সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু বলিউডে স্বজনপোষণের বিতর্ক নতুন করে উস্কে দিয়েছে। বংশপরম্পরায় যাঁরা ফিল্মি দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত অথবা যাঁদের মাথার উপর ‘গডফাদার’ রয়েছেন, তাঁরাই কেবল বলিউডে ভাল কাজের সুযোগ পান বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। আর এই অভিযোগ যে একেবারেই ফেলনা নয়, তার প্রমাণ বেশ কিছু অভিনেতা। বছরের পর বছর নিজেদের প্রমাণ করে গেলেও, কখনওই বলিউডের ‘এ’ লিস্টার হয়ে উঠতে পারেননি তাঁরা।
এই তালিকায় প্রথমেই যাঁর নাম উঠে আসবে তিনি হলেন রণদীপ হুডা। ২০০১ সালে মীরা নায়ারের ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন রণদীপ। দীর্ঘ দু’দশকে ‘সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার’, ‘ম্যায় অউর চার্লস’, ‘হাইওয়ে’ এবং ‘সর্বজিৎ’-এর মতো ছবিতে নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করলেও, আজও বলিউডের প্রথম সারিতে জায়গা হয়নি তাঁর।
শুধু তাই নয়, ২০১৬ থেকে প্রায় দু’বছর ধরে ‘ব্যাটল অব সারাগড়ী’ ছবির জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন রণদীপ। হাবিলদার ইশার সিংহের চরিত্রে নিজেকে গড়ে নিতে মার্শাল আর্টও শেখেন। দাড়িও বাড়ান। ইশার সিংহের চরিত্রে রণদীপের ফার্স্টলুকও প্রকাশ করে দেন পরিচালক রাজকুমার সন্তোষী।
কিন্তু প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে রণদীপের সমস্ত চেষ্টায় জল ঢেলে দেন কর্ণ জোহর। ২০১৮ সালে অক্ষয়কুমারকে নিয়ে ওই একই প্রেক্ষাপটে ‘কেশরী’ ছবির ঘোষণা করেন তিনি। যে ইশার সিংহের চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল রণদীপের, ওই একই চরিত্রে অভিনয় করেন অক্ষয়। ছবিতে তাঁর লুকও ছিল হুবহু রণদীপের মতো।
ঘোষণার এক বছরের মধ্যে মুক্তি পায় ‘কেশরী’। ছবির বিষয়বস্তু যেহেতু এক, তাই রণদীপের ‘ব্যাটল অব সারাগড়ী’-র মুক্তি আটকে যায়। ছবির জন্য অনেক খেটেছিলেন রণদীপ। সমসাময়িক ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনাও করেছিলেন। তাঁর আশা ছিল, কেউ না কেউ ছবিটি নতুন করে শুরু করার কথা ভাববেন হয়ত। কিন্তু আজও তা হয়নি।
রণদীপের মতোই বরাবর বলিউডের প্রথম সারি থেকে বরাবরই ব্রাত্য জিমি শেরগিল। ১৯৯৬ সালে গুলজার পরিচালিত ‘মাচিস’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে পা রাখে জিমি। ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। তার পর ‘মহব্বতেঁ’, ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’, ‘ইয়াহাঁ’, ‘আ ওয়েডনেসডে’, ‘তনু ওয়েডস মনু’-র মতো একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন জিমি।
কিন্তু বলিউড কখনই তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। তাতে তিতিবিরক্ত হয়ে একটা সময় পঞ্জাবি ছবিতে মনোনিবেশ করেন জিমি। পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বলিউডে সাধারণত পার্শ্বচরিত্রেই দেখা যায় তাঁকে। তবে চরিত্র যেমনই হোক না কেন, তাকে নিজের মতো করে নেন জিমি, যা দর্শকের মনেও ছাপ ফেলে।
নাটকের প্রতি ভালবাসা থেকে বলিউডে প্রবেশ বিজয় রাজের। তবে দীর্ঘ সময় তাঁকে শুধুমাত্র কৌতুকাভিনেতার চরিত্রেই বেঁধে রেখেছিল বলিউড। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় তাঁর অভিনয় দেখে অত্যন্ত খুশি হন নাসিরুদ্দিন শাহ। তিনিই পরিচালকদের কাছে তাঁর হয়ে সুপারিশ করেন।
