প্রেমিকের নাম অমিতাভ

অমিতাভ বচ্চনের প্রেমকাহিনি। অথচ ক্যানবন্দি রয়েছে ছ’বছর ধরে। মুম্বই থেকে সরোজমিন লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।নভেম্বর মাসে সুজিত সরকারের ‘পিকু’র শ্যুটিং করতে কলকাতায় আসছেন অমিতাভ বচ্চন। আর এখন থেকেই কলকাতায় এসে শ্যুটিং ছাড়া আর কী কী করবেন তার প্ল্যানিং শুরু হয়ে গিয়েছে। দু’টো শর্ত রয়েছে তাঁর। এক, শ্যুটিংয়ের জন্য এমন ভাবে ডেট ফেলতে হবে যাতে হাতে দু’টো এক্সট্রা দিন থাকে। সেই দু’টো দিন স্রেফ নস্টালজিয়াতে বুঁদ হয়ে থাকবেন তিনি। একটা গাড়ি নিয়ে নাকি ঘুরে দেখবেন তাঁর স্মৃতির শহর কলকাতাকে। কে জানে? হয়তো যাবেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে। ওখানেই তো এক সময় ভাই অজিতাভ তাঁর প্রথম ফোটোশ্যুট করেছিলেন এই ভেবে যে ছবিগুলো হয়তো একদিন বলিউডের কোনও পরিচালকের ভাল লাগবে!

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

‘জনি মস্তানা’তে অমিতাভ বচ্চন

নভেম্বর মাসে সুজিত সরকারের ‘পিকু’র শ্যুটিং করতে কলকাতায় আসছেন অমিতাভ বচ্চন। আর এখন থেকেই কলকাতায় এসে শ্যুটিং ছাড়া আর কী কী করবেন তার প্ল্যানিং শুরু হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

দু’টো শর্ত রয়েছে তাঁর। এক, শ্যুটিংয়ের জন্য এমন ভাবে ডেট ফেলতে হবে যাতে হাতে দু’টো এক্সট্রা দিন থাকে। সেই দু’টো দিন স্রেফ নস্টালজিয়াতে বুঁদ হয়ে থাকবেন তিনি। একটা গাড়ি নিয়ে নাকি ঘুরে দেখবেন তাঁর স্মৃতির শহর কলকাতাকে। কে জানে? হয়তো যাবেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে। ওখানেই তো এক সময় ভাই অজিতাভ তাঁর প্রথম ফোটোশ্যুট করেছিলেন এই ভেবে যে ছবিগুলো হয়তো একদিন বলিউডের কোনও পরিচালকের ভাল লাগবে!

দুই, সুজিতকে সঙ্গে যেতে হবে এই নস্টালজিক-ভ্রমণে। সুজিতকে নিয়েই হয়তো লিটল রাসেল স্ট্রিটে গিয়ে খুঁজে বের করবেন সেই ক্ল্যাকটন অ্যাপার্টমেন্ট যেখানে এক সময় তিনশো টাকা মাসিক ভাড়া দিয়ে থাকতেন একটা ১৫ বাই ১৫ ঘরে। একই ঘরে সঙ্গী বলতে কম করে আরও ৮ জন ভাড়াটে।

Advertisement

নাকি খুঁজতে খুঁজতে চলে যাবেন তরুণ বয়সের কোনও প্রেমিকাকে? যার জন্য আজও হয়তো পড়ে রয়েছে জমে থাকা কিছু দীর্ঘশ্বাস...আনন্দ বেদনার অগণিত স্মৃতি...

