অমিতাভ বচ্চনের নেপথ্যে সুদেশ ভোঁসলে, শাহরুখ খানের নেপথ্যে অভিজিত্ কিংবা আমির খানের নেপথ্যে উদিত নারায়ণ- এ ভাবেই তো শুনতে অভ্যস্ত আমাদের কান। কিন্তু শাহরুখ খান যদি নিজেই নিজের নেপথ্যে গান গায়, আমির খানেরও যদি কোনও নেপথ্য গায়কের দরকার না হয়- তা হলে? বলিউডের চেনা ছক ভেঙে যে হারে একের পর এক অভিনেতা-অভিনেত্রী প্লেব্যাক করছেন, মনে হয় খুব জলদি এবিসিএস (এনি বডি ক্যান সিং) নামে একটি ছবিও তৈরি হবে। আসলে যুগটা তো মাল্টি-টাস্কিংয়ের। যে অভিনয় করতে পারে, সে গানও গাইতে পারে। বলিউড তারকারা হলিউডের থেকে কম কী ! ভাববার বিষয় তবে একটাই। গান গাওয়া ব্যাপারটা কি এতই সহজ? আমি-আপনি আমরা সবাই গান গাইতে ভালবাসি। সুরে হোক বা বেসুরে। আর কিছু না পারি, বাথরুম সিঙ্গার তো আমরা সবাই। কিন্তু চাইলেই কি প্লেব্যাক শিল্পী হওয়া যায়? প্রয়োজন নেই কোনও তালিম বা প্রশিক্ষণের?
বলিউডে এই ট্রেন্ড নতুন নয়। ‘ওয়াজির’-এ অমিতাভের ‘অতরঙ্গি ইয়ারি’ থেকে অভিষেক, শ্রীদেবী থেকে শ্রদ্ধা— গানে ভুবন ভরিয়ে দেবার দৌড়ে পিছিয়ে নেই কেউ। নব্বইয়ের দশকের শেষে বাদ ছিলেন না খানেরাও। আমিরের ‘খান্ডালা’ জাদু কাটতে না কাটতেই কিং খানের টপোরি স্টাইলে গাওয়া ‘আপন বোলা’ সাড়া ফেলেছিল গোটা বলিউডে। আর সেই সময়ে বাদ থেকে যাওয়া সলমন এখন একাই সুপারহিট। ‘মেঁ হু হিরো তেরা’ -র হ্যাংওভারেই এখন বুঁদ টিন-এজ রোমিওরা। বিশেষত উল্লেখযোগ্য, নতুন প্রজন্মের কলা-কুশলীরা তাঁদের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গেই ছাপ রাখছে গানের জগতে। আলিয়া ভট্ট, শ্রদ্ধা কপূর, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, ফারহান আখতার, হৃতিক রোশন, অভয় দেওল- এঁরা সকলেই প্লেব্যাক করেছেন তাঁদের নিজেদের ছবির জন্য। তাহলে কি এঁরা সবাই সুরের সমঝদার?
নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই গায়ক বাবুল সুপ্রিয় বলেন, ‘অভিনেতাদের গান গাওয়ার ইচ্ছা বরাবরের। আগে বিকল্প ছিল না, এখন আছে।’ জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী সাউন্ড ডিজাইনার বিশ্বদীপ চট্টোপাধ্যায় এই প্রতিভাকে অবশ্য অভিনেতাদের ‘এক্সটেনশন অফ আর্ট’ হিসেবে দেখতেই পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘ অভিনেতারা নিজেদের স্বরে গান গাইবেন। এটাই ন্যাচারাল। আমরা অ্যানন্যাচারালের সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত, যে ন্যাচারালকে প্রশ্ন করি।’ কিছুটা একই মত পোষণ করেন গায়ক শান। তিনি বলেন ‘ইটজ আ ওয়েলকাম থিং। কোনও অভিনেতা যদি ভাল গায় আর সেটা শুনতে ভাল লাগে তা হলে ক্ষতি কী?’ তবে গায়ক বাবুল সুপ্রিয় যে বিকল্পের কথা বলেন, সেটা কী ?
আজকের টেক-স্যাভি প্রজন্মের সেটা অজানা নয়। অটো-টিউনিং। উন্নত মানের সাউন্ড টেকনোলজি। তাই আলিয়া বা শ্রদ্ধার গান শুনে আপনার মনে হতেই পারে যে কোনও প্রফেশনাল শিল্পীর গাওয়া। পারফেক্টলি টিউনড। তবে কি অ়টো-টিউনের হাত ধরেই এগিয়ে আসছে বলিউডের উঠতি তারকারা? এ যুক্তি মানতে নারাজ সাউন্ড ডি়জাইনার বিশ্বদীপ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘অটো-টিউন ক্যান নট মেক অ্যা সিঙ্গার। ইভেন ইট হ্যাজ ইটস লিমিটেশনস।’ এখনকার প্রফেশনাল শিল্পীরাও অটো-টিউনের সাহায্য নেন। তাহলে অভিনেতাদের আর দোষ কোথায় ?
