অপরাজিতা ঘোষ।
টানা আঠেরো বছর অভিনয়ে। সাময়িক দাঁড়ি টেনেছিল করোনা। এ বার আবার ফ্লোরে ফিরছেন অপরাজিতা ঘোষ। কাজ থেকে প্রেম, প্রেমের গুজব, অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীর সঙ্গে সংসার— সব নিয়েই অকপট আনন্দবাজার অনলাইনে।
প্রশ্ন: ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দা, আপনাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন বহু দিন?
অপরাজিতা: করোনার জন্যই। আমার ছেলেটা বড্ড ছোট। ওর জন্যই গত দু’বছর একটাও কাজ করিনি। ছবি, ধারাবাহিক, ওটিটি সিরিজ— সবের প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিয়েছি। বাধ্য হয়েই বটে, তবে আফশোসও নেই। কারণ গত দু’বছর কোভিড যে জায়গায় ছিল, তা থেকে বাঁচাতেই হত নিজেদের।
প্রশ্ন: কিন্তু, আপনার স্বামী, ঋত্বিক চক্রবর্তী, তাঁকে তো পর্দায় দেখা গিয়েছে?
অপরাজিতা: সেগুলো হয় কোভিডের আগে করা, কিংবা কাজ বন্ধ রেখে পরে শেষ করা। ও-ও দেড় বছর বাড়িতেই ছিল। দ্বিতীয় ঢেউয়ের শেষের দিকে কাজে ফিরে ওরই করোনা হল। আবার বেশ কিছু দিন কাজ বন্ধ। ‘গোরা’র কাজ চলাকালীন আলাদা বাড়িতে থাকছিল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে এ ভাবে ঋত্বিক অন্য জায়গায় থাকাতে বড্ড মুশকিল হচ্ছিল তিন জনেরই। এখন তাই বাড়ি থেকেই কাজ করছে, তবে নিজেকে একদম একটা ঘরে বন্দি রেখে আর বাকি সময়টা মাস্ক পরে।
প্রশ্ন: আপনি কাজে ফিরবেন না? তখন কী হবে?
অপরাজিতা: ফিরছি তো। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই। ১৮০ ডিগ্রি-র প্রযোজনায় একটা সিরিজ আর মোজো প্রোডাকশন্সের প্রযোজনায় মণীশ বসুর ছবি ‘গু কাকু’-তে কাজ করব। আমি ফ্লোরে থাকলে ঋত্বিক ছেলের সঙ্গে বাড়িতে থাকবে। ছবিতে অবশ্য দু’জনের একসঙ্গে কাজ। তখন ছেলেকে মা-বাবার কাছে রেখে আসব। পুরো শ্যুটিং শেষ হলে তবে ও বাড়ি ফিরবে।
সপরিবার অপরাজিতা।
প্রশ্ন: ‘১৮০ ডিগ্রি’ মানে তো সংস্থার অন্যতম প্রযোজক ঋত্বিক। একেবারে ঘরের ছবিতে ঘরের লোকের সঙ্গে কাজ করছেন?
অপরাজিতা: (হা হা হাসি) আমরা দু’জনেই কাজ আর সংসারটা একেবারে আলাদা রাখি। সংস্থায় ঋত্বিক আছে বটে, তবে আমি তার বিশেষ কিছু জানি না। সিরিজে অভিনয় করতে আমায় ডেকেছে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, ঋত্বিকের সহ-প্রযোজক। আর চিত্রনাট্য শোনা বা কাজটা বোঝা, সবটাই পরিচালকদের থেকে। আমি যে ওই সিরিজটায় থাকছি, সে তো ঋত্বিককে আমিই বললাম শেষমেশ! ও জানতই না!
প্রশ্ন: বরের প্রযোজনায় ছবি, আপনি অভিনয় করছেন। এ রকম হলে তো লোকে ছড়ি ঘোরায় শুনেছি! আপনি?