তবে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অমিতাভের পরিচিতি নতুন নয়। তা সে ব্যক্তিগত জীবনেই হোক বা ক্যামেরার সামনে। ‘পিকু’র সেটেও সেই দীর্ঘশ্বাস মোচড় দেয় অমিতাভের মনে। ছ’বছর আগে সুজিতের সঙ্গে কাজ করেছিলেন প্রথম ছবিতে। নাম ‘জনি মস্তানা’। সে সময় ছবিটির নাম ছিল ‘শ্যুবাইট’। স্টুডিয়ো-স্টুডিয়োয় ঝগড়া, আইনি গণ্ডগোলের জেরে ছবিটা আজও মুক্তির অপেক্ষায়। ন’মাসের প্রেগনেন্সি এখন গড়িয়ে ছ’বছরে। এর মধ্যে অগুন্তি বিজ্ঞাপনের কাজ সেরে ফেলেছেন অমিতাভ-সুজিত। কিন্তু ‘শ্যুবাইট’য়ের স্মৃতি আজও তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়। নিভৃতে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয় হতে থাকে দু’জনের মনে। অনুভূতির রক্তক্ষয়। কখনও অভিমানে পরিচালক বলেছেন ছবিটা তাঁর সিনেমার কেরিয়ারে একটা ‘মিসক্যারেজ’য়ের মতো। কখনও বলেছেন ছবিটা তাঁর ‘স্টিলবর্ন’ শিশু। তিল তিল করে তাকে গর্ভে ধরেছেন তিনি। তবু জন্ম দিতে পারেননি।

কী ভাবে তা মেনে নিলেন অমিতাভ নিজে? তিনি তো ‘দ্য অমিতাভ বচ্চন’। কোনও রাম, শ্যাম, যদু, মধু নন। বলিউডের শক্তিপুঞ্জের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তবু স্টুডিয়োর ঝগড়ার জেরে তাঁর ছবি আটকে থাকলে নিজেকে অসহায় লাগে না? যে ছবিতে তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়, সেটা মুক্তি না পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করে, সিনিক্যাল না হয়ে কী ভাবে নতুন উদ্যমে শ্যুটিং করে চলেন? “দুঃখটা ভেতরে রয়েছে ঠিকই। তবে মিস্টার বচ্চন বলেই সেই দুঃখটা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আমার মধ্যেও হতাশা ছিল। আমার স্ত্রী ঝুমা আমাকে টেনে বের করেছিল সেই গ্লানি থেকে। বলেছিল ওটা ভুলে যাও। আবার ছবি বানাও।”

বৃষ্টিভেজা মুম্বইয়ে ‘পিকু’র শ্যুটিংয়ের ফাঁকে এমনটাই বলেন সুজিত। যখন তাঁর আন্ধেরি ওয়েস্টের অফিসে দেখা এই প্রতিবেদকের। ছ’তলার উপরে অফিস। ‘ভিকি ডোনর’, ‘ম্যাড্রাস কাফে’ এমনকী ‘অপরাজিতা তুমি’র পোস্টার দেওয়ালে বাঁধানো।

অমিতাভকে শট বোঝাচ্ছেন সুজিত

কিন্তু ‘জনি মস্তানা’? তার ছবি কই? অভিমানে মুখ লুকিয়ে রয়েছে নাকি?

তবে না থেকেও তো কিছু ব্যাপার খুব বেশি করে থেকে যায়। ‘জনি মস্তানা’ও তাই।

মনে পড়ে গেল শ্যুটিং শেষে ছবিটার একটা রাফ-কাট দেখার অভিজ্ঞতা। টিম ‘জনি মস্তানা’র অনেকেই বলে থাকেন এটাই নাকি অমিতাভের সবচেয়ে সাহসী লভ স্টোরি। দুই বর্ষীয়ান তারকাকে নিয়ে তৈরি একটা লভ স্টোরি যে বলিউডে খুব বেশি হয়েছে তা নয়। সব ক্ষেত্রেই তো তারুণ্যের জয়গান। হ্যাঁ, হেমা মালিনী-অমিতাভ অভিনীত ‘বাগবান’ ছবিতে পরিণত বয়সের প্রেমের একটা ঝলক রয়েছে ঠিকই। তবে ‘জনি মাস্তানা’-তে প্রেমের সংজ্ঞাটাই বদলে যায় যখন অমিতাভ ফোনে সারিকাকে বলেন, ‘পরের জন্মেও আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই।’

আপাতদৃষ্টিতে চূড়ান্ত মেলোড্রামাটিক সংলাপও যে কী ভাবে রিয়েলিস্টিক মনে হতে পারে তা এ দৃশ্য না দেখলে বোঝা যাবে না।

