বলিউডের মাইলস্টোন ফিল্ম ‘শোলে’-র ৪৫ বছর হয়ে গিয়েছে। অথচ আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে গব্বরের ডায়ালগ। আজও টেলিভিশনে ‘শোলে’ সম্প্রচার হলে একই কৌতূহলে পুরোটা বসে দেখেন দর্শক।
এই ফিল্মের পর আমজাদ খানের জীবন বদলে যায়। কিন্তু তার কয়েক বছর পর এক গাড়ি দুর্ঘটনা সব কিছু কেড়ে নেয় তাঁর থেকে। ১৯৯২ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হলেও ‘শোলে’ অমর করে দিয়ে গিয়েছে গব্বরকে। বাস্তব জীবনে গব্বরের কাহিনি কোনও ফিল্মের থেকে কম নয়।
১৯৪০ সালে মুম্বইয়ে জন্ম আমজাদের। মা-বাবা দু’জনেই অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালে শাহলা খানকে তিনি বিয়ে করেন। আমজাদের প্রতিবেশী ছিলেন শাহলা। তাঁদের লভ স্টোরিও যেন ব্লকবাস্টার ফিল্ম।
আমজাদ যখন কলেজে পড়ছেন শাহলা তখন ১৪ বছরের কিশোরী। শাহলা প্রথমে আমজাদকে দাদা হিসাবেই দেখতেন। অনেক সময় ব্যাডমিন্টন খেলার সময় শাহলা তাঁকে দাদা সম্বোধন করতেন। আমজাদ মোটেই বিষয়টা পছন্দ করতেন না।
এক দিন শাহলাকে ধমক দিয়ে বলে দেন, তিনি তাঁর দাদা হন না। আসলে তখনই মনে মনে শাহলাকে পছন্দ করতেন আমাজাদ, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারতেন না। এক দিন সাহস করে কথাটা বলেই ফেললেন আমজাদ।
সে দিন স্কুল থেকে ফিরছিলেন শাহলা। বাড়ির বাইরে আমজাদ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শাহলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘শাহলা নামের অর্থ জানো? এর অর্থ গভীর কালো চোখ’। তার পরের কথাটাই ছিল, ‘তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠো কারণ আমি তোমাকে বিয়ে করব।’
এর কিছু দিন পর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে শাহলার দরজায় পৌঁছেও যান আমজাদ। কলেজে পড়া এক ছাত্রের এমন দুঃসাহস একেবারেই পছন্দ হয়নি শাহলার বাবার। দরজা থেকেই তিনি ফিরিয়ে দেন আমজাদকে।
তার পর শাহলার ভাগ্যে জুটেছিল হুমকি। আমজাদ নাকি তাঁকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি আমার প্রস্তাব নাকচ করে দিলে? এটা যদি আমার গ্রাম হতো তোমাদের তিন প্রজন্ম মুছে দিতাম।” এক সাক্ষাৎকারে শাহলা নিজে জানিয়েছিলেন এ কথা। শাহলা অবশ্য নিজে প্রস্তাব ফেরাননি। ফিরিয়েছিলেন তাঁর বাবা।
আর তাঁর প্রভাব থেকে মেয়েকে দূরে রাখতে পড়াশোনার জন্য আলিগড় পাঠিয়ে দেন। আলিগড় যাওয়ার পরই মূলত তাঁদের প্রেমের শুরু। শাহলার বাবা জানতেন না যে দূরত্ব কখনও তাঁদের ভালবাসায় বাধা হতে পারবে না। বরং এই দূরত্বই আমজাদের আরও কাছে নিয়ে আসে শাহলাকে। রোজ তাঁদের চিঠি বিনিময় শুরু হল।
কয়েক মাস পর অসুস্থ হয়ে পড়ায় শাহলাকে ফের মুম্বই ফিরিয়ে আনতে হয়। সে সময়ে শাহলাকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করেন আমজাদ। পড়াশোনাতেও সাহায্য করতেন। শাহলার বাড়ি গিয়ে তাঁকে টিউশন দিতেন।
এর পরই দ্বিতীয় বার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে শাহলার বাড়িতে হাজির হন আমজাদ। তবে এ বাবে আমজাদ নিজে যাননি। গিয়েছিলেন তাঁর বাবা। এ বার আর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেননি শাহলার বাবা। ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। বিয়ের পরের বছরই তাঁদের প্রথম সন্তান শাদাবের জন্ম হয়।
