উইকিপিডিয়া বলছে, আপনার পরিচালিত ২০০৯-এর ছবি ‘এক থো চান্স’ এ বছর বাণিজ্যিক ভাবে মুক্তি পাচ্ছে। খুশি তো?
কী জানতাম না তো! এ সম্পর্কে তো আমাকে কিছুই বলা হয়নি। ছবি বানানোর পরে প্রযোজকদের (রজিত কপূর ও রঙ্গিতা প্রীতিশ নন্দী) অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা লক্ষ করেছি।
রাগ হয়নি?
ছবি তৈরির পরে আমি আর ভাবি না।
আবার পরিচালনার স্বপ্ন দেখছেন?
হ্যাঁ, দেখছি। ছবির বিষয় হল স্মৃতি। আমরা কতটা মনে রাখতে পারি? কতটা মনে না-রাখার জন্য, কতটা মিথ্যে কথা বলতে হয় নিজেদের কাছে। পরের বছর ছবিটার শ্যুটিং শুরু হবে। এখনও নাম ঠিক করিনি।
আপনার পরিচালিত ‘অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুস্সা কিঁউ আতা হ্যায়’ ছবির রিমেক হতে চলেছে, যাতে অভিনয় করছেন নন্দিতা দাস, সৌরভ শুক্ল এবং মানব কউল...
হ্যাঁ ঠিকই। পরিচালক সৌমিত্র রানাডে। এটা ২০১৪-র পটভূমিতে বানানো। এর আগে ‘যজন্তরম মমন্তরম’ নামে একটা সিনেমা বানিয়েছিল। সৌমিত্র আমার কাছে মত চাইতে আমি রাজি হয়েছিলাম। ওটা ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’য়ের থিয়োরির ওপর ভিত্তি করেই সৌমিত্র বানাতে চাইছে। ওর কাজে আমি নাক গলাব না। ছবি তো আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
কেউ যদি বলে ‘নুক্কড়’ বা ‘সাকার্স’ রিমেক করবে টেলিভিশনের জন্য?
হ্যাঁ। কোনও আপত্তি নেই।
টেলিভিশন দেখেন?
মাঝেমধ্যে নিউজ দেখি। তবে আজকাল প্রত্যেকটা চ্যানেলে দিনে ২৫বার ব্রেকিং নিউজ। আসল নিউজ হলে কী হবে?
শাহরুখকে নিয়ে ‘সার্কাস’ বানানোর সময় কি ওঁর মধ্যে তারকা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। শাহরুখের প্রথম সিরিয়ালের নাম ছিল ‘ফৌজি’। আমি সেটা দেখিনি। আজিজ (মির্জা) আর কেতন (মেটা) দেখে আমায় বলেছিল ‘সার্কাস’য়ে ওকে নিতে। আমি রাজি হয়ে যাই। শাহরুখকে দেখে মনে হত ও ভাবে যে ইন্ডাস্ট্রি থেকে ওর প্রাপ্য স্বীকৃতিটা পাওয়া উচিত। কী অসম্ভব আত্মবিশ্বাস! রোমাঞ্চের নেশায় বুঁদ। ভয় বলে কোনও ব্যাপার নেই। উঁচু উঁচু প্যারাপেটের ওপর দাঁড়িয়ে হেঁটে যেত শ্যুটিংয়ের সময়। আমাদের ভয় লাগত। কিছু বললে বলত, ‘‘ও সব বলবেন না, কনফিডেন্স নষ্ট হয়! আমাকে কাজ করতে দিন।” ওকে দেখে মনে হয়েছিল যে একটা লম্বা সফরে এগোচ্ছে। আর তাই হল। আমি অবশ্য কোনও দিন ভাবিনি শাহরুখের সঙ্গে ছবি করব। কিন্তু কেতন-আজিজ তো করেছিল।
সেই জার্নিটা দেখে কেমন লাগে?
ভাল। ও সব নিজের শর্তে করেছে। অ্যাডভেঞ্চার ওর রক্তে। তা সে কেকেআর টিম কেনা হোক বা নিজের শর্তে ছবি করা। কেরিয়ারের প্রথম দিকে ও মণি কাউল, কেতন মেটার ছবি করেছে। খুব কম লোকে তা জানে। আমার ধারণা আজও সুযোগ পেলে ঝুঁকি নিতে ভয় পাবে না।
কোন অভিনেতার সঙ্গে পর্দায় আবার যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করে?
মনে আছে ‘বুনিয়াদ’য়ের সেই অনিতা কানওয়ারকে? জানি না এখন কোথায় আছে... কী করছে... অনিতা হল পিওর সিনেমা। ওকে একটা ফ্রেম-য়ে দিলে ও নিজে সিনেমা তৈরি করে নিতে পারত। নাসির তো আছেই। একবার মনে আছে ‘মোহন জোশী হাজির হো’ ছবিটার শ্যুটিং করছি। নাসির এক হটশট আইনজীবীর ভূমিকায়। ক্যামেরাতে হয়তো দেখা যাবে না, তবু বলেছিলাম সাদা ছুঁচোলো জুতো পরতে। হঠাৎ দেখি নাসির একটা শটে নিজের পা-দুটো নিজের টেবিলের ওপর তুলে দিল। এমন ভাবে করল যেটা দৃশ্যের সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবে মিলে যায়। তার পর আমায় বলল এ রকম জুতো পরেও সেটা তো দেখাতেই হবে!
আপনি পুণে এফটিআইআই-য়ের চেয়ারম্যান। কলকাতায় এলেন এসআরএফটিআই-য়ের ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে। ফিল্ম স্কুলের পাঠ্যক্রম আজকালকার ইন্ডাস্ট্রিতে কতটা কাজে দেয়?
ছাত্রছাত্রীদের টেকনিক্যাল শিক্ষাটা জরুরি। প্রয়োজনে ইন্ডাস্ট্রিতে যাতে কাজ করতে পারে। ক্লোন না হয়ে নিজে চিন্তা করার শিক্ষাটাও জরুরি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা বানাও বা অন্য কিছুতা নিয়ে সমস্যা নেই। যাই করো নিজের গলাটা হাড়িকাঠে দিতে ভয় পেও না।
তবে ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা বানানোর লড়াইটা তো এখানে খুব কঠিন...
বিশ্ব জুড়ে ইন্ডিপেনডেন্ট ছবির জায়গাটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। হলিউড সিনেমা সব গ্রাস করে নিচ্ছে। ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটালিয়ান, ব্রিটিশ, চেক, হাঙ্গেরিয়ান, সুইডিশ, পোলিশ, এমনকী জাপানের ছবির কী হাল আজকাল! এর মধ্যে যে দেশের ছবিগুলো নিজেদের একটা জায়গা ধরে রেখেছে তা হল কোরিয়া, চিন, তাইওয়ান আর ভারত। বলিউডিশিয়ান হয়েছে ভারতীয় ছবির। তবে ইন্ডিপেনডেন্ট ছবি তাও হচ্ছে। ওড়িশাতে, কর্নাটকে, কেরলে হচ্ছে।
বাংলায়?
কিউ-এর কাজ দেখেছি। অন্যরাও আছেন। ইন্ডিপেনডেন্ট ছবির ক্ষেত্রটা আরও বড় হলে ভাল লাগত। তবু লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে। কাঁদুনি গাইলে হবে না। ১৯৮২ সালে আমার বাড়িতে একটা ফোরাম করেছিলাম। দেশের সব প্রতিষ্ঠিত পরিচালক, শিল্পী, লেখক একটা লিখিত আবেদনে সই করেছিলেন। ছিলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ। আর্জি জানিয়েছিলাম, যাতে দেশে একশোটা হল তৈরি হয় যেখানে ইন্ডিপেনডেন্ট ছবি দেখানো হবে।
কী হল সেই আর্জির?
কোনও উত্তর আসেনি। কিন্তু তার মানে ভেঙে পড়লে চলবে না। এটা বলার কারণ হল আমরা তখন একজোট হয়ে এই আবেদনটা করেছিলাম। এখন দেখি সব্বাই আলাদা আলাদা ভাবে লড়ছে। বুঝি আজকাল সার্ভাইভ করাটা কষ্টের। কিন্তু আমাদের সময়েও অসুবিধা ছিল। ‘অ্যালবার্ট পিন্টো...’ বানানোর সময় আমার অ্যাসিসটেন্টের মধ্যে ছিল কুন্দন, সুধীর মিশ্র, বিধুবিনোদ চোপড়া। ওরা ফিল্ম বানালে আমরাও সাহায্য করেছি।
এখনকার পরিচালকদের মধ্যে সেই তাগিদটা দেখেন?
মুম্বইতে দেখি অনুরাগ (কাশ্যপ) দিবাকর (বন্দ্যোপাধ্যায়), তিগমাংশু (ধুলিয়া), অনির... ভাল কাজ করছে। অনুরাগের ‘দেব.ডি’ হল ‘আ ডিভাস্টেটিং অ্যাসল্ট অন এ সেক্রেড নভেল’। অনুরাগ প্রশ্ন কিংবা সমালোচনা করতে ভয় পায় না। অন্যদের ছবি বানাতেও সাহায্য করে। আজকাল ইনস্টিটিউট থেকে মহিলা পরিচালকেরা পাশ করে তথ্যচিত্র বানায়। মাঝে মাঝে ভাবি ওরা সিনেমা বানায় না কেন?
আপনাদের সময় এনএফডিসি-র ফান্ডিং ছিল। এখন তো পরিচালকেরা ওটা সে ভাবে পান না...
ফান্ডিং পেয়েছি। ঝুঁকিও নিয়েছি! ‘সেলিম লংড়ে পে মত রো’ শু্যট করার ছ’মাস আগে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি যাতে জায়গার ফ্লেভারটা ধরতে পারি চিত্রনাট্যে। লোকে কি জানে যে ‘অ্যালবার্ট পিন্টো...’ চারশো পারসেন্ট প্রফিট করেছিল? ‘সেলিম লংড়ে...’ তিনশো পারসেন্ট প্রফিট করেছিল। আমাদের বাজেট কম ছিল বলে লোকে এই প্রফিটটা দেখে না।
কী ধরনের ঝুঁকির কথা বলছেন?
একবার পুলিশ পারমিশন ছাড়াই রাস্তায় শ্যুট করছি। স্থানীয়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে রাস্তা ফাঁকা করে ক্যামেরা বসিয়েছি। তার পেছনে পাঁচ হাজার লোক। গুলির শট। কিন্তু ফায়ার হল না। রিটেক করার বাজেট কোথায়? পাশ থেকে একজন রিভলভার বের করে বলল,“এটা নেবেন? আসল। ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার হবে না।” আমি হতবাক। কী এলাকায় শ্যুটিং করেছি! আরও একটা ব্যাপার। ফিল্ম বানানোটা একটা টিমওয়ার্ক। যত বড় স্টার হও না কেন, লাঞ্চ ব্রেকে ইউনিটের সঙ্গে লাইন দিয়ে খাবার খেতে হবে। কোনও দিন নিজের ছবির আগে লিখিনি ‘আ সৈয়দ মির্জা ফিল্ম’। লেখক, পরিচালক হিসেবেই আমার নাম যেত। সবকো সেলাম দে না পড়তা হ্যায়, ভাই!
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।