বাবা বিখ্যাত পরিচালক। সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে তারকা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আর যাই হোক না কেন, তারকা হওয়া বোধ হয় ভাগ্যেই ছিল না আরমান কোহালির। বরং চার দশকের কেরিয়ারে নায়ক হিসেবে তাঁকে যত না চিনেছেন মানুষ, তার চেয়ে বেশি চিনেছেন বাস্তবের খলনায়ক হিসেবে।
প্রেমিকাকে মারধর হোক বা গাড়ি চাপা দেওয়া, একের পর এক মামলায় নাম জড়িয়েছে তাঁর। তবে কথায় বলে না, ‘এনি পাবলিসিটি ইজ গুড পাবলিসিটি’। তাই নানা কাণ্ড ঘটিয়েও বার বার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন আরমান।
আরমানের বাবা পরিচালক রাজকুমার কোহালি। তিনি ‘লুটেরা’, ‘নাগিন’, ‘রাজতিলক’-এর মতো হিট হিন্দি ছবি উপহার দিয়েছেন। আরমানের মা নিশি হিন্দি এবং পঞ্জাবি ছবিতে এক সময় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। দারা সিংহের বিপরীতে ‘লুটেরা’ ছবিতে নায়িকা ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই প্রেম এবং বিয়ে রাজকুমার-নিশির।
বাবার পরিচালনায় ‘বদলে কি আগ’, ‘রাজতিলক’-এর মতো ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন আরমান। ১৯৯২ সালে বাবার পরিচালনাতেই ‘বিরোধী’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন তিনি। ধর্মেন্দ্র, সুনীল দত্তের মতো অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে সেই ছবি।
এর পর ওই একই বছর তাঁর দু’টি ছবি মুক্তি পায়, ‘দুশমন জমানা’ এবং ‘আনম’। কিন্ত আরমানকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় সেই দু’টি ছবিও। এর পর ওই বছরই রাজ কাঁওয়ারের পরিচালনায় ‘দিওয়ানা’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পান আরমান।
ছবিতে দিব্যা ভারতী এবং ঋষি কপূররে সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি। সেই মতো শুটিংও শুরু করে দেন। কিন্তু বেশ কিছু দিন শুটিং চলার পর ছবি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন আরমান। তাঁর যুক্তি ছিল, ঋষি কপূর যে ছবিতে রয়েছেন, সেই ছবিতে দ্বিতীয় নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ লাভ নেই তাঁর।
আরমান ছবি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তাঁর জায়গায় শাহরুখ খানকে নেওয়া হয়। বাকিটা ইতিহাস। ‘দিওয়ানা’ রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে শাহরুখ খানকে। শুধু তাই নয়, বলিউডে শাহরুখের দীর্ঘ যাত্রাপথে ‘দিওয়ানা’কেই প্রথম মাইলস্টোন হিসেবে ধরা হয়।
তবে এর থেকে শিক্ষা নেওয়া তো দূর, বরং আব্বাস মস্তানের ‘বাজিগর’ ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন আরমান। সেই ছবিও পরে শাহরুখ খানের ঝুলিতে যায়, যা রাতারাতি ভার্সেটাইল অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে শাহরুখকে।
১৯৯৫ সালে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিতে একটি চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল আরমানের। তিনি পিছিয়ে এলে ওই চরিত্রে অভিনয় করেন পরমিত শেট্টি। ‘দিলওয়ালে...’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সফল ছবি।
এই সময়ের মধ্যে ‘কোয়েল’, ‘কোহরা’, ‘অওলাদ কে দুশমন’, ‘জুয়াড়ি’, ‘বীর’-সহ একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন আরমান। কিন্তু প্রতিটি ছবিই বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। ছেলের কেরিয়ারে গতি ফেরাতে তাই চালকের আসনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন রাজকুমার কোহলি।
১৯৯৭ সালে সুনীল শেট্টি, সানি দেওল এবং আরমানকে নিয়ে ‘কহর’ ছবি তৈরি করেন রাজকুমার কোহলি। সুনীল শেট্টি ও সানি দেওল তখন নিজেদের কেরিয়ারের তুঙ্গে। রাজকুমার কোহালির সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল তাঁদের। তাই ওই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যান তাঁরা। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। ছবিটি ফ্লপ হয়।
১৯৯৭ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত কোনও ছবির অফার পাননি আরমান। ২০০২ সালে ‘দুশমনি’ ছবিতে দেখা যায় তাঁকে। ওই বছরই বাবার পরিচালনা ও প্রযোজনায় ‘জানি দুশমন: এক অনোখি কহানি’-তে অভিনয় করেন তিনি। ‘জানি দুশমন...’ এর জন্য চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখেননি রাজকুমার। সানি দেওল, অক্ষয়কুমার, সুনীল শেট্টি, মণীষা কৈরালা, আফতাব শিবদাসানি, সোনু নিগমের মতো একঝাঁক তারকাদের মাঝে ছেলেকে অভিনয়ের সুযোগ দেন তিনি।
