বড় তারকার ছবি মুক্তি পাওয়া মানে অন্তত সপ্তাহ দুয়েকের জন্য হলের বাইরে নিশ্চিন্তে ঝুলবে হাউসফুল বোর্ড। পরিচালক যে-ই হন, পোস্টারে কোন স্টারের মুখ সেটাই প্রথম বিবেচ্য। বেশি দিন নয়, মোটে পাঁচ বছর আগে এটাই টলিউডের নিয়মিত ঘটনা ছিল। কমার্শিয়াল ছবির কোণঠাসা হওয়া এবং অন্য ধারার ছবির আধিপত্য পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। তারকার বদলে পরিচালক কে বা কনটেন্ট কী, সেটাই দর্শক আগে বিবেচনা করছেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন চলে আসছে, বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কি পরিচালকরাই এখন স্টার?
পালা বদলের গোড়ার কথা
দু’টি ঘটনা প্রায় একসঙ্গে ঘটে। মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির দর্শক ক্রমাগত কমতে থাকে। রিমেক ছবি স্রেফ নাকচ করে দেন দর্শক। আস্থা বাড়ে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এবং সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের ছবির উপরে। অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের ‘ইচ্ছে’, সৃজিতের ‘অটোগ্রাফ’-এর সাফল্য দর্শকের মনোভাব বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। গত দু’-তিন বছরে শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ধারাবাহিক সাফল্য বলে দিচ্ছে, দর্শক তাঁদের নামে আস্থা রাখছেন। যে কারণে তাঁদের ছবিতে কারা অভিনয় করছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিচালকদ্বয়ের নাম। যদিও শিবপ্রসাদের মতে, আসল স্টার হল কনটেন্ট। ভাল বিষয়ের জোগান দিচ্ছেন বলেই দর্শক হলে যাচ্ছেন। একই কথা বলছেন সৃজিতও, ‘‘ভাল কনটেন্ট দিতে পেরেছি বলেই দর্শক ভরসা করছেন।’’
আরবান ছবির জনপ্রিয় মুখ আবীর চট্টোপাধ্যায় যেমন এক কথায় পরিচালককেই স্টার বলে দিলেন। ‘‘আমরা কাকে স্টার বলব? অভিনেতারা যে সব সময়ে স্টার হবেন, এমন তো নয়। কৌশিকদা, সৃজিত, শিবুদা-নন্দিতাদির নামে দর্শক হলে যাচ্ছেন। মূলত যাঁরা দর্শককে হলে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরাই তো আসল স্টার,’’ বলছেন আবীর। এর পাশাপাশি অভিনেতা গুরুত্ব দিলেন কনটেন্টকেও, ‘‘এখন ট্রেলার-টিজ়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতে দর্শক ছবি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা করে নিচ্ছেন। ভাল লাগলে তার পর দেখছেন, কে বানিয়েছে বা কারা অভিনয় করেছে। সেখানে ভরসাযোগ্য নাম দেখলে তবে হলে যাচ্ছেন। তার পরে বাকিটা ওয়ার্ড অব মাউথ।’’ তিরিশ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রির সব রকম ওঠাপড়া দেখেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। পরিচালকই যে মূল কান্ডারি, সেটা স্বীকার করে নিয়ে বললেন, ‘‘এটা কিন্তু এখনকার ট্রেন্ড নয়। আমি একজন পরিচালকের কথা বলতে পারি, যাঁর নামে সিনেমা হলে পয়সা পড়ত। তিনি অঞ্জন চৌধুরী। অঞ্জনদার ছবিতে স্টারের নাম ম্যাটার করত না।’’
স্টার ভ্যালু কি সঙ্কটে?
পরিচালকের নামে দর্শকের হলে যাওয়া কি স্টারডমের সঙ্কটকেই তুলে ধরছে? প্রসেনজিতের কথায়, ‘‘এটা বলার মতো সময় হয়তো আসেনি। কিন্তু শুধু স্টারের মুখ দিয়ে ছবি চলবে না। কিছু দিন আগে আমির খান, অমিতাভ বচ্চনের ছবি এসেছিল। কাহিনি পছন্দ না হওয়ায় দর্শক এত বড় স্টারকাস্টও বাতিল করে দিয়েছেন!’’ প্রসেনজিতের কথার সূত্রেই বলা যায়, স্টার ভ্যালুর সঙ্কট বলিউড-টলিউড সর্বত্র। সলমন বা শাহরুখ খান যা-ই নিয়ে আসবেন, দর্শক হইহই করে দেখবেন, এমনটা আর হচ্ছে না। কনটেন্ট ভাল হতে হবে। আর যে সব পরিচালকে ভাল কনটেন্ট নিয়ে আসবেন, দর্শক তাঁদেরই মনে রাখবেন।
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত কিন্তু ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘দর্শকের চাহিদা না থাকলে এত বছর ধরে আমরা স্টারডম ধরে রাখতে পারতাম না। নামী পরিচালকও জানেন, কোন ছবিতে স্টার পাওয়ার দরকার। কোথায় নয়। যে কারণে শিবু-নন্দিতা ‘প্রাক্তন’-এ এবং কৌশিকদা ‘দৃষ্টিকোণ’-এ আমার আর প্রসেনজিতের জুটির ম্যাজিককে কাজে লাগিয়েছেন।’’
নতুনেও আস্থা
এ বছরের অন্যতম হিট ‘মুখার্জিদার বউ’। পৃথা চক্রবর্তী তাঁর প্রথম ছবিতে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন শুধু কনটেন্টের জোরে। কিন্তু এক নতুন পরিচালকের ছবি কি দর্শক এমনিই দেখতে যেতেন, যদি না পিছনে শিবপ্রসাদ-নন্দিতার নাম থাকত? প্রশ্নটা তুললেন প্রসেনজিৎ। টলিউডের নতুন পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় এ পর্যন্ত দু’টি ছবি করেছেন, দু’টি-ই হিট। প্রথম ছবির সাফল্য দ্বিতীয়তে দ্বিগুণ হয়েছে। দর্শকের আস্থা ছাড়া এটা হয় না।
কমার্শিয়াল হিরোরা কোণঠাসা?
টলিউডে বাণিজ্যিক বিনোদনমূলক ছবিই যেহেতু কোণঠাসা, স্বাভাবিক ভাবে সে ছবির অভিনেতারাও সাফল্যের মুখ দেখছেন না। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত জিৎ-কোয়েলের ‘শেষ থেকে শুরু’ এবং দেবের ‘কিডন্যাপ’ বক্স অফিসে সফল নয়। মেগাস্টারদের ছবি যেখানে ব্যবসা করতে পারছে না, সেখানে অন্যদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। অধিকাংশ বাণিজ্যিক ছবিই তৈরি হচ্ছে টেলিভিশনের কথা মাথায় রেখে। কমার্শিয়াল ছবির সফল পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রি অনেক ব্লকবাস্টার পেয়েছে। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ থেকে ‘বোঝে না সে বোঝে না’। রাজও নিজের ছবির ঘরানা বদলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে কনটেন্টই স্টার। গল্প ভাল না হলে কিচ্ছু হবে না। অন্য ধরনের গল্প যাঁরা বলবেন, দর্শক তাঁদের ছবি দেখতেই হলে আসবেন।’’ সুতরাং বাণিজ্যিক ছবির হিরোদের নিজের ক্যারিশমার পাশাপাশি গল্প বাছাইয়েও যে নজর দিতে হবে, সেটাই এখন সারসত্য।