১৯৯৯ সালে ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন বিজয়। তার পর ‘যুবা’, ‘ডেলি বেলি’, ‘রঘু রোমিয়ো’, ‘দিল্লি-৬’, ‘পটাখা’, ‘গাল্লি বয়’-এর মতো ছবিতে নায়কদেরও টেক্কা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বলিউডে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিতই থেকে গিয়েছেন তিনি।
‘তনু ওয়েডস মনু’-র ‘পাপ্পিজি’ হোক বা ‘হিন্দি মিডিয়াম’-এর শ্যামপ্রকাশ, সব ছবিতেই দর্শকের মনে ছাপ ফেলতে পেরেছেন দীপক ডোব্রিয়াল। ‘ওমকারা’-তে ‘ল্যাংড়া ত্যাগী’ সইফের পাশে তাঁর অভিনয় আজও মনে রেখেছেন দর্শক। কিন্তু আজকাল হাতেগোনা ছবিতেই দেখা যায় দীপককে। যা-ও হাতে পান, সবই কৌতুক চরিত্র।
সবে দু’একটা ছবি করেছেন। তার পরেই ১৯৯৫ সালে সলমন খানের নায়িকা হিসেবে ‘বীরগতি’তে সুযোগ পান দিব্যা দত্ত। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ততই নায়িকা থেকে পার্শ্বনায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন দিব্যা। দীর্ঘ কেরিয়ারে ‘বীর-জারা’, ‘দিল্লি-৬’, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ের জাত চিনিয়েছেন তিনি।
২০১৮ সালে ‘ইরাদা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কারও পান দিব্যা। এ ছাড়াও, হলিউডেও কাজ করেছেন দিব্যা। কিন্তু বলিউড পার্শ্বচরিত্রেই বেঁধে রেখেছে তাঁকে।
মুন্নাভাই আর সার্কিটের যুগলবন্দি রাতারাতি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল আরশাদ ওয়ার্সিকে। ‘কাবুল এক্সপ্রেস’, ‘ইশকিয়া’, ‘জলি এলএলবি’ ছবিতে তাঁর অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসিত হয়। কিন্তু বলিউড তাঁকে বেঁধে রাখে কৌতুকাভিনেতা হিসেবেই। তাই ‘গোলমাল’ সিরিজ ছাড়া সম্প্রতি কোনও বড় বাজেটের ছবিতে দেখা যায়নি তাঁকে।
বাধ্য হয়ে সম্প্রতি ওয়েব সিরিজে ঝুঁকেছেন তিনি। আর শুরুতেই সেখানে ছক্কা হাঁকিয়েছেন আরশাদ। তাঁর অভিনীত ‘অসুর’ সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
নামের পাশে বিখ্যাত মায়ের মেয়ে তকমা থাকলেও, বলিউড এবং টলিউড, দুই জায়গাতেই নিজের স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়তে পেরেছিলেন কঙ্কণা সেনশর্মা। প্রথম ছবি ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। কিন্তু বলিউডে তাঁকে আজও আর্ট ফিল্মের মধ্যেই বেঁধে রেখেছে।
কঙ্কণার তরফে যদিও চেষ্টায় কোনও ত্রুটি ছিল না। এক দিকে ‘ওমকারা,’ ‘১৫ পার্ক অ্যাভিনিউ’-এর মতো ছবি যেমন করেছেন, তেমনই ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’, ‘লগা চুনরি মে দাগ’, ‘ওয়েক আপ সিড’, ‘লাক বাই চান্স’-এর মতো বাণিজ্যিক ছবিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু বলিউডের প্রথম সারি থেকে ব্রাত্যই থেকেছেন কঙ্কণা।
এফটিআইআই থেকে অভিনয় শিখেও বলিউডে কল্কে পেতে দীর্ঘ লড়াই করেত হয়েছে জয়দীপ আহলাওয়াতকে। ২০১০ সালে প্রিয়দর্শনের ‘খট্টা মিঠা’ ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে। জনপ্রিয়তা পান অনুরাগ কাশ্যপের ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ এবং ‘রাজি’ ছবির দৌলতে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মূল ধারার বলিউডি ছবি থেকে অনেক দূরে জয়দীপ। বরং দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে অনলাইনে। ‘লাস্ট স্টোরিজ’, ‘পাতাললোক’ এবং ‘বার্ড অব ব্লাড’ তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে।