ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
কবিপক্ষ কী ভাবে উদযাপন করেন?
একটা বা দু’টো অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে।
এ বার কোন কোন অনুষ্ঠান করছেন?
নিউ জার্সিতে ভারত সেবাশ্রমের রবীন্দ্রজন্মোত্সব অনুষ্ঠানে একক ভাবে গান গেয়েছি। তার সঙ্গে আরও কিছু অনুষ্ঠান আর ওয়ার্কশপও করব।
কলকাতা এ বার বাদ পড়ল কেন?
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন আমার কাছে নিশ্চয়ই একটা শ্রদ্ধার দিন। কিন্তু দিনটাকে ঘিরে যেমন পাগলামি হয়, তার সঙ্গে আর থাকতে চাইছিলাম না।
সে কী!
একদিনে তিরিশটা অনুষ্ঠান। শিল্পীরা কেউ কারও গান শোনেন না। সকলেরই সাতাশ নম্বর অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাওয়ার তাড়া। এই তাড়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করার চেয়ে কোনও একটি অনুষ্ঠানে অনেক গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আমার বেশি ভাল লাগে।
আন্দুল থেকে আমেরিকা, মিনিস্ট্রি অফ কালচার থেকে হর্ষ নেওটিয়া এ রকম একটা দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন বলেই তো হুট করে আমেরিকায় চলে যেতে পারেন?
এ কী! আমার নেটওয়ার্ক? এটা একদম ভুল কথা।
আপনার মত পি.আর ক’জন করতে পারে?
আজীবন শুনে আসছি আমার পি.আর খুব খারাপ। অনেক সময় মুড ভাল না থাকলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলি না। আমার পি.আর ভাল আজ অবধি কেউ বলেনি। হর্ষ নেওটিয়া, সঞ্জীব গোয়েঙ্কা এঁরা সকলেই আমার বন্ধু। কিন্তু সেটা কি আমার দোষ? আর আমার প্রচুর ছাত্রছাত্রী বিদেশে থাকে। সেই কারণেই বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ভাল। সত্যি পি.আর ভাল হলে বঙ্গ সম্মেলনের মতো অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র একবার পারফর্ম করতাম না। এখানকার বহু শিল্পী নিয়মিতই বঙ্গ সম্মেলনে যান।
আপনাকে যদি কলকাতায় কবিপক্ষের অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হত, আপনি কী করতেন?
আমি একেক বছর একেকটা অঞ্চলে একটা করে অনুষ্ঠান করাতাম। জোড়াসাঁকো তো জন্মস্থান। সেখানে তো হবেই। কিন্তু তা ছাড়াও একটাই অনুষ্ঠান করতাম। একবার মধ্য কলকাতায়, আর একবার উত্তরে বাছাই করা শিল্পীরা গান গাইতেন। সকলে নয়। তাতে অনুষ্ঠানের মানও অনেক উঁচু হত। আর লোকের আগ্রহ থাকত। এখন তো সবাই চা খায় আর গল্প করে। গান কেউ শোনে না।
তা হলে কবিপক্ষের এই হুজুগ কি রবীন্দ্রনাথের গানের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে?
নাহ্, তা বলিনি। এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাঁদের গান শুধু কবিপক্ষেই শুনতে পাই। ভালও লাগে তাঁদের গান।
যেমন? নাম বলুন না
পূর্বা দাম। কী অসম্ভব শ্রদ্ধা নিয়ে গান করেন। প্রকৃতিগত কারণেই তাঁর গলা আগের মতো চড়ে না। অথচ গানটাকে এমন করে পরিবেশন করেন যে তা মর্মে ঘা দিয়ে যায়।
একটা সত্যি কথা বলুন তো, আজকের প্রজন্ম পূর্বা দামের গান শুনতে চাইবে?
সবাই যে শুনতে চাইবে এমনটাও নয়। তবে আমার ভাল ছাত্রছাত্রীরা অবশ্যই চাইবে।
সেটা কেন?