ক্যানবন্দী এ ছবির মুখ্য চরিত্রে অমিতাভ। বরফঢাকা মানালি শহরে এক বইয়ের দোকানের মালিক জন পেরেরা। সেই ভূমিকায় অমিতাভ। তাঁর স্ত্রী অদিতির ভূমিকায় সারিকা। এক সময় কফিন মেকারের ছেলে বলে অমিতাভের সঙ্গে সারিকার বাবা তাঁর মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি। পরিবারের অমতে সারিকা বিয়ে করেন অমিতাভকে। কফিন তৈরির ব্যবসা বন্ধ করে অমিতাভ খুলে ফেলেন তাঁর বইয়ের দোকান।

বিয়ের প্রথম প্রথম সব-ই ঠিক থাকে। তার পর সারিকার প্রেগনেন্সি। প্রথম ধাক্কা ডেলিভারির দিন। নিথর শিশুর জন্ম। ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসে সারিকার বাবার সেই অদ্ভুত অভিযোগ। কফিন মেকারের ছেলে মানেই ওর আঙুলে মৃত্যুর ছায়া!

এর পর থেকেই আস্তে আস্তে অমিতাভ নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। প্রেম নেই তা নয়। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশের অভাব।

সুজিতকে প্রশ্ন করি, ‘পিকু’র সেটে কি সেই সব স্মৃতি ফিরে আসে না? “বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং করতে গিয়ে ওই ছবিটার কথা অত মনে হয়নি। কিন্তু ‘পিকু’ তো একটা গোটা সিনেমা। কত কথা যে আমাদের মনে পড়তে থাকে। আর প্রত্যেক বার সেই প্রসঙ্গ উঠলে কোথাও যেন মনটা মেঘলা হয়ে যায়। দু’জনেরই তাই হয়।”

সুজিতের কথা শুনে মনে পড়ে যায় ‘জনি মস্তানা’র সেই দৃশ্য, যেখানে সারিকার জন্মদিনে সবাই তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেও অমিতাভ তা বেমালুম ভুলে যান! সারিকার কটা চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। মুখে শুধু স্বামীকে বলেন, ‘আজ কী এমন দিন যে তোমাকে মনে রাখতে হবে? তোমার জন্মদিন হলে আমি তোমাকে উইশ করতাম। আর আমাদের বিবাহবার্ষিকী হলেও আমি তোমাকে ঘুম থেকে তুলে শুভেচ্ছা জানাতাম। এ ছাড়া আর তো কোনও স্পেশাল দিন থাকতেই পারে না তোমার জীবনে...”

কোনও অভিযোগ নেই।

শুধু মৌনতার মেলোড্রামা।

কেন আটকে

এক সময় খবর ছড়িয়েছিল ‘সিক্সথ্ সেন্স’য়ের পরিচালক মনোজ নাইট শ্যামালানের আইডিয়া টুকেই নাকি ছবি তৈরি করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন সুজিত সরকার! তার পর শোনা যায় পারসেপ্ট-এর সঙ্গেও একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সত্যিটা কী? “কেন টুকে ছবি করব? পারসেপ্ট-এর সঙ্গে কোনও কেস নেই। আমার সঙ্গে চুক্তিটা ইউটিভির। ওরাই আমাকে ছবিটা করতে বলে। গল্পটা মনোজের লেখা। তবে মনোজের সঙ্গে আমার কখনও যোগাযোগ হয়নি।
ওর সঙ্গে যা চুক্তি, তা সবই ইউটিভি আর ফক্সস্টার স্টুডিয়োর। সে চুক্তির টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস আমার জানা নেই।
তবে এটুকু বলতে পারি এখন কোনও আইনি ঝামেলা নেই। ইউটিভি আর ফক্সস্টার স্টুডিয়োকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কবে ছবিটা মুক্তি পাবে,” বলেন সুজিত।

কারণ সারিকাও জানেন যে তাঁকে দুঃখ দেবেন বলে অমিতাভ এমন ব্যবহার করে থাকেন এমনটা নয়। অনেক সম্পর্কই তো এই রকম হয়ে যায়। কিছু দিন পরে দু’টো মানুষ একসঙ্গে থাকা মানে সেটা শুধুমাত্র একটা হ্যাবিট। খাওয়া-দাওয়া-শোওয়ার মতো একটা অভ্যেস। তার জন্য আলাদা করে কিছু করার প্রয়োজন ভুলেই যায় অনেকে।

