গ্রাফিক-শৌভিক দেবনাথ।
শহর কলকাতা নয়, বেলঘরিয়া, অর্থাৎ শহরতলিতে বড় হয়ে ওঠা। যে কোনও বাঙালি পরিবারের মতো আমাদের পরিবারে রাজনৈতিক চেতনা ছিল, রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন পরিবেশেই বড় হয়ে ওঠা। বিভিন্ন ধরনের খবরের কাগজ পড়া আর দেশ জুড়ে কারা কী করছেন কিন্তু কিছু বলছেন না, আবার যাঁরা যা কিছু বলছেন, কোন জিনিসগুলি তাঁরা করছেন না, তা নিয়ে সম্যক ধারণা ছিল। তবে, ভোটকেন্দ্রে প্রথম যাওয়া আমার ঠাকুরমার হাত ধরে। পিচবোর্ডের কাগজে ঘেরা জায়গা, যেখানে ব্যালট, কিংবা হাল আমলের ইভিএম মেশিন রাখা হয়, সেটা দেখলে বড্ড রাগ হত। কারণ, আমাকে কেন সেই জায়গায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না, এটা দেখে। মনে হত, কী এমন নিষিদ্ধ জায়গা সেটা! ছোটবেলায় বিস্ময় জাগত। বড় হতে বিস্ময় কেটে গিয়ে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল। ওই ভোটকেন্দ্রে উর্দিধারী পুলিশ কিংবা সশস্ত্র সেনা দেখে ভাবতাম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উৎসবে এত কিছুর প্রয়োজন কী! বয়স যখন আর একটু বাড়ল তখন যে দ্বন্দ্বটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল, তা খানিক এ রকম— আমরা নির্বাচনে অংশ নিই ঠিকই। কিন্তু, আমরা কি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? সার্বিক ভাবে কি গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠতে পেরেছি? যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই দেশের জন্ম, এই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, সেগুলি কি শেষ পর্যন্ত রাখা গেল?
তবে, বড় হয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও ছোটবেলায় ভোট ছিল অঘোষিত ছুটির দিন। বাবা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে টিভির পর্দায় চোখ রেখে নম্বরের ওঠানামা দেখছেন। পাশপাশি চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে আমার বেড়ে ওঠা, আগেই বললাম, বেলঘরিয়া নিমতা অঞ্চলে। সেই সময় সেখানে এক রকমের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল। এখন যখন বর্তমান পরিস্থিতি দেখি, মনে হয়, তখন একটা অন্য গ্রহে ছিলাম। তখনকার পৃথিবী ও আশপাশ যেন হঠাৎই বদলে গেল। আসলে মনে হয়, বদলটা ঘটেছে মানুষের মানসিকতায়। বিরাট পরিবর্তন এসেছে রাজনীতিতেও। যত সময় যাচ্ছে মনে হচ্ছে, রাজনীতি শুধুই পেশা একটি চাকরির মতো, নেশা আর নেই। রাজনীতির মূল্যবোধ, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তার কথা এখন শুধু লোকমুখে শুনতে পাই। কাজের বেলায় দেখা যায় না। ছোটবেলায় আমরা জেনেছিলাম, ভাতা দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যায় না, এখন সেই মডেলেরই রমরমা। আমরা মনে করেছিলাম, সব কিছু পাল্টে যাবে ভালর জন্য। অনেক কিছুই পাল্টায়নি।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর যখনই আমরা ভোটটা দিই, একেবারেই যে নিরাশ হয়ে দিই, এমনটা নয়। প্রতি বারই কিছু না কিছু প্রত্যাশা থাকে। এ বারেও তার ব্যতিক্রম নয়। খালি আমার একটাই অনুরোধ, যে দলই সরকার গড়ুক না কেন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে যেন উস্কানি না দেয়। সেটা আমাদের দেশের ঐতিহ্য নয়। সব কিছুকে একটা গুলিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা ক্ষমতাশীলদের থাকে, তা বন্ধ হোক এ বার। আমরা রাজতন্ত্র বা জমিদারি প্রথা ছেড়ে গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছি, কারণ রাজার ছেলে গরিবের দুঃখ বুঝতে পারবে না। আরও একটা কারণ, যাতে আমাদের মধ্যেকার এক জন দেশ চালাতে পারে। সরকার কিংবা কোনও ব্যক্তি নিজেকে রাজা নয়, প্রজার মতো ভেবেই যেন দেশটা চালায়। ক্ষমতা বা গদি পেয়ে যাতে সে বা তারা বদলে না যায়, এই আশাটুকু রাখি। প্রবাদ রয়েছে, যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ। কিংবা, ক্ষমতা হাতে পেলে সব চরিত্রই এক। চাইব, এ বার সেই ধারণাগুলো ভেঙে যাক।
আজকাল পার্টিগুলোকে বড় বড় কোম্পানির মতো মনে হয়। তারা ভোট এলে যে রাজকীয় ভাবে প্রচার করে, মনে হয়, তারা আমার মতো মানুষের থেকে বড্ড দূরের কেউ। যখন দেখি, আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা নেতা হেলিকপ্টার চড়ে প্রচার করছেন, মনে হয়, সেখানে আস্ফালন যেন বেশি। তাঁদের উচিত মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়া, মানুষের কাছে চলে আসা। কিন্তু আজকাল এত বেশি গ্ল্যামার আর জৌলুস যে, বড্ড দূরের মনে হয় তাঁদের। আসলে যে সময় থেকে এই দেশের মিশ্র অর্থনীতি থেকে উদার বাণিজ্যনীতিতে উত্তরণ ঘটল, তবে থেকেই এই সব পার্টির রমরমা। আগে ভোট এলে তো দেওয়াল লিখন হত, কার্টুন হত, এখন সবটাই ডিজিটাল মাধ্যমে। এত কুৎসা ছিল না, এত ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল না। কেমন যেন বদলে গেল চারপাশ। তবে আমি এটাও বলব, দেশবাসী হিসেবে আমরাও বড্ড অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি। আমার নিজেরা যদি পাল্টাতে না পারি, এই আশা রাখা ভুল যে, নেতা এসে সব পাল্টে দেবে।
আমি নিজে রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চেয়েছি। কিন্তু কলেজ জীবন থেকে দেখছি, যখনই কেউ একটা নির্দিষ্ট দলের পতাকা হাতে নেয়, নিজের দলের সমালোচনাই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এটা তো হয় উচিত নয়! তখনই ভেবে নিয়েছিলাম, সারা জীবন রাজনীতি সচেতন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই, প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চাই না। একটা দলকে সমর্থন করি বলে তার কার্যকলাপের সমালোচনা করা যাবে না, এটা কে বলে দিয়েছে! যে নেতা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তিনি চলে যাওয়ার পর কিন্তু মানুষের মনে থেকে যেতে পারেন না। আমার মনে হয়, যত বেশি সমালোচনা শুনতে শিখবে দলগুলো, ততটাই তাদের লাভ হবে। সেই নেতাই থেকে যান, যিনি রাজধর্ম পালন করতে জানেন। সবার আগে শোনার ধৈর্য কিংবা কান তৈরি করা উচিত। যে নেতা শোনেন কম, তিনি নিজের ধারণাই চাপিয়ে দেন দেশবাসীর উপর।
প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে মানুষ ব্যক্তিগত কাজ জলাঞ্জলি দিয়ে ভোটে মাতেন না। কিন্তু এখানে ভোট মানেই ব্যক্তিজীবনে বিঘ্ন।
বোমাবাজি, হিংসা, উত্তেজনা, যেন কোনও অ্যাকশনধর্মী সিনেমার ক্লাইম্যাক্স। আমার প্রশ্ন, সবই যখন পাল্টাচ্ছে, কবে আমরা নির্বিঘ্নে ভোটটা দিতে পারব?