অপরাজিতা: হা হা, এক্কেবারে উল্টোটা। যার ছবিই হোক, এটা তো আমার পেশা। অভিনয় করতে যাচ্ছি, অভিনয় করব, ফিরে আসব। তখন আমি পরিচালকের লোক। তবে হ্যাঁ, চেনা মানুষদের সঙ্গে কাজ করার তো একটা আরাম আছে, মজাও আছে। সেটা নিশ্চয়ই থাকবে।
প্রশ্ন: পর্দায় ঋত্বিকের প্রেমিকা বা স্ত্রীর চরিত্রে কাজ করাটাও কি বেশি আরামের?
অপরাজিতা: শ্যুটিং যখন করি, তখন আমি শুধুই অভিনেত্রী। শুধু ঋত্বিক কেন, যে কোনও অভিনেতার প্রেমিকা বা স্ত্রীর চরিত্রেই একই ভাবে কাজ করতে পারি। তবে ঋত্বিক ভীষণ ভাল অভিনেতা, ওর সঙ্গে কাজ করতে দারুণ লাগে। আবার ঋত্বিকের সঙ্গেই কাজ করছি, তবে ওর বিপরীতে নয়, এমনকি প্রেমের সুযোগও নেই— এমনও হয়েছে কত বার!
প্রশ্ন: আপনার খুব অপছন্দের কেউ যদি ঋত্বিকের নায়িকা হন, আর আপনিও সেই ছবিতে থাকেন? হিংসে হবে না?
অপরাজিতা: (হা হা হাসি) একদম হবে না। আমি যাব, অভিনয় করব, বাড়ি ফিরে আসব। ঋত্বিকও তাই। আমি নিশ্চিত, তৃতীয় জনও তা-ই করবেন!
প্রশ্ন: ২০০৪-এ প্রথম ছবি ‘ইতি শ্রীকান্ত’। মানে ইন্ডাস্ট্রিতে আঠেরো বছর। তা-ও ছবি বা ধারাবাহিকের সংখ্যা অনেকের থেকে কমই বলা যায়। এটা কেন?
অপরাজিতা: এই, আমি না একদম প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী নই। কে কী কাজ করছে-র চেয়ে নিজে কী করছি, সেটাই আমার একমাত্র মাথা ঘামানোর জায়গা। যাতে কাজ করি, মন দিয়ে করি। ধারাবাহিকে কাজ করার সময়ে যেমন ছবি কম করার চেষ্টা করি। এক একটা মেগা শেষ হলে অন্তত দেড় দু’বছর আর ধারাবাহিক করি না। মাঝের সময়টা পুরোপুরি দিই সিনেমা, টেলিফিল্ম বা এখনকার সিরিজে। আর যখন কাজ থাকে না, আমি তখন নিখাদ বাড়িতে সময় কাটানো বা পাহাড়ি ছুটিতে যাওয়া মানুষ। জীবনটা তো শুধুই শ্যুটিং নয়!
প্রশ্ন: আপনাকে তো নেটমাধ্যমেও দেখা যায় না। সেটাও কি ইচ্ছাকৃত?
অপরাজিতা: একেবারেই। ওই যে বললাম, প্রচার আর প্রতিযোগিতা থেকে আমি দূরে থাকতেই পছন্দ করি। ইদানীং ইনস্টাগ্রামে একটা প্রোফাইল খুলেছি। তবে সেটা অভিনেত্রীর প্রোফাইল নয়। এক জন পাহাড় ভালবাসা, ছবি তুলতে ভালবাসা মেয়ের প্রোফাইল। ছবিগুলোও ঠিক সে রকমই। আমার অভিনয়ে আসাটাও তো হুট করেই!
প্রশ্ন: তাই নাকি? কী রকম?
অপরাজিতা: আমি তো চাকরি করতাম। হঠাৎই ইটিভির একটা সিরিজে একটা ছোট্ট চরিত্রে আমায় নেওয়া হয়েছিল। তার পরে এল ‘ইতি শ্রীকান্ত’ আর একটা পাঁচ দিনের গল্প, অতনু ঘোষের। আউটডোরে মা সঙ্গে যেত অফিস কামাই করে! হয় নাকি! ক’দিন পরে এক ধারাবাহিকের জন্য ডাক। অফিস সেরে আমি পরিচালক-চিত্রনাট্যকারদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। তেল চুপচুপে চুল, মেক আপের বালাই নেই, জিন্স-কুর্তি। প্রথম দেখায় পরিচালক অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাভাবিক ভাবেই আমায় নাকচ করে দিয়েছিলেন! তার পরে এক দিন আমায় পর্দায় দেখলেন মেকআপে। উনিই কিন্তু ‘একদিন প্রতিদিন’-এ মোহর করলেন আমায়! তবে অভিনয়টাই যে পেশা হয়ে যাচ্ছে, সেটা কিন্তু চার-পাঁচ মাস পরেও মাথায় ঢুকছিল না। মনে হত, এই তো, এই কাজটার পরেই আবার চাকরি খুঁজতে হবে! পরে কখন যেন এটাই ভাল লেগে গেল!
অপরাজিতা এবং ঋষি।
প্রশ্ন: এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে, আপনাকে নিয়ে তো তুমুল গুজব আর চর্চাও ছিল এক সময়ে?
অপরাজিতা: হ্যাঁ, বাপরে! ঋষি কৌশিক! যেহেতু ‘এখানে আকাশ নীল’-এর উজান আর হিয়াকে সবার ভাল লাগত, লোকে ধরেই নিয়েছিল আমরা বাস্তবেও জমিয়ে প্রেম, এমনকি বিয়েও করে ফেলেছি। আমি আর ঋষি হেসে গড়াগড়ি যেতাম! শুধু তা-ই নয়। এক সময়ে এটাও রটেছিল, আমাদের দুটো মেয়েও আছে, তারা দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুলের পড়ুয়া!
প্রশ্ন: সে কী! এত দূর কী ভাবে রটল?
অপরাজিতা: আমি আর ঋষিই অনেক গবেষণা করে এর কারণটা আন্দাজ করেছি। আসলে ওই স্কুলে কিছু দিন শ্যুটিং হয়েছিল আমাদের। তখন নিয়মিত তার সামনের চত্বরটায় আমাদের দু’জনকে দেখা যেত। ক্যামেরা-ইউনিট অত খেয়াল না করলেও লোকে আমাদের খেয়াল করত। বাকিটা দাঁড়াল ও রকম সাংঘাতিক একটা গল্প!
প্রশ্ন: আর এখন আপনাদের সম্পর্কটা কেমন?
অপরাজিতা: একই পেশায় দীর্ঘ দিনের পরিচিতি হলে যেমনটা হওয়ার কথা। আমরা বন্ধু। আমাদের এক বার ঝগড়া, এক বার ভাব— এই ব্যাপারটা চলতেই থাকে। আপাতত যেমন সব ঠিক আছে, দিব্যি বন্ধুত্ব। ওর স্ত্রী দেবযানীর সঙ্গেও ভালই কথাবার্তা হয়।
প্রশ্ন: আর ঋত্বিকের সঙ্গে প্রেম কিংবা বিয়ে, সে সব ঘটল কী করে?
অপরাজিতা: আসলে আমরা বহু বছরের বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব থেকে কখন একে অপরের অভ্যাস হয়ে গিয়েছি, কখন প্রেম এসেছে, সেটা বলা মুশকিল। সিনেমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজেনি। তবে ভালবাসাটা বুঝতে অসুবিধেও হয়নি। তার পরে ২০১১-য় বিয়ে করে এখন চুটিয়ে সংসার। তবু আগের মতো বন্ধুই কিন্তু!