বার্ধক্যের দোরগোড়ায় এসেও সারিকা শুধুমাত্র অমিতাভের অভ্যেস হয়ে বাঁচতে চান না। কাতর ভাবে অমিতাভের থেকে খোঁজেন ভালবাসার অভিব্যক্তি। যাতে বোঝা যায় যে আজও তাঁদের প্রেম সেই আগেকার মতোই সতেজ। জীবন্ত।

কিন্তু অমিতাভ? তিনি তো নিজের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত। সারিকার প্রয়োজনটাই তো তিনি বুঝতে পারেন না।

তবে জীবনের সব হিসেব একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায় যখন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হন দু’জনে। তখন অমিতাভের কানে ভেসে আসে সারিকার সেই অনুরোধ: ‘আই টু ওয়ান্ট টু ফিল ইয়োর লাভ....’ কথাগুলো ধাক্কা দেয় অমিতাভর মনে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে চলে নীলাদ্রি কুমারের জিটার-এ ‘লিসন টু মাই হার্টবিট’ ট্র্যাকটা। হৃদস্পন্দনের শব্দ ভেসে চলে ব্যাকগ্রাউন্ডে। কোথাও যেন তারই মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান অমিতাভ-সারিকা....তাঁদের গভীর ভালবাসার সুর। জল উথলে পড়ে অমিতাভর চোখে। আজও তোমাকে সেই আগের মতোই চাই বলতে কি খুব দেরি হয়ে গেল?

সারিকা-অমিতাভের কেমিস্ট্রিটা এখন পর্যন্ত দর্শককে না দেখাতে পারার আক্ষেপ থেকেই তিনি নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই জুটিকে দর্শকের সামনে ফিরিয়ে আনার জন্য? বড় পর্দায় না হোক, অন্তত টেলিভিশন সিরিজে? “হ্যাঁ, ‘যুদ্ধ’-এর কাস্টিংটা ‘জনি মস্তানা’ থেকেই অনুপ্রাণিত,” বলেন সুজিত।

কখনও কি মনে হয় যে ছবি আজও ‘স্টিলবর্ন’ হয়েই রয়ে আছে তার থেকে টুকরো টুকরো কিছু মুহূর্ত তুলে নিয়ে এসে ‘পিকু’তে ঢুকিয়ে দেখিয়ে দিই? “আসলে দু’টো ছবি এতটাই আলাদা যে সেটা করা সম্ভব নয়। ‘পিকু’ হল বাবা-মেয়ের গল্প। আর ‘জনি মস্তানা’ হল স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে...”

কিন্তু ‘জনি মাস্তানা’তেও তো দিয়া মির্জার চরিত্রটার সঙ্গে সারিকার একটা অদ্ভুত বন্ডিং হয়েছে... গর্ভজাত সন্তান না হয়েও তো সারিকাকে দিয়া নিজের মায়ের মতোই দেখেন। অমিতাভ-দীপিকার বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মধ্যেও কি তার ছায়া খুঁজে পাওয়া যাবে? “না, নেই। ‘পিকু’ হল একদম একটা উচ্ছৃঙ্খল পরিবারে বাবা-মেয়ের সম্পর্কের গল্প। কমেডি। মিল খুঁজে পাবেন না সেখানে। তা ছাড়া আমি যখন ছবি করি তখন সব সময় আলাদা ঘরানা নিয়েই কাজ করি। একটা জিনিসকে ‘রি-ডু’ করাটা খুব অসুবিধার। ওই মাইন্ডসেটটা ফিরিয়ে আনা যায় না,” উত্তরে বলেন সুজিত।

