‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ছবির মূল গল্প এগোবে কী করে? ছবি: সংগৃহীত।
‘‘নো উওম্যান নো ক্রাই’’ এই বিখ্যাত গানটি দিয়ে শুরু হয়েছিল ‘ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্ডা ফরেভার’ ছবির প্রথম ঝলক। চ্যাডউইক বসম্যান নেই। তাঁর অনুপস্থিতি মার্ভেল ইউনিভার্সকে যেন ক্রমাগত এক শূন্যতার দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ চরিত্রটি যেন চ্যাডউইকের জন্যই তৈরি। তিনিই যখন নেই, তবে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ চরিত্রে কাকে দেখা যাবে, মার্ভেল সিনেম্যাটিক জগতে কি ‘কিং টা’চলা’ এসেই হারিয়ে গেল, একরাশ মনখারাপের মাঝেও এই প্রশ্নগুলি ঘোরাফেরা করছিল মার্ভেল অনুরাগীদের মনে। অবশেষে ঘোষণা হল, বড় পর্দায় ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ফিরছে। কিন্তু কে হবে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’? চ্যাডউইক দর্শকের মনে যে ছাপ ফেলেছিলেন, অন্য কেউ কি তার এক অংশেও প্রভাব ফেলতে পারবেন? একঝুলি প্রশ্ন এবং অপেক্ষার মাঝে একে একে বেরিয়ে পড়ল ছবির প্রথম ঝলক, ট্রেলার। চ্যাডউইকের স্মৃতিচারণে ডুবে গেলেন দর্শকমহল। দর্শকের অনুভূতির সঙ্গে যেন ছবির গল্পেও মিল রয়েছে। কষ্টগুলো যেন এক রকম, প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ। ক্যামেরার ও পার-এ পার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্ল্যাক প্যান্থারকে ছাড়া (চ্যাডউইক) ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ছবির মূল গল্প এগোবে কী করে? হাজার চেষ্টা করার পরেও এই ছবিটি মুখ থুবড়ে পড়বে না তো? দর্শকের মনখারাপ এবং কৌতূহলকে সঙ্গী করে শুক্রবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল ‘ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্ডা ফরেভার’।
চ্যাডউইক বসম্যানের উদ্দেশে অসামান্য ট্রিবিউট মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। ছবি: সংগৃহীত।
ছবি শুরু হয় চ্যাডউইক বসম্যানের উদ্দেশে অসামান্য ট্রিবিউট জানিয়ে। ক্ষণিকের মধ্যেই যেন দর্শকের মনের খবর পেয়ে গেলেন পরিচালক রায়ান কুগলার। ছবিতেও দেখানো হচ্ছে, ‘কিং টা’চলা’ মারা গিয়েছেন। ওয়াকান্ডার সকলে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন তাদের রাজাকে, তাদের ব্ল্যাক প্যান্থারকে। রাজা নেই, সিংহাসন ফাঁকা। রাজার মুকুট পরবে কে, কে-ই বা শক্ত হাতে বিশ্বদরবারে ওয়াকান্ডা-খ্যাত ভাইব্রেনিয়ামের প্রসঙ্গ নিয়ে সরব হবে? রাজার অভাবে রাজ্যও যাবে গচ্ছায়। তাই সব দেশের নজর গিয়ে পড়ল ভাইব্রেনিয়াম দখলের উপর। এই পরিস্থিতিতে ওয়াকান্ডার হাল ধরল ‘কিং টা’চলা’র মা ‘রেমন্ডা’ (অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট)।
মেয়ে ‘শুরি’ দাদাকে হারানোর যন্ত্রণা ভুলে থাকতে নিজেকে আরও বেশি কাজে ডুবিয়ে দিয়েছে। এক বছর কেটে যাওয়ার পরেও শুধু কাজে ডুবে রয়েছে সে। কিন্তু এই ছবিটি কি শুধু মাত্র পরিবারের আবেগের উপর নির্ভর করে বানানো হয়েছে? মার্ভেলের কোনও খলনায়ককেই কি দেখানো হবে না? তা কী করে চলে? গল্প এগোতেই আবির্ভাব হয় ‘নামোর’ চরিত্রের। মার্ভেল ওয়ার্ল্ডের মিউট্যান্টদের মধ্যে এক জন। টালোকান জাতির লোকেরা তাঁকেই রাজা মানেন, তাঁকেই ভগবান মানেন। গল্প যত এগোতে থাকে, প্রতিটি চরিত্রের অনুভূতির গ্রাফগুলিও স্পষ্ট ধরা পড়তে থাকে ক্যামেরায়।
‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ চরিত্রটি যে ভাবে ফিরে এসেছে তা দর্শককে বিন্দুমাত্র হতাশ করবে না। ছবি: সংগৃহীত।
এই গল্পে আবির্ভাব হয় আরও একটি নতুন মার্ভেল চরিত্রের, ‘আয়রনহার্ট’। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডমিনিক থর্ন। গল্পে চরিত্রটির গুরুত্ব থাকলেও তাঁর অভিনয় যেন বড্ড হালকা। একটি কমিক দৃশ্য দেখে ‘স্পাইডারম্যান’ এবং ‘আয়রনম্যান’-এর একটি কথোপকথনের দৃশ্য মনে পড়ে যেতে পারে। অনেক চেষ্টা করেও ডমিনিক যেন ‘আয়রনহার্ট’ চরিত্রটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারলেন না।
ছবিতে ‘নামোর’ এবং ‘শুরি’— এই চরিত্র দুটি গঠনের পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে, ছবির প্রথমার্ধ অনেকটাই দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে। প্রথমার্ধে হাতেগোনা কয়েকটি জমজমাট অ্যাকশন দৃশ্য ছাড়া মন কাড়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। কমিক টাইমিং ভীষণ কম। সাধারণত, মার্ভেল ছবির অন্যতম আকর্ষণ হল কিছু মজার সংলাপ, তার সঙ্গে মজাদার দৃশ্য। আগের ছবিগুলির সঙ্গে তুলনা করলে, এই ছবিটি যেন কমিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়ে গেল। তবে, এই ছবি মোড় নেয় দ্বিতীয়ার্ধে। টানটান উত্তেজনা, নজরকাড়া অ্যাকশন দৃশ্য। তার সঙ্গে দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং সিজিআই প্রযুক্তির ব্যবহার। সম্পূর্ণ ছবির রসদ যেন এগুলিই। ওয়াকান্ডার ‘দোরা মিরাজ’ যত বার স্ক্রিনে এসেছে, তত বার যেন নতুন লেগেছে। এর পিছনে বিজিএম-এর ভূমিকা নেহাত কম নয়। স্লো মোশন অ্যাকশন দৃশ্যগুলির জুড়ি মেলা ভার।
‘নামোর’ চরিত্রে টেনচ হুয়ের্তার অভিনয় বেশ ভাল। এর আগে তিনি ‘দ্য ফরেভার পার্জ’ ছবি এবং ‘নার্কোস: মেক্সিকো’ ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছেন। কিন্তু এই চরিত্রে অভিনয় করে তিনি তাঁর কেরিয়ারে মাইলফলক গড়ে তুললেন। প্রিয়জন হারানোর শোক কী ভাবে মানুষের মনে প্রতিশোধের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে, এই গল্পে তা খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ওয়াকান্ডার প্রতিটি নারীচরিত্রের দৃঢ়তা মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। যুদ্ধের সময় অভিনব স্যুট এবং অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াও ভিজুয়্যাল এফেক্টের প্রশংসা আলাদা করে করতেই হয়। গল্পের শেষে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ চরিত্রটি যে ভাবে ফিরে এসেছে তা দেখার পর দর্শক বিন্দুমাত্র হতাশ হবেন না।
মার্ভেলের ছবি, অথচ ক্রেডিট সিন থাকবে না, তা হয়? ছবির মিড ক্রেডিট সিনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগময়ও বটে। তবে, এন্ড ক্রেডিট সিন দর্শককে হতাশ করবে। ‘‘ব্ল্যাক প্যান্থার ফিরে আসবে’’— এই বার্তাটুকু দেওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুই নেই। সিনেমায় সময় বুঝে মিউজিকের ব্যবহার করা হয়েছে। যে মুহূর্তে পর্দায় চ্যাডউইক বসম্যানের মুখ ভেসে উঠছিল, সেই সময় যেন এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য ঘিরে ধরেছিল। আবার, অ্যাকশন দৃশ্যে সেই রকম উত্তেজনাময় মিউজিক। সিনেমার গল্প ছাড়াও এই ছবির বিজিএম, কস্টিউম ডিজাইন, ভিজুয়্যাল এফেক্ট দুর্দান্ত। কয়েকটি নেতিবাচক দিক থাকলেও সব শেষে ভালর দিকেই যেন পাল্লা বেশি ঝুঁকে রইল।