন্তেকাম’। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘লাল বাদশা’।
ছয় দশকের দীর্ঘ কেরিয়ারে নিরূপা অভিনয় করেছেন দুশোটিরও বেশি ছবিতে। ২০০৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ৭৩ বছর বয়সি নিরূপা।
নিরূপার মৃ্ত্যুর পর থেকেই প্রকাশ্যে আসে তাঁর দুই ছেলে যোগেশ ও কিরণের মধ্যে দ্বন্দ্ব। ২০১৫ সালে মারা যান তাঁদের বাবা, নিরূপার স্বামী কমল রায়। এর পর সম্পত্তি নিয়ে দুই ভাইয়ের বিবাদ আরও কদর্য হয়ে ওঠে।
১৯৭৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিওয়ার’-এ অমিতাভ বচ্চন ও শশী কপূর লড়াই করেছিলেন তাঁদের অনস্ক্রিন মা নিরূপাকে নিয়ে। কয়েক বছর আগে সেই পরিস্থিতিই হাজির হয়েছিল ঘোর বাস্তবে। নিরূপা রায়ের দুই ছেলে কিরণ ও যোগেশ মায়ের শোওয়ার ঘরের অধিকার নিয়ে লড়াই শুরু করেন।
নেপিন সি রোডে নিরূপা রায়ের তিন হাজার বর্গ ফুটের বাড়ির শোওয়ার ঘর নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত। দুই ছেলেরই বক্তব্য, ওই ঘরের সঙ্গে তাঁদের আবেগ জড়িয়ে। তাই অধিকার ছাড়ার প্রশ্ন নেই। ওই বাড়ির সামনে আট হাজার বর্গ ফুটের বাগানও রয়েছে।
অন্তত ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তি দখল করতে আদালতের দ্বারস্থ হন দুই ভাই। তার আগে হাতাহাতি অবধি গড়িয়েছিল তাঁদের বিবাদ। নিরূপার ছোট ছেলে কিরণ আদালতে অভিযোগ করেন, বাড়ির পুরো দখল নেওয়ার জন্য তাঁর দাদা যোগেশ তাঁকে ভয় দেখাচ্ছেন।
তাঁর দাবি, নিরূপা সব সম্পত্তি তাঁকেই দিয়ে গিয়েছেন। কমল রায়ও শেষ যে উইল করে যান, তাতে কিরণকেই নাকি ওই বাড়ির মালিকানা দিয়ে গিয়েছেন। যোগেশকেও বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। তবে কিরণের শর্ত ছিল, যোগেশ বা তাঁর পরিবার কখনও বাবা মার বেডরুমে ঢুকতে পারবেন না। পর্দার আদর্শ ‘মা’-এর দুই ছেলের এই দ্বন্দ্ব স্তম্ভিত করেছিল ইন্ডাস্ট্রিকে। (ছবি: আর্কাইভ ও ফেসবুক)