তবে ‘পিকু’র শ্যুটিংয়ের সময় বারবার ফিরে আসে ‘জনি মস্তানা’ শ্যুটিংয়ের গল্প। মনে পড়ে যায় ছবিতে একটা সায়লেন্ট দৃশ্য ছিল। তার পর অমিতাভের দমকা কাশি। “আমি সিরিয়াসলি শটটা টেক করেছি। আমার সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হঠাৎ আমায় ডেকে বলে: ‘শোন মিস্টার বচ্চন কী বলছেন এই শটে!’ কাশির দমকের মধ্যেও উনি দেখি বিড়বিড় করে বলছেন, ‘ভগবান, আমাকে সুজিতের হাত থেকে বাঁচাও। ও আমাকে রাস্তায় ফেলে চলে যাবে। এই মেক আপে কেউ আমাকে চিনবেও না....’ ইমোশনাল ছবি হলেও আমাদের শ্যুটিংয়ের সময় দারুণ দারুণ সব হাসির মুহূর্ত তৈরি হত,” বলেন সুজিত।

একের পর এক শহরে গিয়ে শ্যুটিং। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকে ডাইডোর ‘লাইফ ফর রেন্ট’ গানটা। এ রকম জনপ্রিয় ইংরেজি গান যে বলিউড ছবিতে ব্যবহার করা যায়, এটাও বেশ বিস্ময়কর। আর সেই পরিচিত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’র ব্যবহার? ‘কহানি’ অনেক পরে শ্যুটিং করে সেই একই গান ব্যবহার করেছিলেন সুজয় ঘোষ। আর সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা গাইয়েছিলেন স্বয়ং অমিতাভকে দিয়েই। একবারও কি সুজিতের মনে হয়নি যে এটাও তো আমি প্রথম করেছিলাম বলিউডে?

প্রশ্ন শুনে সুজিত মৃদু হাসেন।

কথা ঘুরিয়ে বলতে থাকেন সতেরোটি শহরে ঘুরে ঘুরে মাঝরাস্তায় অমিতাভকে নিয়ে শ্যুটিং করার অভিজ্ঞতা। চাঁদনি চক-এর মতো জায়গায় অমিতাভ। যেহেতু মাথায় উইগ আর পোশাকআশাক একদম নোংরা, তাই রক্ষা। তবু যথেষ্ট ঝুঁকিবহুল শট। অমিতাভ তো নিজেই প্রস্তাবটা শুনে সুজিতকে বলেছিলেন, “এটা সম্ভব?”

সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু যেই কাট বলা, অমনি কাতারে কাতারে লোক। আর অমিতাভ তখন ‘দে-ছুট’। মানালির মাইনাস দুই ডিগ্রি তাপমাত্রায় বরফের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে শ্যুটিং করেছেন। “৬৮ বছর বয়সে ওই ঠান্ডায় ও ভাবে শ্যুটিং করা যে কতটা কষ্টকর, তা ছবিটা দেখলে খানিকটা আন্দাজ করা যাবে...” বলেন সুজিত। হায়দরাবাদের চারমিনারের শ্যুটিং আজও বিভীষিকা মনে হয়।

কলকাতার রাস্তাতেও কি ‘পিকু’র জন্য অমিতাভকে নিয়ে শ্যুটিং করবেন তিনি? “হ্যাঁ, করব। উত্তর কলকাতার রাস্তায় মিস্টার বচ্চনকে নিয়ে শ্যুটিং করব। একদম ‘জনি মস্তানা’ স্টাইলে।”

একবার ‘জনি মস্তানা’র শ্যুটিং ছিল তাজমহলে। কিন্তু এখানে সমস্যা ভিড় নিয়ে নয়। সমস্যা এক সারমেয়। ছবিতে এই কুকুরটা বেশ খানিকটা পথ চলে অমিতাভর সঙ্গে। সুজিতের ভাষায়, “আমি দেখেছি কুকুর আর ছোট বাচ্চার সঙ্গে মিস্টার বচ্চন শ্যুট করতে একটু অস্বস্তিতে পড়েন। দু’জনেই খুব আনপ্রেডিক্টেবল। অসম্ভব ধৈর্য লাগে শ্যুটিং করতে। এ দিকে ‘জনি মস্তানা’র একটা দৃশ্যে মিস্টার বচ্চনকে একটা কুকুরকে নিয়ে বসে লম্বা সংলাপ বলতে হবে। তা শুনে উনি আমাকে বললেন: ‘সুজিত, আমাকে ছেড়ে দে কুকুরটার সঙ্গে। আমি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করব’।”

যেমন কথা তেমন কাজ। আর তার ফলও পাওয়া গিয়েছিল। তাজমহলে কুকুরের সঙ্গে শটটা ওয়ান টেক ওকে!