এটা তো মানতেই হবে আগের কোনও জিনিসই টানা ভাল লাগে না। গানের ক্ষেত্রেও পরিবেশনের ধারাটা বদলে যায়। পঙ্কজ মল্লিক বা কে.এল সায়গলের গান আমাদের প্রজন্ম পছন্দ করে। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের তা পছন্দ হবে না। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা রিদমের গানের সাঙ্ঘাতিক ভক্ত।
রবীন্দ্রনাথের গলার গান, একেবারে প্রথম দিকের কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্রর গান শুনে অনেকেই মনে করেন রবীন্দ্রসঙ্গীতটা নাকিসুরে গাওয়ার গান। আপনার কী মনে হয়?
আমার এটা বলতে একটুও দ্বিধা নেই যে রবীন্দ্রনাথের নিজের গাওয়া গান আজকের প্রজন্ম মোটেই পছন্দ করে না। কিন্তু সেটাই তো অথেন্টিক। এমনকী প্রথম দিকের কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুচিত্রা মিত্রর যে গায়কি, সেটাও আজ বেমানান। পরবর্তী কালে তাঁরাও তো সেই গায়কি থেকে অনেকখানি সরে এসেছিলেন। উচ্চারণে বদল এসেছে, আসবেই।
এখন তো কথা ছুড়ে ছুড়ে, গানটা আড়ে ধরার, গানের শেষ অংশটা অ্যাবরাপ্টলি শেষ করার একটা ট্রেন্ড এসেছে। বলা হচ্ছে এটাই কমার্শিয়াল গান। এটাই কি তবে বদল?
কমার্শিয়াল গান বলে কিছু হয় না। বেশির ভাগই তো আজকাল সুর আর স্বরলিপি পড়ে গান গায়। রবীন্দ্রনাথ না পড়েই ‘বড় আশা করে এসেছি গো’ গানের সঙ্গে আজও ঝ্যাঙ ঝ্যাঙ করে লোকে ম্যারাকাস বাজায়, আর শ্রোতারা আহা! করতে থাকে। আমার তাদের কাছে প্রশ্ন ওই গানের কথায় আছে ‘দীনহীনে কেহ চাহে না’র মতো বাণী, তার সঙ্গে এই যন্ত্রানুষঙ্গ কি যায়?
কিন্তু লোকে ওই গান ওই ভাবেই তো শুনতে চায়?
চাইলে ওই ভাবেই গান চলুক। তবে আমার দীর্ঘ দিনের শিক্ষা যা বলে আমি তাই করব। চেষ্টা করব আমার গান যাতে লোকে পছন্দ করে।
ইদানীং আপনার অনুষ্ঠানে এবং অন্য অনুষ্ঠানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার ছবি, আপনার বন্ধু সুগত বসুর ভোটে জেতার ঘটনা থেকে মনে হচ্ছে আপনিও রাজনীতিতে অন্যান্য শিল্পীদের মতো নাম লেখাবেন...
এটা একদম ভুল। আমি আদপে একজন শিল্পী। সেই কারণেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর ডাকেও আমি যেমন অনুষ্ঠান করেছি, ঠিক তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাকলেও অনুষ্ঠান করব।
মানে আগের মতোই সুগত বসুর সঙ্গে আপনি অনুষ্ঠান করবেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। অনেকে তো আমায় সরাসরি বলছেও যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে নিজের সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি চেয়ে নিতে। কিন্তু কিছু পাওয়ার জন্য সঙ্গীত শিল্পীদের রাজনীতিতে আসার নীতি সমর্থন করি না। অগুনতি অনুষ্ঠান আর সিডি প্রকাশের জন্য গান গাইতেও আসিনি।
আজকের দুনিয়ায় একজন শিল্পীকে কী ভাবে রেট করা হয়?
এখন মিডিয়া ঠিক করে দেয় কে ভাল শিল্পী। মজার কথা ক্রমাগত টিভির পর্দায়, কাগজে তার নাম দেখতে দেখতে আমরাও বিশ্বাস করি যার মুখ যত বেশি দেখব সেই সব চেয়ে ভাল শিল্পী। গান শোনার চেয়ে মুখ দেখানোটা এখন বেশি জরুরি। লোকে ভাববে আমি হিংসা করছি। সেটা ভুল। এখন হিংসে করার আমার কিছু নেই।
এ রকম কেউ আছেন, যাঁকে আপনার মনে হয় মিডিয়া তৈরি করে দিয়েছে?
কেন আনন্দ প্লাসেই তো বারবার সোমলতার ‘মায়াবনবিহারিণী’ গানের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। যাঁরা ওঁর গান শোনেননি, কাগজ পড়ে তাঁরাও শুনছেন। এতে এক ধরনের নেগেটিভ পাবলিসিটি হচ্ছে। আসলে শুধু সোমলতা নয়, নতুন প্রজন্ম যাঁদের কাছে গান শিখছে, তাঁরাই ওদের ঠিক মতো শেখাচ্ছেন না। এখানেই সমস্যা। এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতে উপযুক্ত শিক্ষকের খুব অভাব। রবীন্দ্রনাথের গানের নাটকীয়তা, মডিউলেশন তো প্রকৃত শিক্ষকরাই শেখাতে পারেন।
হারমোনিয়াম আর এস্রাজ বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বড্ড প্যানপেনে হয়ে যাচ্ছে...
যাঁরা পারেন না গান করতে, তাঁরাই এমন বলেন। যাঁদের কণ্ঠ সচল নয়, তাঁরা নিজেদের গলা ঢাকতে অনেক বেশি যন্ত্র ব্যবহার করেন। আমার এই বয়সেও এস্রাজ আর তানপুরা নিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি গানকে কতটা প্রাণবন্ত করা যায়। তবে অনর্থক অনেকেই গান ভীষণ টেনে টেনে গায়, এটাও ঠিক।
গানকে এখন পেশা করে বাঁচা যায়?
আমাদের যুগ কেটে গিয়েছে। এখন গানকে শুধু পেশা করে বেঁচে থাকা শক্ত। দেখতে হবে ট্যালেন্ট কতটা আছে। সাশাকে প্রথম দিকে বারণ করেছিলাম। পরে অবশ্য ওকে ‘হ্যাঁ’ বলেছি। কিন্তু সবাইকে তো আর সেটা করার কথা বলতে পারি না।
একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং শিক্ষক হয়ে সামপ্লেস এলস-এর মতো জায়গায় গান গাইতে গেলেন কেন?
রবীন্দ্রনাথ কোথাও কি বলেছেন কেবল জুঁইফুলের মালা জড়িয়ে সাদা শাড়ি পরেই তাঁর গান গাইতে হবে? আমি যদি ড্রামের সঙ্গে ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গাই, তাতে দোষ কী? সকলে এত এনজয় করেছিল, ভাবা যায় না। আমি ক্যাফে কফি ডে তে-ও গান গেয়েছি। বহু অবাঙালির সামনে খালি গলায় গান গেয়েছি। গান গেয়ে আনন্দ পেলে যে কোনও জায়গাতেই গান গাওয়া যেতে পারে।
অ্যানিমেশনে ‘তাসের দেশ’ করার কথা ভাবছেন... আপনি কিউ-য়ের ‘তাসের দেশ’ দেখেছেন?
হ্যাঁ, আমার রুচির সঙ্গে মেলেনি। তাই ভাল লাগেনি।
রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে রুচি, শিক্ষা কতটা জরুরি?
এটাই ফ্যাক্ট ‘লুঙ্গি ডান্স’-এর জনপ্রিয়তা ‘মল্লিকাবনে’র হবে না।
আপনার দুই মেয়ের কেউই গান গাইলেন না! কারণটা কী?
দু’জনেই ভাল গায়। কিন্তু প্রকাশ্যে গাইতেই চায় না ওরা।
এটা কি হতাশার কথা?
নাহ্, আমি ভীষণ পজিটিভ।
আর প্রেম?
প্রায়ই নানা পুরুষের প্রেমে পড়ি। এই এখন যেমন রণবীর হুডা। আমার বয়সটা বেশি। কিন্তু কী করব? (হাসি)