তবে অভিনেতাদের গলা শুনে যদি শ্রোতারা চিনতেই না পারেন, তা হলে ? তাঁদের কি একদম পারফেক্টলি গাইতেই হবে ? সুরের একটু এদিক-ওদিক তো থাকতেই পারে। এই প্রশ্নের উত্তরে বিশ্বদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘যখন ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ আছে, তা হলে আর ভুল থাকবে কেন? তবে গানে যদি কোনও ‘ফ্ল’(ভুল) থাকলে ভাল লাগে, তা হলে তা রেখেও দেওয়া হয়।’ শুধু সুর নয়, ‘পিচ কারেকশন’-এর সাহায্যে গানের পিচও ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ আছে। তাই হারমোনিয়ামে সা- রে –গা- মা না সাধলেও, পিচ মিলে যাবে অবিলম্বে। সবটাই তথ্য-প্রযুক্তির কৌশল। আসলে পিকচার-পারফেক্ট যুগে অডিও-পারফেক্ট হবে না ই বা কেন বলুন তো! যদিও গায়ক শানের যুক্তি অন্য রকম। ‘শাহরুখ-আমির যখন গান গেয়েছেন, তখন তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের কণ্ঠস্বর মানুষের কানে রেজিস্টার হয়ে গিয়েছে। তাই তাঁদের গান শুনলেই বোঝা যেত এটা তাঁদের গাওয়া। কিন্তু আলিয়া বা শ্রদ্ধা, এঁরা এতটাই নতুন যে এঁদের গলা রেজিস্টারই হয়নি এখনও’, বলেন শান।
প্রকৃত অর্থেই শুধু অডিয়ো সব নয়, তার সঙ্গে চাই ভিডিয়ো। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই অভিনেতাদের গাওয়া এ সব গান ছবির প্রমোশনাল ভিডিয়ো হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর গানের অ্যালবামে থাকে ‘আনপ্লাগ়ড ভার্সান’। তাই গান শোনার আগেই ইউটিউবে লাইকের পারদ বাড়তে থাকে বিরহ-বেদনায় কাতর আলিয়ার স্ট্যান্ড মাইকের সামনে বসা ভিডিয়ো বা হেডফোন লাগানো সলমনের ভিডিয়ো। পুরো ব্যাপারটাই একটা প্যাকেজ। অডিও-ভিস্যুয়াল। বলিউড মানেই তো নতুন নতুন চমক। তা হলে এই চমকের পিছনে মার্কেটিং-এর অবদান কতটা?
বিপণন বিশেষজ্ঞ আমোদ মেহরা বলেন, ‘ইটস অ্যা পাবলিসিটি স্টান্ট।’ তবে প্রধানত এর উদ্দেশ্য, ‘ টু প্লিজ দ্য ইগো অফ দ্য স্টার।’ আর অটো-টিউন যত দিন আছে, এই ট্রেন্ডও থাকবে।
তবে কি প্লেব্যাক শিল্পীদের দিন শেষ? গায়ক বাবুল সুপ্রিয়ের খেদোক্তি, ‘সিঙ্গারস্দের অপরিহার্যতা চলে গিয়েছে।’ প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে কি কোনও খারাপ লাগা তৈরি হয়? বাবুল বলেন, ‘কমার্শিয়ালি তো কিছুটা বটেই।’ আবার গায়ক শানের দাবি: ‘পুরো ব্যাপারটাই লজিক্যাল। কোনও অভিনেতা যদি নিজেই স্টান্ট করতে পারেন, তার যদি ডামির দরকার না হয়, তেমনই কোনও অভিনেতা ভাল গাইলে খারাপ লাগার কিছু নেই।’ আমোদ মেহরাও তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, প্রফেশনাল গায়করা ঘরে বসে আছেন। তবে সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে সদুত্তর নেই। জিজ্ঞেস করলে ‘ইউ কান্ট হেল্প ইট’ বলেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া।
যুক্তি-পাল্টা যুক্তি থাকলেও এটা মানতেই হবে, তথ্য-প্রযুক্তির দৌলতে গান গাওয়া ব্যাপারটা এখন অনেক সহজ। নেই কোনও রেওয়াজের বালাই, নেই কোনও গলদ-ঘর্ম পরিশ্রম। তবে অভিনেতাদের মধ্যে অনেকেরই সুরে মুগ্ধ গায়করা। যেমন অমিতাভ বচ্চন। সত্তরের দশক হোক বা এখন। তাঁর গুণগ্রাহী শান –বাবুল দু’জনেই। নিঃশব্দ ছবিতে ‘রোজানা’ গানটির জন্য তিনি পুরস্কারও পেতে পারতেন, বললেন বাবুল। আবার শানের পছন্দের গায়ক-অভিনেতা শচীন পিলগাঁওকর। এছাড়াও কমল-হাসন তনয়া শ্রুতি হাসন বা রজনীকান্তের জামাই ধনুষেরও অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসাবে সমান জনপ্রিয়তা।
যুগটা বিশ্বায়নের। আর এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সবাইকে ফিল-গুড করানো। তাই মো়টাদের জন্য আছে প্লাস-সাইজ স্টোর, বন্ধুহীনের জন্য আছে ফেসবুক। অভিনেতাদের জন্য আছে প্লেব্যাকের সুযোগ। আর নতুন প্রযুক্তি মানেই তো পুরনোর বিদায়। যেমন ডিএসএলআরের দাপটে বিদায় নিয়েছে স্টিল ক্যামেরা। গান গাইতে পারুক না পারুক, চেষ্টা একবার তো করাই যায়। পাশে আছে তো প্রযুক্তি। তাই বলিউড তারকাদের এখন নতুন মন্ত্র, মেরি শকল হি নেহি, মেরি আওয়াজ হি মেরি পহেচান হ্যায়।