ছবিতে স্পেশ্যাল এফেক্টেও বিশেষ জোর দিয়েছিলেন রাজকুমার। হলিউডের ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবির অনুপ্রেরণায় সমস্ত অ্যাকশন দৃশ্যগুলি সাজান। কিন্তু বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে সেই ছবি। শুধু তাই নয়, ‘জানি দুশমন...’ ছবিতে অভিনয়ের পর সানি দেওল, অক্ষয়কুমারদের কেরিয়ারেও ভাটা আসে। আজও ওই ছবিটি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ অব্যাহত সোশ্যাল মিডিয়ায়।
এর পর ২০০৩ সালে ‘এলওসি: কার্গিল’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান আরমান। কিন্তু তার পর বহু বছর সিলভার স্ক্রিনে দেখা যায়নি তাঁকে। ২০০২ সালে তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে এক মোটরবাইক আরোহীকে ধাক্কা মারায় খবরে উঠে আসেন আরমান। ২০০৮ সালে তৎকালীন প্রেমিকাকে মারধর করার অভিযোগেও ফের তাঁকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়।
শোনা যায়, সেই সময় অভিনেত্রী মুনমুন দত্তর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আরমানের। তাঁর বদরাগী স্বভাবের জন্য প্রায়ই তাঁদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতো। অভিযোগ, সেই অবস্থাতেই এক দিন মুনমুনকে বেধড়ক মারধর করেন আরমান। অভিনেত্রী ডলি বিন্দ্রা সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন বলে জানা যায়।
আরমান ও মুনমুন এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে মুখ খোলেননি যদিও। কিন্তু সেই ঘটনার পর দু’জনের সম্পর্ক ভেঙে যায়। পরবর্তী কালে আরমানের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও অস্বীকার করেন মুনমুন। ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশমা’ সিরিয়ালে দৌলতে তিনি এখন অত্যন্ত পরিচিত নাম। আগের জীবনের দিকে ফিরেও তাকাতে যেতে চান না মুনমুন।
২০১৩ সালে রিয়্যালিটি শো ‘বিগ বস’-এ আরমানকে সুযোগ দেন সলমন খান। শুরুতে ভাল আচরণের জন্য তাঁর প্রশংসাই করেন সকলে। কিন্তু ধীরে ধীরে ফের বদরাগী মেজাজ ফিরে আসে তাঁর। অনুষ্ঠান চলাকালীনই প্রতিযোগী সোফিয়া হায়াতকে নিগ্রহ করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও এক দিন পরেই জামিন পেয়ে ফের অনুষ্ঠানে ফিরে আসেন তিনি।
শোনা যায়, গ্রেফতার হওয়ার পর আর অনুষ্ঠানে ফিরে আসতে চাননি আরমান। কিন্তু সলমন খান তাঁকে বোঝান। তাতেই মতি ফেরে তাঁর। ‘বিগ বস’-এর ঘরে থাকাকালীনই অভিনেত্রী তনুজার মেয়ে এবং কাজলের বোন তানিশার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত আরমানের। ‘বিগ বস’ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এক সঙ্গে নানা জায়গায় দেখা যায় তাঁদের। কিন্তু আরমানের বদমেজাজি স্বভাবের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পেরে সম্পর্ক থেকে সরে আসেন তানিশা।
এ পর অভিনেত্রী নীরু রণধাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আরমান। কিন্তু কয়েক মাস পরেই আরমানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন নীরু। তাঁর অভিযোগ ছিল, চুলির মুঠি ধরে দরজায় তাঁর মাথা ঠুকে দিয়েছেন আরমান। বেধড়ক মারধর করেছেন তাঁকে। জখম অবস্থায় হাসপাতাল থেকে নিজের ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন নীরু।
আগেও আরমান তাঁকে মারধর করেছেন বলে জানান নীরু। তিনি জানান, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এক বার আরমান তাঁকে এমন মেরেছিলেন যে তাঁর নাকে ভয়ানক চোট লেগেছিল। রাগে দুবাই চলে গিয়েছিলেন তিনি। পরে সেখান থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন আরমান। হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু তার পরেও আরমান একটুও বদলাননি বলে অভিযোগ।
এই সময় আরমানের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করেন নীরু। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গা ঢাকা দেন আরমান কোহালি। প্রায় এক সপ্তাহ পর লোনাবালা থেকে আরমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শোনা যায়, লোনাবালায় এক বন্ধুর ফার্মহাউসে ছিলেন আরমান। সিম কার্ড কিনতে এক বার বাইরে বেরিয়েছিলেন। তখনই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিছু দিন জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে যান তিনি। পরে মামলার খরচ চালাতে না পেরে আরমানের উপর থেকে মামলা তুলে নেন নীরু।
এত কিছুর পরেও ২০১৫ সালে আরমানকে ‘প্রেম রতন ধন পায়ো’ ছবিতে সুযোগ দেন সলমন খান। ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন আরমান। ‘প্রেম রতন...’ বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য পেলেও, তা যে সলমন এবং সুরজ বরজাতিয়ার যুগলবন্দির জন্যই সম্ভব হয়েছে, তা একবাক্যে মেনে নেন সকলে। ছবিতে আরমান কারও নজরই কাড়তে পারেননি। ১২ বছর পর বড় পর্দায় এমন সফল ছবির হাত ধরে প্রত্যাবর্তন করলেও তার পর থেকে একটাও ছবির অফার পাননি তিনি।