মহারাষ্ট্রের অমরাবতীর সাধারণ পরিবার। সেখানে কারও কোনও দিন যোগাযোগ নেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে। অথচ সেই পরিবারেরই ছেলে আসিফের ইচ্ছে অভিনেতা হওয়ার! স্কুলের দিনগুলো থেকেই তাঁর স্বপ্ন, এক দিন অভিনেতা হবেন।
আসিফ বসরার জন্ম ১৯৬৭ সালের ২৭ জুলাই। অমরাবতীতে স্কুলজীবন কাটিয়ে চলে এলেন সাবেক বম্বে, আজকের মুম্বইয়ে। পড়াশোনার ইচ্ছেকে ছাপিয়ে গিয়েছিল অভিনেতা হওয়ার লক্ষ্য।
মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন আসিফ। তার পর মুম্বইয়ে একটা কাজও জুটিয়ে ফেলেন। বেতনের প্রায় পুরো টাকাই খরচ হয়ে যেত নাটক আর সিনেমার টিকিটে।
১৯৯১ সালে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম গোসের সংস্থার নাটক ‘বোসম্যান অ্যান্ড লেনা’ দেখেন আসিফ। এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান, এক সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে তিনি এই নাটকটা দেখতেন।
ক্রমে সেলিমের সঙ্গে আলাপ হয় অসিফের। মুম্বইয়ের থিয়েটার জগতে পা রাখেন আসিফ। পরবর্তীতে সেলিমের পরিচালনায় শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকে হোরেশিয়োর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।
চাকরির পাশাপাশি থিয়েটার দুনিয়াতেও নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। হিন্দি, ইংরেজি এবং উর্দু— ৩ ভাষার নাটকেই তিনি ছিলেন অন্যতম কুশীলব। ‘মহাত্মা ভার্সেস গাঁধী’ এবং ‘ম্যায়ঁ ভি সুপারস্টার’ নাটকে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয় দর্শক মহলে।
পুরো সময়টাই থিয়েটারকে দেবেন বলে ১৯৯৬ সালে চাকরি ছেড়ে দেন আসিফ। মঞ্চে অভিনয় করার পাশাপাশি তিনি পৃথ্বী থিয়েটারে তরুণদের প্রশিক্ষণও দিতেন। অথচ তাঁর নিজের কোনও প্রথাগত অভিনয়-প্রশিক্ষণ ছিল না। প্রশিক্ষণ ছাড়াই বহিরাগত হিসেবে এসে বলিউডে জায়গা করে নিয়েছিলেন প্রতিভার জোরে।
মঞ্চাভিনেতা আসিফকে ছোটপর্দায় প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৯৮ সালে। অভিনয় করেছিলেন ‘ওহ’ ছবিতে। তার ৫ বছর পরে প্রথম অভিনয় বড় পর্দায়। আসিফকে দেখা গিয়েছিল ‘রুলস: প্যায়ার কা সুপারহিট ফর্মুলা’-য়।
বলিউডের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও আত্মপ্রকাশ করেন আসিফ। অভিনয় করেন ব্রিটিশ-ফরাসি-জার্মান উদ্যোগে নির্মিত ছবি ‘কুইকস্যান্ড’-এ।
এর পর বলিউড এবং আন্তর্জাতিক মহলে একইসঙ্গে সমানতালে অভিনয় করে যান আসিফ। বলিউডে বাণিজ্যিক ছবির মূলস্রোত এবং সমান্তরাল ধারা, দুই দিকেই আসিফ হয়ে ওঠেন নির্ভরযোগ্য নাম।
‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘পরজানিয়া’, ‘ওয়ন্স আপন এ টাইম ইন মুম্বই’ ছবিতে বলিষ্ঠ অভিনয়ে আসিফ চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকদের মনে।
পাশাপাশি তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় দক্ষতা অন্যতম দর্শনীয় হয়ে উঠেছে ‘মিক্সড ডাবলস’, ‘জব উই মেট’, ‘লমহা’, ‘কাই পো চে’, ‘নক আউট’, ‘কৃষ থ্রি’, ‘এক ভিলেন’, ‘মঞ্জুনাথ’, ‘হিচকি’, ‘ফ্যানি খান’ এবং ‘স্যাটেলাইট শঙ্কর’-এর মতো ছবিতেও।
২০১৪ সালে ‘সাঁঝ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এটি ছিল হিমাচলি ভাষার ছবি। সম্প্রতি ‘পাতাল লোক’ এবং ‘হস্টেজেস’ ওয়েবসিরিজে তাঁর অভিনয় বাজিমাত করেছিল বিনোদন দুনিয়ায়।
গত ৬ বছর ধরে নাগরিক কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন আসিফ। হিমাচল প্রদেশের আপার ধর্মশালায় ম্যাকলিয়ডগঞ্জে একটি বাড়ি লিজ নিয়েছিলেন। বেশির ভাগ সময় থাকতেন সেখানেই।
১২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবারও তাঁকে প্রতিবেশীরা দেখেছেন পোষা কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে। এ দিনই কিছু সময় পরে জানা যায় অভিনেতার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে তাঁর ঘরে।
আসিফের এক ব্রিটিশ বান্ধবীও তাঁর সঙ্গে এই বাড়িতে থাকছিলেন। তিনিই প্রথম দেখতে পান আসিফকে ঝুলন্ত অবস্থায়। বান্ধবীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ।
আসিফের দেহ উদ্ধার করে চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিক ভাবে অবসাদজনিত কারণে আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করলেও ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ।
তদন্তকারী পুলিশ জানিয়েছে, পোষা কুকুরকে বেঁধে রাখার বেল্টের ফাঁসে আসিফের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। অভিনেতার বাড়িতে কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের তরফে।