ত্রয়ী: অ্যামাজনে জলপ্রপাতের সামনে ‘শঙ্কর’। সঙ্গী স্বেতলানা ও ডেভিড জেমস
গা ছমছমে...
রাত এগারোটা থেকে শুরু ফোন করা। তার মধ্যে একবারই তাঁর ব্রাজিলের নম্বর লাগল, ‘‘আমি জঙ্গলে। আর তিন ঘণ্টা পর ফোন করুন প্লিজ।’’
কাট। অপেক্ষা। ভারতীয় সময় ভোর পাঁচটায় ধরা গেল ‘শঙ্কর’কে। শ্যুটিং সেরে মানাউস শহরে পৌঁছে এই প্রথম সাক্ষাৎকার দিলেন ‘শঙ্করের অ্যামাজন অভিযান’ নিয়ে...
কোনও দিন ভাবিনি আপনার সাক্ষাৎকার ভোর পাঁচটায় নেব!
কী করব বলুন? এত গভীর জঙ্গলে সারাদিন শ্যুট করছি। কোনও নেটওয়ার্ক নেই। জাস্ট শ্যুটিংটা শেষ হয়েছে। এখন চার-পাঁচদিন রিও-তে ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরব। এত টেনশনে শ্যুটিং করেছি যে, এ বার একটু একটু কলকাতাকে মিস করছি। মিস করছি বাড়ির খাবারও।
কেমন আছে ‘শঙ্কর’?
(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) ‘শঙ্কর’ বেঁচে আছে। ব্যস। কী করে এত দিন বেঁচে ছিল তা এখানে আমরা যারা ছিলাম তারাই জানি। এত শক্ত আউটডোর মনে হয় না বাংলা ছবিতে আগে হয়েছে।
একটু ডিটেলে বলবেন?
অ্যামাজন মানে শুধুই ভাইরাস আর অসুখ। ইয়েলো ফিভার, সঙ্গে জিকা ভাইরাসের ভয়। আমি সাও পাওলোতে ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গেই এয়ারপোর্টে কয়েকজন বাঙালি ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওরা সফটওয়্যারের কাজ করে। ওরা বলে, ‘দেব, অ্যামাজনটা সাবধানে।’ এক মাস ধরে বুঝতে পারছি কী সাঙ্ঘাতিক জায়গা অ্যামাজন...
অ্যানাকোন্ডা গলায় পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
কী রকম?
সন্ধেবেলাটা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না! ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আর পোকা সূর্য ডোবার পরেই ঘরে ঢুকে পড়ে। আমাদের প্রায় সবার পা চুলকোতে চুলকোতে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে। হাতে-পায়ে ভর্তি ফোঁড়া। রাতে পোকার ভয়ে বাথরুমে যেতেও ভয় লাগছে। দাঁত মাজবেন কী শোয়ার আগে, টুথব্রাশের ওপর ভর্তি পোকা।
কী বলছেন?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। বাথরুমের টাওয়েলে অন্তত কুড়ি-তিরিশটা মাকড়সা। বাথরুমে যেহেতু আলো জ্বালিয়ে রাখতেই হবে, তাই সব পোকা ওখানে। তাও বলছি, অ্যামাজন ইজ হেভেন। এত ন্যাচারাল বিউটি যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, জঙ্গল যে এত সুন্দর হতে পারে, সেটা এখানে না এলে জানতামই না।
এই শ্যুটিংটা কি সাউথ আফ্রিকার জঙ্গলের চেয়েও বেশি ভয়াবহ?
হান্ড্রেড টাইমস বেশি ডেঞ্জারাস। সাউথ আফ্রিকাতে সব কিছু অর্গানাইজড ছিল। এখানে সবটাই জঙ্গলে। শ্যুটিং শুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যে যা কাণ্ড হয়েছিল, আমার মনে হয়েছিল আর শ্যুটিং হবে না...
কী হয়েছিল?
সে দিন আমরা অসম্ভব ঘন জঙ্গলে শ্যুট করছি। এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো প্রায় নেই। আমি একটা শট দিয়ে চেয়ারে বসে আছি। কমলদা (মুখোপাধ্যায়) মনিটরটা দেখছে। এমন সময় ওই ঘন জঙ্গলে শুনছি গাছ ভাঙার মড়ম়ড় শব্দ। এতটাই জোরে সে শব্দ যে, আমার বলতে গিয়েও ভয় করছে। ওপরের দিকে তাকাতে যাব, এর মধ্যেই দেখলাম একটা বিশাল বড় গাছের ডাল আমাদের এক ক্রু মেম্বারের গায়ে এসে পড়ল। আমি ইচ্ছে করেই তার নাম বলছি না। না হলে ওর বাড়ির লোক টেনশন করবে।
যে ভাবে গাছের ডালটা পড়েছিল, আমরা ভেবেছিলাম ওই টেকনিশিয়ান বোধহয় আর বাঁচবে না। সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার ‘আউট অব ডেঞ্জার’ বলার পরও আমাদের ঘোর কাটছিল না। তারপর থেকে যত বার জঙ্গলে ঢুকছি, মড়মড় শব্দ শুনলে আমার বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত।
শুনলাম একদিন আপনাদের ডিঙি উল্টে গিয়েছিল?
অন্তত দশ-বারো বার উল্টেছে। একদম অ্যামাজন নদীতে! যেখানে ব্ল্যাক কেম্যান কুমিরে ভর্তি সেখানে। পরে আমাদের শ্যুটিং কো-অর্ডিনেটর বলেছিল জলে পড়লে বহুবার কুমির টেনে নিয়ে গিয়েছে ট্যুরিস্টদের। যত বার আমি জলে পড়েছি ওরা নাকি ‘প্রে’ করেছে। কুমির ছাড়াও জলের নীচটা গাছপালা ভর্তি। সেগুলো আমার পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। তার সঙ্গে দেখি মাকড়সা কামড়াচ্ছে। কী ভাবে যে বার বার কপাল আমার সঙ্গ দিয়েছে, আমিই জানি।
আর খাওয়াদাওয়া?
(হা হা হা হা হা)
হাসছেন?
আমরা শ্যুটিংটা এমন করে করেছি যাতে আমাদের শহর ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর থাকতে হয়েছে চার-পাঁচ দিন করে। এই করতে গিয়ে রেগুলার যাই খেয়েছি তার অধিকাংশ পচা।
গরমে চিকেন আর মাছ পচে গেছে। খাবার থেকে ফ্যানা বেরোচ্ছে। সেই পচা জায়গাটা ফেলে দিয়ে বাকি খাবারটা খেয়েছি সবাই। এ ছাড়া যোগ করুন ফোনে নেটওয়ার্ক
না থাকা। আপনার মনে
হবে আপনি এই পৃথিবীতে নেই। আমরা আমাদের এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার অভিষেকের পায়ে পড়তাম, আমাদের ওয়াইফাই জোনে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ওখানে আপনার টিপিক্যাল ডে ক’টায় শুরু হত?
ঘুম থেকে উঠতাম সাড়ে চারটেয়। এক কাপ চা খেয়ে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে যাওয়া। বেশির ভাগ দিনই জলে শ্যুটিং ছিল। সেখানে অন্যরকম মজা। ওখানে জোয়ার এলে জলের লেভেল এতটাই বেড়ে যায়, যে তিরিশ ফুটের গাছও যায় ডুবে। তাই কালকে বিকেলে যেখানে শ্যুটিং করেছি সেই লোকেশনটা সকালে এলে আপনি দেখতে পাবেন না। ওর মধ্যেই তখন চলছে নতুন লোকেশন খোঁজা। এতটা সময় জাহাজ আর স্টিমারে কাটিয়েছি যে আমাদের সকলের মোশন সিকনেস হয়ে গেছে। এই আপনার সঙ্গে হোটেলের ঘরে বসে কথা বলছি, তাতেও আমার মাথা ঘুরছে সমানে।
শুনলাম জাগুয়ার, প্যান্থারের সঙ্গেও শ্যুটিং হয়েছে?
জাগুয়ার, প্যান্থার, ব্ল্যাক কেম্যান—কেউ বাদ নেই। সঙ্গে পিরানহা, ট্যারেন্টুলা। অসম্ভব ডেঞ্জারাস সব ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল। এখানে অনেকটা শ্যুটিং করেছি এই
জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গে। বাকিটা গ্রাফিক্সে হবে।
অ্যানাকোন্ডা?
এখানে অ্যানাকোন্ডা দেখেছি আমরা। সে এক আলাদা অভিজ্ঞতা। রাতের অ্যামাজন দেখতে বেরিয়েছি, হঠাৎ দেখি আমাদের ডিঙির পাশ দিয়ে বিরাট একটা সবুজ রঙের সাপ চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গাইড ডিঙিটা থামিয়ে দিল আর বন্দুক হাতে নিল। ইট ইজ আ লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স। অ্যানাকোন্ডার সঙ্গে শ্যুটিংও করেছি। কলকাতায় ফিরলে কিছু কাজ এ বার গ্রাফিক্সে হবে।
মরতে মরতে ক’বার বেঁচেছেন?
দু’বার। একটু এদিক ওদিক হলেই আমার বডি ফিরত কলকাতায়।
কী হয়েছিল প্লিজ বলবেন?
একটা বিরাট পাহাড়ের মাথায় চ়ড়েছিলাম। ফুল রকি মাউন্টেন। নীচে তিনশো ফুট খাদ। তার ধারে দাঁড়াতে গিয়ে পা স্লিপ করেছিল। কোনও ক্রমে একটা গাছের সরু ডাল ধরে ফেলতে পেরেছিলাম বলে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ওই ডালটা যদি শক্ত না হত সোজা তিনশো ফুট নীচে!
আর দ্বিতীয়টা?
শট দিয়ে বেস ক্যাম্পে ফিরছি। পায়ে জুতো। হঠাৎ জুতো ভেদ করে পুরো চেটো এফোঁড় ওফোঁড় করে একটা ধারালো কাঠের টুকরো জুতোর নীচ থেকে ঢুকে আঙুলের ওপর থেকে বেরোল।
সঙ্গে সঙ্গে হসপিটাল। ভাগ্যিস
কোনও নার্ভ পাংচার হয়নি। প্রচুর পেন কিলার, প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক, এক্সট্রা ব্যান্ডেজ, ডবল মোজা পরে শ্যুটিং শেষ করেছি। মোদ্দা কথা বেঁচে আছি, আনন্দplus-এর সঙ্গে কথা বলছি, ব্যস। (হাসি)
আগের বারের ‘চাঁদের পাহাড়’ শ্যুটিং-এর পর বলেছিলেন ওটা আপনার জীবনের একটা লাইফ চেঞ্জিং ঘটনা। এটাও কি তাই?
হান্ড্রেড পার্সেন্ট। এটা আরও বেশি করে। এ রকম অভিজ্ঞতা, এমন জঙ্গল, এমন জন্তু-জানোয়ার আমি কোনও দিন দেখিনি। সাউথ আফ্রিকা সম্পর্কে আমাদের একটা জ্ঞান ছিল। ব্রাজিলের অ্যামাজন ছিল একদম আননোন। এখানে আমার সঙ্গে যে গার্ড ছিল সে আমাকে প্রথম দিনই বলে দিয়েছিল কোনও ঝামেলা হলে, সে নিজের জীবন আগে বাঁচাবে, তারপর আমার। এ রকম কথা শ্যুটিং-য়ের প্রথম দিন শোনার পর মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, ভাবুন! সে রকম মানসিক অবস্থায় মরতে মরতে শ্যুটিং করাটা লাইফ চেঞ্জিং এক্সপিরিয়েন্স নয়তো কী বলুন!
এ বার একটা অন্য প্রশ্ন...
বলুন বলুন। কত দিন পর কলকাতার কারও সঙ্গে কথা বলছি। কী ভাল লাগছে।
আচ্ছা, এত দিন ব্রাজিলে থাকলেন, ইউনিটের মধ্যে ফুটবল খেলেছেন নাকি আপনারা?
কোথায়? এমন শ্যুটিং শিডিউল যে কিছু খেলা হয়নি জানেন...
যাহ্, খেললেন না?
সত্যি খেলিনি। মিস হল এটা। এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছি জানেন। সাউথ সিটি-র ফ্ল্যাটে ফেরার পরেই বুঝতে পারব কী সাঙ্ঘাতিক একটা শ্যুটিং সেরে ফিরলাম।
গণেশবন্দনা: ‘শেষ সংবাদ’ ছবির ট্রেলর লঞ্চে শ্রাবন্তী
ছবি: কৌশিক সরকার