স্কুলের পড়া বা পারিবারিক ব্যবসা, কোনওটাতেই মন নেই ছেলের। অঙ্কে ছিলেন একেবারেই কাঁচা। পড়াশোনার খরচ চালাতে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে ভয়েস আর্টিস্টের কাজ করতেন তিনি। পরে বিনোদনের জগতই হয়ে দাঁড়াল জীবনের মূল বিন্দু। গালিচা ব্যবসায়ীর ছেলে গোবর্ধনকে সবাই চিনল কমেডিয়ান আসরানি পরিচয়ে।
পাকিস্তানের সিন্ধে আসরানির জন্ম ১৯৪১-এর ১ জানুয়ারি। দেশভাগের পরে তাঁর পরিবার চলে আসে রাজস্থানের জয়পুরে। সেখানেই গালিচার ব্যবসা শুরু করেন তাঁর বাবা। গোলাপি শহরেই চার বোন ও তিন ভাইয়ের সঙ্গে শৈশব কাটে আসরানির।
তাঁর জন্মগত নাম গোবর্ধন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি এই নাম ব্যবহার করেননি। বরং ভারতীয় সিনেমা তাঁকে চিনেছে তাঁর পদবিতেই। সেখানে তিনি কমেডিয়ান আসরানি।
ষাটের দশকের শুরুতে জয়পুরেই অভিনয়ের হাতেখড়ি আসরানির। ১৯৬২ সালে ভাগ্যের খোঁজে তিনি মুম্বই চলে আসেন। এক বছর পরে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কথাতেই আরও গুরুত্ব দিয়ে অভিনয় শুরু করেন আসরানি।
পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে কোর্স করার পরে আসরানি প্রথমে ১৯৬৭ সালে অভিনয় করেন গুজরাতি ছবিতে। এর পর গুজরাতি ছবির ইন্ডাস্ট্রিতেই তিনি কাজ করতে থাকেন। বলিউড থেকে ডাক আসতে সময় লাগে বেশ কিছু দিন।
১৯৬৯ সালে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচলনায় তিনি অভিনয় করেন ‘সত্যকাম’ ছবিতে। এটাই তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি। এর পর ‘মেরে আপনে’ ছবিতে তিনি নজর কাড়েন।
সত্তরের দশক থেকে আসরানিকে বলিউডে নিয়মিত দেখা যেতে থাকে কমেডিয়ান বা সহনায়কের ভূমিকায়। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ অবধি মোট ১০১টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
‘বাবর্চী’ ছবির সেটে রাজেশ খন্নার সঙ্গে প্রথম আলাপ আসরানির। সেই আলাপ পরিণত হয় গভীর বন্ধুত্বে। ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ অবধি, রাজেশ খন্নার সঙ্গে মোট ২৫টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। তাঁদের জুটিতে শেষ ছবি ‘ঘর পরিবার’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯১ সালে।
গুলজার, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকের তিনি ছিলেন পছন্দের অভিনেতা। সহ অভিনেতা হিসেবে আসরানির উল্লেখযোগ্য ছবি হল ‘কোশিশ’, ‘পরিচয়’, ‘অভিমান’, ‘মেহবুবা’ এবং ‘বন্দিশ’। ১৯৭৭-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘চলে মুরারি হিরো বননে’ ছবিতে আসরানি ছিলেন মূল নায়কের ভূমিকায়।
কমেডিয়ান হিসেবে আসরানির বিভিন্ন ছবি মাইলফলক হয়ে আছে বলিউডে। ‘আজ কি তাজা খবর’, ‘রোটি’, ‘প্রেমনগর’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘ছোটি সি বাত’, ‘রফু চক্কর’, ‘শোলে’, ‘বালিকা বধূ’, ‘ফকিরা’, ‘অনুরোধ’, ‘দিল্লগি’, ‘হীরালাল পান্নালাল’, ‘পতি পত্নী অউর ওহ’ এবং ‘হামারে তুমহারে’।
‘খুন পসিনা’, ‘বিদাই’, নিকাহ’ ছবিতে নিজের চেনা ভাবমূর্তির বাইরে বেরিয়ে আসরানির অন্যরকম কাজ নজর কেড়েছিল দর্শকদের। আশির দশকে বলিউডে অ্যাকশন ছবির জোয়ারে চিত্রনাট্যে কমতে থাকে কমেডিয়ানের পরিসর।
এই সময়ে কাজ করা কমিয়ে দেন আসরানিও। আশির দশকে তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম ‘হমারি বহু অলকা’, ‘কামচোর’, ‘লভ ৮৬’, ‘অগর তুম না হোতে’, ‘আশা জ্যোতি’ এবং ‘বিবি হো তো অ্যায়সি’। কেরিয়ারের সেরা সময়ে আসরানি-কাদের খান-শক্তি কপূর জুটিও ছিল বহু ছবির সাফল্যের নেপথ্য কারিগর।
হিন্দি ছবিতে কাজ করা কমিয়ে দিলেও আশির দশকে গুজরাতি ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করেছিলেন আসরানি। নব্বইয়ের দশকে আসরানি আবার নতুন রূপে ফিরে আসেন বলিউডে।
অভিনয়ের নতুন ইনিংসে নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু ছবিতে আসরানির অভিনয় জনপ্রিয় হয়। ‘তকদিরওয়ালা’, ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’, ‘ঘরওয়ালি বাহারওয়ালি’, ‘হিরো হিন্দুস্তানি’ ছবিতে নস্টালজিয়া ফিরিয়ে আনে আসরানির অভিনয়।
নতুন প্রজন্মের পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গেও দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন আসরানি। ‘হেরা ফেরি’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘হালচাল’, ‘গরম মশালা’, ‘ভাগমভাগ’, ‘বোল বচ্চন’ এবং ‘কিঁউ কি’ ছবিতে তিনি অভিনয়ে পাল্লা দিয়েছেন নবীন কুশীলবদের সঙ্গে।
আসরানি অভিনীত শেষ ছবি ‘ইয়ামলা পাগলা দিওয়ানা: ফির সে’ মুক্তি পেয়েছে ২০১৮ সালে। ছবির পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন ওয়েব সিরিজ এবং বিজ্ঞাপনেও।
পারিবারিক ব্যবসায় যোগ না দিলেও আসরানি নিজে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। প্রথমে তিনি গুজরাতি ছবির প্রযোজনা সংস্থা শুরু করেছিলেন। তার পর অন্যান্য ব্যবসাতেও পা রেখেছিলেন। কিন্তু প্রথম ব্যবসায় সফল হলেও দ্বিতীয় ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হন আসরানি।
‘আজ কি তাজা খবর’, ‘নমক হারাম’ ছবিতে অভিনয় সূত্রে অভিনেত্রী মঞ্জু বনশলের সঙ্গে আলাপ হয় আসরানির। আলাপ থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে পরিণয়, ১৯৭৩ সালে।
বিয়ের পরে আসরানি-মঞ্জু একসঙ্গে অভিনয় করেন ‘তপস্যা’, ‘চাঁদি সোনা’, ‘সরকারি মেহমান’, ‘চোর সিপাহি’-সহ বেশ কিছু ছবিতে।
বলিউডে দীর্ঘ কয়েক দশকের কেরিয়ার সত্ত্বেও আসরানির সঙ্গে কোনও নায়িকাকে জড়িয়ে সে ভাবে মুচমুচে গসিপ শোনা যায়নি। কাজের বাইরে তিনি পুরোপুরি ফ্যামিলিম্যান। ভালবাসেন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে। তাঁর একমাত্র ছেলে নবীন এখন আমদাবাদের প্রতিষ্ঠিত দন্ত চিকিৎসক।