এ তো গেল কুকুর নিয়ে শ্যুটিং। আরও একটা মজার অভিজ্ঞতা ছিল চাঁদনি চক-য়ে। সেখানে অমিতাভর সহ-অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। কিন্তু ২০০৮-এ নওয়াজকে তেমন কেউ চিনত না। ছবিতে এক পকেটমারের ভূমিকায় দু’টো দৃশ্যে নওয়াজ। চাঁদনি চকের ফুটপাথে বসে শ্যুটিং। তখন নওয়াজ শুধু ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ করেছেন। ‘কহানি’, ‘গ্যাংস অব ওয়াসেপুর’ হয়নি।

আচ্ছা, ছবিতে তো পকেটমারের চরিত্রের নামও নওয়াজউদ্দিন, তাই না? “হ্যাঁ, আমি ওকে দেখে নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল নওয়াজউদ্দিন। তখন বলেছিলাম ওই নামটাই ছবির জন্য থাক। মনে আছে মিস্টার বচ্চন শ্যুটিং করার পর নিজের মেক আপ ভ্যানে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হু ইজ দ্যাট অ্যাক্টর?’ উনি তখনই নিশ্চয় ওর ট্যালেন্টটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।”

এই রকম সব অভিজ্ঞতা। আর তার পর ছবিটা আটকে পড়ে থাকা। এক বারও কি এ প্রশ্ন মাথায় আসেনি যে এর পরেও অমিতাভ কেন তাঁর সঙ্গে আরও একটা ছবি করতে রাজি হবেন? বিজ্ঞাপনের জগৎটা আলাদা। কিন্তু আবার ছবি? ন্যাড়া কি বারবার বেলতলায় যায়? “প্রশ্নটা যে আমার মাথায় একদম আসেনি তা নয়। ‘জনি মস্তানা’র যাই হোক না কেন, আমরা দু’জনেই এই ছবিটা নিয়ে খুব গর্বিত। একটা ইমোশনাল ব্যাগেজ আমাদের আছে। কিন্তু টেকনিশিয়ান হিসেবে অতীতে যা হয়েছে, তার জন্য একে অপরের প্রতি বিন্দুমাত্র রেসপেক্ট কমেনি।”

‘পিকু’র শ্যুটিং করতে গিয়ে আরও একটা স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে অমিতাভর। যেদিন প্রথম শোনেন যে এ ছবিতে যিশু সেনগুপ্ত কাজ করছেন, তখন সুজিতকে উনি বলেছিলেন যিশুর সঙ্গে এর আগে ‘দ্য লাস্ট লিয়র’য়ে কাজ করার কথা। “যিশু, কলকাতায় শ্যুটিং এ সব প্রসঙ্গ উঠলেই ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) কথা বারবার বলেন মিস্টার বচ্চন। ‘দ্য লাস্ট লিয়র’ ছবির শ্যুটিং করতে এসেছিলেন কলকাতায়। আমাদের গল্প করেছেন সেই শ্যুটিংয়ের। বারবার আক্ষেপ করেন ঋতুদার মৃত্যু নিয়ে। বলতে থাকেন এত প্রতিভাবান একজন পরিচালক এত তাড়াতাড়ি চলে গেল...”

এ বার ‘পিকু’র শ্যুটিংয়ে কলকাতায় ফিরে এলে সে স্মৃতি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে যাবে হয়তো। যেদিন গাড়ি নিয়ে কলকাতা দেখতে বেরোবেন বলে ঠিক করেছেন, সেদিন কি লিটল রাসেল স্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হয়ে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যাবেন ইন্দ্রাণী পার্ক-এর দিকে? হয়তো কি একবার ঢুঁ মারবেন যিশু-সুজিতকে নিয়ে ঋতুপর্ণর স্মৃতিমাখা ‘তাসের ঘর’টাতেও?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement