তাপস পাল।
এই প্রেম,কলেরার দিনগুলিতে নয়, বরং মাতাল সমীরণে শিমুলতলার গলিতে-উপগলিতে ব্যাকুল বসন্তের মতো। ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে সে দিনকী যে লাবণ্য ছিল, আর মায়া! আমরা সত্যিই ভাবতে পেরেছিলাম, বাঙালির আপাত ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার মধ্যেও একটি মধুর অবসর আছে যেখানে এক উদ্ভিন্নযৌবনা বালিকা ও নিষ্পাপ ঋষিকুমার। আশির দশকের শুরুতে তাপস পাল আমাদের মনে যে বাঁশি বাজিয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। সেলুলয়েড যুগের একেবারে শেষ দিক, অথচ ডিজিটাল স্টুডিয়ো পাখা মেলেনি, বাংলার স্টুডিয়োগুলির একেবারে হতশ্রী অবস্থা উত্তম বিহনে, তখনই তাপস পাল এলেন অনেকটা সান্ত্বনাবাক্যের মতো।‘দাদার কীর্তি’র দাদাটি মধ্যরাতে সরোবর থেকে উত্থিত হয়ে পর্দায় দেখা দিলে আপামর বাঙালির মনে হয়, এই তো— শাপভ্রষ্ট দেবদূত। তরুণ মজুমদারের আখ্যানে তেমন কোনও জটিলতা ছিল না। ফলে আমরা নবীন কিশোরটিকে ‘ইডিয়ট’ ভাবতে পারি। কিন্তু সে কোনওক্রমেই রুশ উপন্যাসের নায়ক প্রিন্স নিশ্চিতনয়। তাপস পাল নিতান্তইবসন্তের প্রথমে ফুটে ওঠা আমের মুকুলের মতোই নিষ্পাপ। তাঁকে বাঙালি সাগ্রহে বরণ করেছিল। আজ তাঁর প্রয়াণের পরে মনে হয়, উত্তম যুগ ও ডিজিটাল সিনেমার মধ্যে তিনি সেতুবন্ধনের কাজ করে গিয়েছেন।
আশির দশকের বাংলা ছবি, মোটামুটি অভিভাবক শূন্য। সেই সময় প্রথমে তাপস পাল ও ঈষৎ পরে প্রসেনজিতের আগমন না ঘটলে বাংলা ছায়াছবি সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়ত। তাপস পালের মেলোড্রামাটিক অভিনয় অন্তত মফস্সল ও গ্রামবাংলাকে বুঝিয়েছিল, সরল, আর্ত, ক্রুদ্ধ ও আবেগপ্রবণ বাঙালি যুবকের মাহাত্ম্য। এই যুবক রাজনীতি করে না, কিন্তু অপশাসনের বিরুদ্ধে মাথা তোলে। নতুন শহর, নতুন শিল্পায়ন, সভ্যতা পাল্টে যাচ্ছে। তাপস পাল সেখানে একটি নস্টালজিক রেফারেন্স।
আরও পড়ুন-আমাদের কাছে তাপস আঙ্কল মানেই, একটার পর একটা ব্লকবাস্টার ছবি: সোহম
আশির দশকে প্রথমে তাপস পাল ও ঈষৎ পরে প্রসেনজিতের আগমন না ঘটলে বাংলা ছায়াছবি সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়ত
ব্যক্তিগত আলোচনার সময়ে দেখেছি, তাঁর জীবনে দু’টি গৌরবস্থল। প্রথমত, তাঁর পিতৃদেব যে সরকারি চিকিৎসক ছিলেন সেই পারিবারিক আভিজাত্যটুকু তাপস সগর্বে উল্লেখ করতে চাইতেন। দ্বিতীয়ত, মাধুরী দীক্ষিতের প্রথম চলচ্চিত্র যে তাঁর সঙ্গে এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে সলজ্জ তাপস জানাতেন যে, মাধুরী কলকাতায় এলেই তাঁকে ফোন করে শারীরিক কুশল কামনা করেন। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে তাপস পাল নিয়মিত দর্শক ছিলেন। এমনকি, দুপুরবেলায় নির্জন কমিটি রুমে তাপসবাবু চিলির পরিচালক মিগুয়েল লিতিনের সঙ্গে লঘু পরিহাসে মজে থাকতেন।
আরও পড়ুন-‘শিল্পীদের রাজনীতি করা উচিত নয়’, মনে করছেন টলিউডের একাংশ
তাপস পাল কত বড় অভিনেতা তা বিচার করার সময় এখন নয়। শতাব্দীর শেষ মুহূর্তে যখন উদারীকরণের আবহাওয়ায় গ্রাম ও শহর চেহারা বদল করছে, সেই সময়কার দোদ্যুল্যমান রুচির চাহিদা তিনি অনেকটাই পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।
(লেখক পরিচিতি : সিনেমা তাত্ত্বিক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক)