আনন্দবাজারের দফতরে ইরফান ছবি: রণজিৎ নন্দী
কোনও ইন্টারন্যাশনাল আইকন কী করে এতটা লো-প্রোফাইলে থাকতে পারেন?
‘স্লামডগ মিলেনিয়ার’, ‘দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান’, ‘লাইফ অব পাই’, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’-এর মতো ঈর্ষণীয় সিনেমা রয়েছে তাঁর সিভিতে। কিন্তু আনন্দবাজারের দফতর যে-ইরফান খানকে দেখল, তিনি একদম আটপৌরে। বাড়িতে কচুর লতি দিয়ে ভাত খান! মাছের ঝোল তো বটেই।
স্ত্রী সুতপার জন্য তাঁকে ‘হাফ বাঙালি’ বলা যেতে পারে। আনন্দ প্লাসের দেওয়া সন্দেশের বাক্স দেখে উৎসাহী হলেন। ক্যালোরি মাপেন নাকি? ‘‘ধুস! ও সব আবার কী! শরীরচর্চা করি। কিন্তু কোনও জোর জবরদস্তির মধ্যে নেই,’’ বিন্দাস গলায় ইরফান। বাড়িতে পুজোর সময় তাঁর বাড়িতে পূজাবার্ষিকী আসবেই। ‘‘পুরো গোছা করে বইগুলো আসে। সুতপা এটা কখনও মিস করে না।’’
পোশাকও একেবারে সাদামাঠা। কোন তারকা লুঙ্গি পরে সাংবাদিক বৈঠক করেন? ইরফান এতটাই ‘কুল’ যে, এ সবের পরোয়া করেন না। কালো লুঙ্গির সঙ্গে কালো শার্ট আর জ্যাকেট পরে দিব্যি চলে এলেন। ‘‘গরমে এর চেয়ে আরামদায়ক পোশাক হতে পারে নাকি,’’
মন্তব্য তাঁর!
আগামী রিলিজ ‘হিন্দি মিডিয়াম’-এর প্রচারে সফর করছেন। বাংলা ছবি ‘রামধনু’র সঙ্গে যার মিল আছে বলে অভিযোগ। ইরফান জানেন বিষয়টা। বলা ভাল, বিতর্ক ওঠার পর জেনে নিয়েছেন। বললেন, ‘‘দুটোর বিষয় এক নয়। আমরা গল্পটা মজার ঢঙে বলেছি। ওরা স্কুল এডুকেশনের দিকে ফোকাস করেছে। আমাদের জার্নিটা একেবারে আলাদা। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে কী নাজেহাল দশা হয় বাবা-মায়ের, সেটা দেখানো হয়েছে।’’
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বেশ আপত্তি তাঁর। ‘‘ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে যাতে ভাল চাকরি পায়, সেই উদ্দেশ্যে স্কুলে ভর্তি করি আমরা। বড় নামী স্কুল হতেই হবে। আরে, বাচ্চাদের কীসে আসল আগ্রহ সেটা আগে বুঝতে হবে।’’ গল্পের ছলে জানালেন, একেবারেই পড়াশোনায় ভাল ছিলেন না। বরং খেলাধুলোয় আগ্রহ ছিল। স্কুল তাঁর কাছে জেলখানার মতো। তাই চাননি ছেলেমেয়েরা তাঁর মতো জেলখানায় বন্দি থাকুক। ‘‘ভাগ্য ভাল, আমরা এমন একটা ভাল স্কুল পেয়েছি যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতেও নজর দেওয়া হয়। শুধু মুখস্থ বিদ্যের উপর জোর দেওয়া হয় না।’’
তাঁর কাছে ভাষাটা কোনও বাঁধন নয়। ইংরেজি বলতে না পারাটাও লজ্জার নয়। যতই হলিউডে ছবি করুন। নিজেকে দেশি বলতে দ্বিধা নেই। কিন্তু ভাল ইংরেজি না জানলে কি আর হলিউডে ছবি করা যায়? ‘‘যায় না। আমি তো বলছি না হিন্দি-ইংরেজির বিরোধ আছে। বরং বলব, যত পারো অন্য ভাষা শেখো। জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। তবে নিজের ভাষা নিয়ে লজ্জা পাবে না।’’
ভাষা কোনও দিনই ইরফানের অভিনয়-সত্তার রাস্তায় বাধা হয়নি। হলিউ়ডের পাশাপাশি বাংলাদেশের ছবিও করেছেন। মনে করেন, ‘বাহুবলী’র মতো ছবি বলিউড-আঞ্চলিকের বাঁধগুলো ভেঙে দিচ্ছে। ‘‘দর্শক ম্যাচিওর্ড। তাঁরা ভাল জিনিস বেছে নিচ্ছেন। সেটা বলিউড হোক কিংবা আঞ্চলিক। হয়তো আমরা ভাল ছবি দিতে পারছি না বলেই তাঁরা অন্য জায়গার ছবি দেখছেন। এই দিকটাও ভেবে দেখতে হবে,’’ খানিকটা ব্যঙ্গের মতো শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর। বদলে যাচ্ছে অভিনেতা আর হিরোর সংজ্ঞাও। কথাটা মানবেন? মেনে নিলেন ইরফান। বললেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা এখন অ্যাকসেসেবল। স্টার মানেই মিস্ট্রি, এটা আর বলা যাবে না। তবে কি জানেন, মিডিয়াই আমাদের হিরো বানিয়েছে। কে হিরো আর কে রিয়েল হিরো সেটা দেখতে হবে। মনে হয় না, এই অ্যাটেনশনটা ডিজার্ভ করি।’’
হয়তো বিনয় দেখিয়ে কথাটা বললেন। কিন্তু অস্কার? হলিউ়ডে কাজ করছেন। তাঁর ছবি অস্কার পেয়েছে। কখনও কি মনে হয়েছে, ওই সোনালি মূর্তিটা যদি তাঁর হাতেও উঠত? ‘‘নিশ্চয়ই হয়েছে। অভিনেতারা তো স্বীকৃতির স্বপ্ন দেখবেনই। এতটা প্রেস্টিজিয়াস একটা পুরস্কার, সেটা পাওয়ার লোভ থাকবে না। কিন্তু যে সব পুরস্কার নিজেই একটা ঠাট্টা, সেগুলোতে আমার আগ্রহ নেই,’’ দ্বিধাহীন গলায় জবাব এল। তবে শেষ বাক্যটায় বিশেষ কোনও ‘পুরস্কার’কে কি ঠুকলেন তিনি!
তবে অভিনেতাদের সব স্বপ্ন তো আর সত্যি হয় না। ‘আনসার্টেনটি’ কথাটা তাঁদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। প্রাণ ঢেলে কাজ করলেন অথচ দৃশ্যটাই বাদ পড়ে গেল। খারাপ লাগে না? জবাবে ইরফান আর এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘‘দৃশ্য ছেড়ে দিন, গোটা ছবিটাই হয়তো রিলিজ করল না। হ্যাঁ, এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হয়।’’
তাঁর কেরিয়ার কিন্তু একেবারে নিশ্চিত। হলিউ়ডের ছবি ‘পাজ্ল’-এ অভিনয় করতে চলেছেন ইরফান। যেখানে তাঁর সঙ্গে কেলি ম্যাকডোনাল্ড আছেন। অতএব বছরের শেষে ইরফান আবার হলিউডেই ফিরছেন।