ফাইল চিত্র।
যেন নোনাধরা পাঁচিলের ফাটলে গজিয়ে ওঠা কোনও নাইন ও’ক্লক ফুল! স্নিগ্ধ আভা তাদের সর্বাঙ্গে। তরুণ মজুমদারের ছবি এমনই। সারা জীবন আমরা তাঁর ছবিতে এমন মাধুর্য খুঁজে পেয়েছি যে মনেই হয়নি তাঁর রচনায় তিক্ততা, রিরংসা, অথবা দিনযাপনের মলিন কোনও দাগ রয়ে গেছে। তরুণবাবুর সমসাময়িক গত শতকের পঞ্চাশের দশকের তরুণ কবিদের থেকেও তাঁর ছবির জগৎ এতটাই আলাদা।
যখন ‘বালিকা বধূ’ তৈরি হয়, আমরা ইস্কুলে। একটা যুগের বয়ঃসন্ধি আর ওই ছবির শরীরে যে তীব্র বাঁক, তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, মৌসুমীর চকিত হরিণীর মতো চাউনি আর একটি কিশোরের অভিমানী ওষ্ঠপ্রদেশ, আদিগন্ত নীলিমা— ‘বালিকা বধূ’ আমাদের রক্তে যে কী বিষ ছড়াল, পুরো একটা সপ্তাহ ধরে পড়ার বইতে আর মন বসল না। প্রতিটি পাতায়, দেওয়ালে জেগেছিল একটি বালিকার আরক্ত কপোল, সেই জেগে থাকায় একটি লাজুক অনুমতি পত্র প্রদান করেছিলেন শ্রী তরুণ মজুমদার।
আমরা তাঁকে ভালবেসেছিলাম কোনও স্টার-ব্যবস্থা ছাড়াই। আমাদের সে কৈশোরে খাদ্য আন্দোলন, গুলিচালনা, রক্ত আর বারুদ ছড়িয়ে। ‘বালিকা বধূ’র ব্রিটিশ বিরোধী মাস্টারমশাইকে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন কুয়াশা ও দিগন্তরেখা রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে যে ছবিটি উপহার দেয়, তাতে এক অলীক স্বর্গ যাপনের প্রতিশ্রুতি। কী অলৌকিক ছিল তরুণ মজুমদার আর তাঁর ক্যামেরাম্যান সৌম্যেন্দু রায়ের সহযোগিতা। এমন দৈবী করমর্দন তার আগেও তো দেখেছি ‘পলাতক’ ছবিতে। সেখানে নদীর ওপরে ‘ডে ফর নাইট’ ফটোগ্রাফি কী অসামান্য। আমাদের বাড়িতে কোনও নতুন জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে আমরা বড়রা-ছোটরা নির্বিশেষে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর ‘একটুকু বাসা’। ও-রকম নিষ্পাপ, হাসির, কৌতুকের অবসর বাংলা ছবিতে আজও পেলাম না। আজ যখন আমিও জীবনের প্রান্তে, তখন হয়তো বলব, তরুণবাবুর ‘সংসার সীমান্তে’ বা ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিটির কথা। চোর ও গণিকার প্রণয়, নীচের মহল কী চমৎকার হাতে হাত মিলিয়ে হাঁটে— বাস্তবের সঙ্গে তা প্রেমেন্দ্র মিত্রের থেকে একটু ভিন্ন পথে, একটু লাবণ্যের স্পর্শ দিয়ে বলে যেতে পারেন তরুণ মজুমদার। আর আমি বলব, এই বলে যাওয়াটা কম কথা নয়। বাঙালিরা গল্প বলতে জানে। সেটা যেদিন বাংলা ছবি সবাক হয়ে উঠল, তার পর থেকেই মূলত নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োর সৌজন্যে আমরা জানতে পেরেছি। নিউ থিয়েটার্স কী করেছিল? মূলত বাঙালির গল্প বলার, গল্প শোনার ও গল্প লেখার যে সহজাত অধিকার আছে তাতে একটি বিধিসম্মত সিলমোহরের ছাপ দিয়েছিল। তরুণ মজুমদার সেই ঐতিহ্যেরই শেষতম প্রতিনিধি।
আমরা বাঙালিরা গল্প বলতে পারি, আজকের বাংলা ছবি দেখলে সে-কথা হয়তো পাগলের প্রলাপ বলে মনে হবে। মনে হবে বলেই তরুণ মজুমদারকে আমাদের এমন দ্বীপ মনে হয় যেখানে ‘তমালতালিবনরাজিনীলা’। ‘পলাতক’ ছবিটির দিকে তাকালে আমরা দেখি অনুপকুমারের মতো একজন পার্শ্ব অভিনেতাও প্রান্তিক চরিত্রে কী ভাবে নায়ক হয়ে ওঠেন। পরিধিকে কেন্দ্রে টেনে আনা— এই কৃতিত্ব তরুণবাবুর সর্বাঙ্গে। সচরাচর মহার্ঘ নায়কনায়িকার শরণাপন্ন হননি। তবু তরুণবাবু যে আমাদের মুগ্ধতাতে একটি জড়োয়ার হার জড়িয়ে দিতে পারেন তার কারণ তিনি অনুভূতির, প্রথম কম্পনের আলোছায়া, ওঠাপড়াগুলিকে কী প্রযত্নেই না গেঁথে রাখেন। মনে করুন, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’। যদি ভাবেন বাল্যপ্রেমেই তিনি একমাত্র স্বচ্ছন্দ, তা হলে মনে করুন আদি যুগের ‘কাচের স্বর্গ’। আসলে তাঁর সব কাহিনিতেই তিনি আখ্যানকে চলমান রূপকথা হিসেবে দেখাতে পারেন। তরুণবাবুর ছবিতে বিচিত্রস্পেক্ট্যাক্ল থাকে না। দামি নায়কনায়িকাদের মিছিলও থাকে না। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে তিনি এমন এক কথকঠাকুর, জনপ্রিয়তার সরস্বতী যাঁর কণ্ঠে। আমাদের সাহিত্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র বা বিমল কর আছেন। আমাদের চলচ্চিত্র কাহিনি বুননে তরুণ মজুমদার এ রকমই কোনও শকুন্তলার আংটি পরে দর্শকের কাছে চিরদিনের স্মৃতি হয়েই থেকে যাবেন।
(লেখক চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক)