স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।
স্বস্তিকা: বাবা, আজ আমার নাইট শিফট। ভোরে ফিরে ঘুমিয়ে তোমায় দুপুরে ফোন করব। চিন্তা কোর না।
সন্তু মুখোপাধ্যায়: ওহ! কাজ ঠিক হল? এত বড় প্রোডাকশন হাউজ! পরিচালক খুশি তোকাজ নিয়ে?
স্বস্তিকা: সব ঠিক আছে। তুমি ভেবো না। পরে কথা হবে।
সন্তু মুখোপাধ্যায়: তোর কাজ ঠিক ছিল? পরিচালক কী বললেন কাজ দেখে?
স্বস্তিকা: বাবা! আমি কি নিউকামার? রোজ পরিচালক বলবে কাজ ভাল হচ্ছে? হ্যাঁ, ভুল হলে নিশ্চয় বলবে। বাবা, তুমিও পারো...আজ খুব শক্ত সিন ছিল জানো!
সন্তু মুখোপাধ্যায়: তাই? তুই নিশ্চয় ফাটিয়ে দিয়েছিস? ফোন করিস...
আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই গত বছর মার্চে দিল্লিতে অনুষ্কা শর্মার প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে কাজ করার সময় বাবা সন্তু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতি মেলে ধরলেন স্বস্তিকা।
সেই বাবাই ‘পাতাললোক’ দেখে যেতে পারলেন না!
খুব মনে হচ্ছে এখন। আমি ভাবিনি ‘পাতাললোক’-এর মতো মেল ডমিনেটেড ছবি, যেখানে সমাজের রাজনীতির অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে সেখানে ডলি মেহরার মতো মুখ্য নয় এমন চরিত্র এত জনপ্রিয় হয়ে যাবে।
ডলি মেহরার চরিত্রে স্বস্তিকা
এই লকডাউনের সময় শোনা যাচ্ছে ডলি মেহরাকে দেখেই স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া ভুলে ‘পাতাললোক’ দেখছেন!
আমি আজ সকালেই আমার বোনকে বলছিলাম, কাজটা করার সময় এত কিছু ভাবিনি। বাবা সেই ছোটবেলায় বলে দিয়েছিল,‘আলাদা করে অভিনয় করার চেষ্টা করবে না। চরিত্র হয়ে ওঠার প্রয়াস করবে। তাহলেই কাজ হবে।’ আমিও সেটাই মেনেছি।দিল্লিতে যখন এই কাজের জন্য ওয়ার্কশপ করেছি তখন আমি আর নীরজ কবি কিন্তু একবারের জন্যও চিত্রনাট্যের সংলাপ আওড়াইনি। ডলি আর সঞ্জীব মেহরার চরিত্র করতে গিয়ে আমরা এমন কিছু পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছিলাম যাতে ওদের দাম্পত্য যে ভালবাসাহীন, সেই মনোভাব আমাদের মধ্যে ঢুকে যায়। ওই কথোপকথনই আমাদের ডলি আর সঞ্জীব করে দেয়। আসলে অনুষ্কা শর্মার প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করা একটা অভিজ্ঞতা। এখানেই কলকাতার সঙ্গে মুম্বইয়ের তফাৎ।
কী তফাৎ?
দেখুন, আমি এ ভাবে বললে লোকে আবার তেড়েফুড়ে উঠবে।
আপনার কাজের অভিজ্ঞতাটাই বলুন না...
এদের প্রযোজনা সংস্থা শিল্পীদের অসম্ভব সম্মান করে।দেখু্ন, মুম্বই নিয়ে কিছু বললেই আমরা বলি ওদের অনেক পয়সা! বিষয়টা শুধু পয়সার নয়। এখানে লাঞ্চ ব্রেক হলে সবাই একসঙ্গে খায়। চেয়ার টেবিল ছড়ানো ছেটানো থাকে। যে যার মতো বসে আড্ডা মারতে মারতে খায়। আমি চাইলে আমার ভ্যানে খেতেই পারি। কিন্তু আমার ইচ্ছে করেনি। এটা মানসিকতার প্রশ্ন, এর জন্য পয়সা লাগে না। আর এত খাওয়ায় ওরা! আমি তো বলতাম, আমি রোজ যে ভাবে ফ্রায়েড রাইস, পরোটা খাচ্ছি তাতে আমার ড্রেসাররা এসে বলবে,‘তোমার প্যান্টের আবার মাপ নিতে হবে!’ যাইহোক, খুব কমফর্ট জোনে আমি কাজ করেছি।
বাবার চলে যাওয়া শিখিয়ে দিল কিছু ভেবে জীবনে কিছু হবে না
অনুষ্কার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না, ও যখন সেটে এসেছিল আমি ছিলাম না।
বিদ্যা বালনের ফোন কেমন লেগেছিল?
ভাবতেই পারিনি! জীবনেযে প্ল্যান করে কিছু হয় না এখন খুব বুঝতে পারি। বিদ্যার ফোন সেরকম। ডলি মেহরাকে দেখে ওঁর খুব ভাল লেগেছে। আমি রান্না করছিলাম। আমাকে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি কেবল ফোন করেই গিয়েছেন। একেই বলে ভদ্রতা।
আপনি এখন মুম্বইতে?
হ্যাঁ। মেয়ের কাছে এসেছিলাম। ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু লকডাউনে আটকে গেলাম। এখানেই আছি। আর কী?
‘পাতাললোক’-এর এত জনপ্রিয়তা! মনে হয়েছে কখনও লকডাউনের সময় এই জনপ্রিয়তার জন্য কিছু অংশে দায়ী?
না। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছবি দেখার অভ্যেস মানুষের অনেক আগেই কিন্তু তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমি চারিদিকেই এখন বলতে শুনি, হলে গিয়ে অত দাম দিয়ে টিকিট কেটে ছবি দেখে কী হবে? কয়েকদিনের মধ্যেই তো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছবিটা চলে আসবে। আপনিই বলুন, আমি যতদূর জানি মধ্যবিত্ত যারা তাদের কাছে মাসের শেষে সিনেমা দেখার পেছনে ৩-৪ হাজারটাকা খরচ করা খুব সহজ কি?তার চেয়ে বাড়িতে বসে ছবি দেখাই ভাল। আর এর পরে তো ওই মাস্ক পরে গ্লাভস চড়িয়ে কে যাবে বলুন তো সিনেমা হলে? আমার তো বাজারে মাস্ক পরে গিয়েই দমবন্ধ হয়ে আসছে!বিনোদন দুনিয়া এখন সত্যিই সঙ্কটের মুখে!
আপনি হয়তো শুনে থাকবেন গতকাল নবান্নের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘ক্লিন জোন’-এ ফিল্ম আর টেলিভিশন শুট হতে পারে। আপনার কী মত?
দেখুন, আমরা শরীর নিয়েই কাজ করি। অভিনয়ে সামাজিক দূরত্ব কী করে সম্ভব? ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরবে না? আভিনেতা কাছাকাছি এসে সংলাপ বলবে না? দূর থেকে কি চুমু খাওয়া যায়? আর চিট করে আর যা-ই হোক, ইমোশন আনা যাবে না।
কতটা ইমোশন ছিল আপনার ডলি মেহরার চরিত্র করার জন্য?
আমি যখন চরিত্র করি তখন যেমন চরিত্রকেও কিছু দিই, আবার সেই চরিত্রও আমায় কিছু দেয়।
অনুষ্কা শর্মার প্রযোজনা সংস্থা শিল্পীদের অসম্ভব সম্মান করে
ডলির কাছ থেকে কী নিলেন আপনি?
ডলির উষ্ণতা, মানবিক বোধ। চাইলে ও ওর স্বামীর সঙ্গে ঝামেলায় যেতে পারত। প্রমাণ ছিল ওঁর কাছে। স্বামীকে অপমান করতে পারত। ওঁর সম্মানে সেটা আটকেছে বলেই করেনি। ডলির এই মানসিকতা আমি নিলাম।
মানে আপনি শান্ত হলেন?
শান্ত মানে এই নয় প্রয়োজনে উচিত কথা বলব না। তবে মানবিক বোধ, হিসেব কষে জীবনে না চলা...ক’টা ছবি করলাম? পরে আর কী করব? এসব আর ভাবি না। আর এখন তো লকডাউন! সামনে কী হবে কেউ জানি না। বরং আজকের দিন নিয়েই ভাবি।
বাবা চলে যাওয়ার পরে এই প্রথম কথা হচ্ছে আপনার সঙ্গে...
বাবার চলে যাওয়াও শিখিয়ে দিল কিছু ভেবে জীবনে কিছু হবে না। যে লোকটা পার্লার থেকে নখ কেটে এল,তার পরের দিন ক্যান্সার তা-ও প্রায় লাস্ট স্টেজ!বাবার কথাগুলো খুব মনে পড়ে এখন...
যেমন...
জানুয়ারি মাসে একটা গাড়ি কেনার কথা ভাবছিলাম। গাড়ির বিষয়ে আমি কিছুই বুঝি না। আমার বোনের স্বামীর পরামর্শেই চলি। পুরনো গাড়ি বদল করব, বাবাকে বললাম। তারপর অনেক বাছাইয়ের পর অনেক দামি হাইএন্ডের গাড়ি কিনব ঠিক করলাম। এমজি হেক্টর গাড়ি। বাবাকে ছবি দেখালাম। বাবা দামটা শুনল, প্রথমে অত দামি টাকার গাড়ি যে হবে সেটা বিশ্বাস করতে পারছিল না বাবা।তারপর আমি জোর দিয়ে দামটা বলায় বলল, ‘ছি! ছি! ভদ্রলোকেরা এ ভাবে কখনও বৈভব দেখায় না!’ সে দিন বাবার উপর রাগ হয়নি। বলেছিলাম, "তোমার জ্বালায় না আমি পাগল হয়ে যাব। একটা দামি গাড়িও কিনতে দেবে না। " বাবা আরও অসুস্থ হল। গাড়ি কেনার পরিস্থিতিই চলে গেল। এরকম ছিল আমার বাবা। প্রায় ঝগড়া করতাম, বলতাম তুমি যে প্রোডাকশন হাউজে কাজ করছ তাদের বল তোমার পারিশ্রমিক বাড়াতে, তুমি এত সিনিয়র! বাবা সে সব কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলত, ‘আহ! ওরাই বা কোথায় পাবে?’আমাকেও শেষ দিন অবধি শিখিয়ে গেল, টাকা, লোভ এ সব কিছু নয়। ক্রাফট আসল! সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং। বাবার কথা ভাবি, কথাটা ঠিক বলেছিল বাবা। সেই যে বলে চলে গেল...সেই কথা নিয়েই তো আমি বসে আছি!