প্রথম সন্তান যেন সৌভাগ্য নিয়ে হাজির হয় আমজাদের জীবনে। শাদাবের জন্মের দিনই ‘শোলে’-র অফার পান আমজাদ। বেঙ্গালুরুতে শ্যুটিং করতে যাওয়ার সময় আর এক ঘটনা ঘটে। বিমানে গোলযোগ দেখা দেয়। মেরামত করে বিমান ছাড়তে অনেকটা দেরি হয়। ৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর বিমানে উঠে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল আমজাদের।
বাড়িতে ছোট শিশু। আমজাদের দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে! এ সব ভেবেই শরীর অবশ হয়ে এসেছিল। প্রাণ হাতে নিয়ে বেঙ্গালুরু পৌঁছে শ্যুটিং শুরু করে দিলেন আমজাদ। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পেল ‘শোলে’। এর পর জীবন পুরোপুরি বদলে যায় তাঁর।
আমজাদের মোট ৩ সন্তান। ২ ছেলে আর ১ মেয়ে। ফিল্মের এই ভিলেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সন্তান এবং বন্দুদের কাছে হিরো ছিলেন। সন্তানদের বকাবকি করা পছন্দ ছিল না। ছেলেমেয়েদের কারও কিছু ঘটলে আমজাদের চোখে জল চলে আসত।
তবে এক জন বলি স্টারের স্ত্রী হওয়াটা সহজ ছিল না শাহলার কাছে। শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে অনেক সময়ই স্বামীকে পাশে পেতেন না। তার উপর সে সময় কল্পনা নামে এক অভিনেত্রীর সঙ্গেও নাম জড়িয়ে পড়ে আমজাদের। এটা কিছুতেই মানতে পারতেন না শাহলা। আমজাদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা কাটাকাটিও হয় বিস্তর।
কল্পনার সঙ্গে আমজাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়লেও স্ত্রীর প্রতি নিজের কর্তব্য থেকে কোনও দিন বিন্দুমাত্র সরে আসেননি তিনি। তৃতীয় কেউ যে কখনও তাঁদের বিচ্ছেদের কারণ হতে পারেন না সে সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন স্ত্রী শাহলাও। তাই ২০ বছর সুখী দাম্পত্য কাটান তাঁরা।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ‘দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার’ ফিল্মের শ্যুটিংয়ের জন্য গাড়িতে গোয়া যাচ্ছিলেন তিনি। মাঝ পথে চালককে বিশ্রাম দিয়ে নিজেই স্টিয়ারিং ধরলেন আমজাদ। আর এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
শাহলার শুধু মনে রয়েছে আমজাদ গাড়িতে গান বদলাচ্ছিলেন। তখনই রাস্তা থেকে ক্ষণিকের জন্য চোখ সরে গিয়েছিল। আর তার পর যখন জ্ঞান ফিরল চারদিকে যেন রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যের জোরে শাহলার সন্তানের কিছু হয়নি। সুস্থ ভাবেই জন্ম হয় তার। কিন্তু শাহলার পাঁজরের অনেকগুলো হাড় ভেঙে গিয়েছিল। থেঁতলে গিয়েছিল মুখের অনেকটা অংশ।
আর আমজাদ? সব মিলিয়ে পাঁজরের ১৩টি হাড় ভেঙেছিল। বুক ভেদ করে ফুসফুস ফুটো করে দিয়েছিল স্টিয়ারিং হুইল। পায়ের হাড়ও ভাঙে। সময়ের সঙ্গে সুস্থ হয়ে ওঠেন শাহলা। কিন্তু একের পর এক অস্ত্রোপচার এবং কড়া ওষুধ শারীরিক ভাবে দুর্বল করে তুলেছিল আমজাদকে।
কড়া ওষুধের প্রভাবে ওজন খুব বাড়তে শুরু করে তাঁর। এ দিকে শরীরচর্চাও করতে পারতেন না। ১৯৯২ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে হৃদরোগে মারা যান তিনি।
২৮ বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেন না শাহলা। এই ২৮ বছরে আমজাদের একটাও ফিল্ম দেখেননি তিনি। বাড়িতে আমজাদের কোনও ছবিও রাখেননি শাহলা।